মোহাম্মদ আলী স্যার

425786_284503798289466_1729304008_n
মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছবিটি স্কুলের ফেসবুক থেকে নেয়া।

আমার স্কুল জীবনে কোন শিক্ষক পড়ালেখা বিষয়ে আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারে নাই। পূর্বে কোন এক লেখায় এই কথা আমি বলেছিলাম। এটা আমার সৌভাগ্য না বলে দূর্ভাগ্যই বলবো। আকৃষ্ট করলে হয়তো আমার একাডেমিক পড়ালেখা একটু হইলেও অন্য রকম হতে পারতো।

আমার স্কুল জীবনটাও খুব একটা বড় না। মাত্র চার পাঁচ বছর। এই অল্প সময়েও পড়ালেখার বাইরে আমাকে দুয়েকজন শিক্ষক আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। সেই দুয়েকজনের মধ্যে একজন মাওলানা মোহাম্মদ আলী স্যার। বলা যায় তিনিই ছিলেন আমার কাছে নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার সেরা শিক্ষক। কিন্তু সেটা পড়ালেখা বিষয়ে না। অন্য কিছু বিষয়ে। সেই অন্য রকম কয়েকটা বিষয়ই স্মৃতিচারণ করার চেষ্টা করছি।

স্কুলের পাশে স্যারদের একটা লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরিতে স্যার বসতেন পাশাপাশি স্যারের এক ভাগিনা বসতেন। তিনি সম্ভবত কোন এক কলেজে পড়তেন। তখনকার সময় আমরা লাইব্রেরি মানে বুঝতাম বই-খাতা বিক্রি করে যে দোকান সেটা। আর বইপত্র পড়ার জন্য যেটা ছিল সেটাকে আমরা পাঠাগার বলতাম। স্যারের লাইব্রেরির নামটা মনে নাই। ‘নাখালপাড়া লাইব্রেরি’ বা এই রকম কিছু একটা হবে। সেই লাইব্রেরি থেকে আমরা অনেকেই খাতা-কলম কিনতাম। বাকিতেও কিনতাম। বাকিতে কিনতে গেলে খাতায় নাম লিখতে হতো, পাশাপাশি কোন ক্লাশে পড়ি এবং রোল নাম্বার। স্যার কখনো বাকি টাকা চাইতেন না। তবে অনেক টাকা জমা হয়ে গেলে তখন চাইতেন। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি আমার প্রায় ১৩০ টাকার মত জমা হয়ে গেল।

একদিন স্যার ক্লাশে আসলেন তাও অন্য একটা ক্লাশের মাঝখানে। সম্ভবত গোলদার বাবু স্যার অংক ক্লাশ নিচ্ছিলেন। স্যার এসেই রোল নাম্বার বললেন, আমি দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, ‘আপনে একটু বাইরে আসেন।’ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রকে একজন শিক্ষক আপনে করে বলাটা একটা ধাক্কার মত। আমি ভয়ে ভয়ে বের হলাম। বারান্দায় যাওয়ার পর স্যার খাতা দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার কাছে কিছু টাকা পাওনা ছিল, আপনার বাবাকে বলবেন টাকা দিতে পারলে আমার খুব উপকার হয়।’

স্যারের এই আলাদা করে ডেকে নেয়াটা আমার মনে তখন একটা দাগ কেটে দিয়েছিল। স্যার চাইলেই ক্লাশের মধ্যে এই কথা বলতে পারতেন সবার সামনে। কিন্তু তিনি এই কাজটা করেন নাই। আমাকে লজ্জায় ফেলতে চান নাই। এই বিষয়টা আমাকে চরমভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

স্যার সাধারণত মাধ্যমিক শাখার ক্লাশ নিতেন। স্যারের বিষয় ছিল ধর্ম। আমার চার পাঁচ বছর স্কুল জীবনে মাধ্যমিক শাখায় মাত্র এক বছর পড়েছিলাম সেটা নবম শ্রেণিতে। বাকি বছরগুলা প্রাথমিক শাখাতে। তাই স্যারকে আমি এক বছর পেয়েছিলাম ক্লাশে। কিন্তু আমি যেহেতু সারা বছর ক্লাশ করতাম না তাই স্যারকে ঐভাবে পাই নাই।

যেই স্যাররা ধর্মীয় শিক্ষক তাঁদের একটা বড় সমস্যা আর্থিক সমস্যা। অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা অনেক ছাত্র-ছাত্রী পান পড়ানোর জন্য বিশেষ অংক ইংরেজি হলে। ধর্মীয় শিক্ষকরা অনেক দুর্দশায় থাকেন। আমাদের গলিতেই থাকতেন বাবুল স্যার। তিনি স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। স্যারের বাসায় অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসতেন।

একদিন সন্ধ্যায় দেখি বাবুল স্যারের বাসা থেকে মোহাম্মদ আলী স্যার বের হচ্ছেন। প্রথম দিন দেখে ভাবলাম স্যার এমনি দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখি স্যার প্রায়ই বাবুল স্যারের বাসায় আসেন। প্রথমেই যেটা মাথায় আসলো বাবুল স্যার তো হিন্দু এখানে মোহাম্মদ আলী স্যার আসেন কেন প্রতিদিন? এখানে কি কাজ? কৌতুহলবসত একদিন বারান্দা দিয়ে উকি দিলাম। দেখি মোহাম্মদ আলী স্যার বাবুল স্যারের ছেলেকে পড়াচ্ছেন। বুঝতে পারলাম স্যার বাবুল স্যারের ছেলেকে পড়ানোর জন্যই প্রতিদিন আসেন।

স্যার ক্লাশে ঢুকলে সবাই চুপ হয়ে যেতেন। স্যার বেত আনতেন কম, স্যারের শাস্তি দেয়ার ধরন ছিল কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা। আর দূর থেকে ডাস্টার ছুড়ে মারা। স্যারের ক্লাশে আরেকটা বিষয় আবিষ্কার করলাম। তিনি ক্লাশে ঢুকে সবাইকে তুই তুই করে বলেন। কিন্তু বাইরে কারো সঙ্গে কথা বললে আপনে করে সম্বোধন করে থাকেন। স্যারের আপনে বলাটা আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল। পাশাপাশি স্যারের হাঁটা-চলাও আমাকে বেশ আকৃষ্ট করতো।

আজ শিক্ষক দিবসে মাওলানা মোহাম্মদ আলী স্যার ছাড়া অন্য কোন স্যারের কথা মাথায় আসতেছে না।

.

২0 আশ্বিন ১৪২৩

Comments

comments

Comments

  1. biswajit

    vai onek vhalo laglo lekhata porey.
    shotti vai sir onek vhalo ekjon manush chilen.
    amar akhono sir-er kotha money porey…
    apnar lekhata porey abaro shei dingulor kotha money porey gelo ^_^

    1. আপনে লেখাটা পড়েছেন এবং কমেন্ট করেছেন দেখে আমারও ভাল লাগলো। 🙂

  2. মোঃমোস্তফা

    আমাকে নাম দিয়েছিল মালটুবা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.