আপনারা কতজন টিওবির প্রথম দিনগুলোর কথা জানেন?
আজ কালকের পোলাপান অ্যাডমিনগুলো গুনগত মান আর আজাইরা হাবিজাবি নিয়মের কথা বলে আপনাদের উপর ছড়ি ঘুরায়। কিন্তু জানেন কি এই টিওবি শুরুতে পোস্ট করত অন্যান্য ওয়েব সাইটের তথ্য কপি করে? কত বুদ্ধিজীবীর গালি খেয়েছি অন্যের পোস্ট কপিপেস্ট করার জন্য। এই কপি পেস্টের মূল কাহিনী হল, টিওবি গ্রুপটা তৈরি করার পর প্রায় এক দেড় বছর এই গ্রুপে শুধু আমি একাই পোস্ট করতাম। কপি পেস্ট করা ছাড়া উপায় কি ছিল বলুন?
এখন মাঝে মাঝে হিংসা হয়। আজকে কত সহজে আপনারা নিজেদের ঘুরে বেড়াবার কথা সবার সাথে শেয়ার করছেন। ২০০৭-২০০৮ অব্দি আমার মত DOMISTIC ANIMAL (আমাদের সময়কার আরবান স্লাং, “পুতুপুতু” বা “মধ্যবিত্ত ঘরের আদরের সন্তান”কে প্রতিশব্দ হিসেবে ধরতে পারেন) দের জন্য ঘুরতে যাবার কথা বাসায় বলা ছিল বড় ধরণের অপরাধ। তাও যা যাওয়া হত তা বাসায় ভুলভাল বা মিথ্যা বুঝিয়ে। ঘুরে এসে আবার গল্প করব, সেই সাহস বেশির ভাগের মধ্যেই ছিল না। একটু উদারচেতা পরিবারে বছরে একবার শিক্ষা সফর বলে কয়ে ম্যানেজ করা যেত।
আবার ঘুরতে গিয়ে ছবি তোলার হিসাব ছিল অত্যন্ত জটিল। এক রিলে কয়টা ছবি তোলা যায় আর তার মধ্যে কয়টা যাবে প্রিন্টে, সে এক এলাহি ব্যাপার। আসলে সেই সময় আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিচারে ঘুরাঘুরি ছিল বাহুল্য। একান্নবর্তী পরিবারের একজন ছেলেকে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হলে অন্যদের কথাও চিন্তা করতে হত। পিচ্চিকালে বুঝতাম না, আজ সংসার চালাতে গিয়ে বুঝি। আজ আর সেই সমস্যা নেই। আজ আমরা প্রত্যেকেই আলাদা, সুতরাং নিজেদের চিন্তা করলেই হয়। আর ট্রেন্ডিং জায়গাগুলোতে না গেলে আর ট্রেন্ডিং অ্যাকটিভিটিগুলো না করলে আসলে সমাজে জাতেই উঠা যায় না ।
যাই হোক, কাজের কথায় আসি।
অনেকে মনে করে আমি অনেক ঘুরেছি, কিন্তু আসলে বন্ধু নওশাদের কাধে চড়ে (আর্থিক ও দ্বায়িত্ব চাপিয়ে, দুই ভাবেই) দুই চারটা এদিকসেদিক যাওয়া ছাড়া তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। আর তাতেই নিজেকে তখন ইবনে বতুতার সাথে তুলনা করছি। ২০০৩ সালে (খুব সম্ভবত, ২০০৪ ও হইতে পারে) মিশন এভারেস্ট নামে একটা ইভেন্ট আসে। তিনজনের একটা দলকে এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে পাঠাবে। সাঁতার জানি না তাই সেই ইভেন্টে নওশাদের সাথে যোগ দেয়া হল না। কিন্তু কাধে ২০-২৫ কেজির ব্যাগ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ততদিনে নিজেদের আমরা অ্যাডভেঞ্চার ম্যান ভাবা শুরু করেছি। বছর খানেকের মধ্যে এভারেস্ট থাকবে আমাদের পায়ের তলায় এমন চিন্তা ভাবনা। আর সত্যি হল তখনও এভারেস্ট আর হিমালয়ের মধ্যে পার্থক্য কি তাই জানি না। কিন্তু এই ইভেন্টটা স্বতন্ত্র ভাবে খুব বেশি প্রভাব না ফেলতে পারলেও আমার মতে নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার ও আউটডোর একটিভিটির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের ঘুরাঘুরি পুরোই ছিল নওশাদ কেন্দ্রিক। ২০০৭ এ নওশাদের কুয়েতে চাকরী হবার পর থেকে পুরাই একা হয়ে গেলাম। তাও যা ছোটখাট এদিক সেদিক যাওয়া হত তাও বাদ। খুব সম্ভবত ২০০৬ এর শেষের দিকে ফেইসবুকের সাথে পরিচিত হই। ফেইসবুক একাউন্ট খুললেও তখনও ব্যবহার বেশি হয় ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার আর ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য ভার্চুয়াল টুরিস্ট। ২০০৭ এ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার হাঁটার একটা ইভেন্ট হয়, সেখানে পরিচয় হয় সাজ্জাদের সাথে। ২০০৭ এর ডিসেম্বরে দুইটা দল বাংলাদেশের সবথেকে উঁচু পাহাড়ে উঠার এবং তার জিপিএস রিডিং নেয়ার ঘোষণা দেয়। আর এই বছরই “ট্র্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশ” নামে একটা গ্রুপ তৈরি হয় ফেইসবুকে ।
যাত্রা শুরু:
২০২০ এ বসে ২০০৭ সালকে তুলনা করা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত নয়। বড়দের অনেকে বলে দেশের জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকায় কোন এক প্রতিবেদন বের হয়েছিল যে প্রতিবেদক নৌকা করে কেওক্রাডংয়ের পাদদেশে গিয়ে কেওক্রাডং চড়ে এসেছে। ২০০৭ এ এসে সারা দুনিয়া যখন পর্যটন আর তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে ব্যস্ত, আমরা তখনও নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য এদিক সেদিক হাতরে মরি। ২০২০ এ এসেও আজও কেওক্রাডং, তাজিং ডং না সাকা হাফং , কোনটি দেশের সর্বচ্চ চূড়া তাও সরকারিভাবে নির্ভরশীল কোন তথ্য নেই।
২০০৭ সালে আমরা যারা নিজেদের ইবনে বতুতার উত্তরসরি ভাবতাম তাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ ছিল ভ্রমণের প্রতি আর্থ সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি, তথ্যের অভাব আর ভ্রমণ সংগীর সংকট।
আর তার উপর আমার মত যারা “এই তো কালকেই এভারেস্টে রওনা দিলাম আর পরশু এভারেস্ট জয় করে ফিরছি” টাইপের ছিলাম তাদের আবার একটু অ্যাডভেঞ্চার না হলে হয় না। তাই কক্সবাজার, সিলেটের চা বাগান, কাপ্তাই লেক খুব বেশি হলে সেন্ট মার্টিন ইত্যাদি (২০০৭ সালে ভ্রমণের জন্য হাতে গোনা এই কয়েকটা অপশনই ছিল সাধারণের জন্য) ট্রিপগুলোতে আর মজা মিলত না। সুতরাং আমাদের দরকার তখন অ্যাডভেঞ্চার আর আউটডোর অ্যাকটিভিটি।
আমি বলছি না তখনকার দিনে কেউ অ্যাডভেঞ্চার বা আউটডোর অ্যাকটিভিটি করত না। কিন্তু তা ছিল আমার মত সাধারণ ও একলা কারো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আমি আর নওশাদ এক তাঁবু খুঁজতে যে কাহিনী করেছিলাম তা আজ আর নাইবা বলি। পুরো দুইদিন ঢাকার এক মাথা থেকে অন্য মাথা ঘুরে বের হয়েছি। শেষ পর্যন্ত একটুর জন্য ভারি ক্যানভাসের তাঁবু কিনে ফেলা হয়নি। তখনকার দিনে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের দৌড় ছিল কেওক্রাডং, সেণ্টমার্টিন, হঠাৎ ট্রেন ধরে কোথাও সেলফ ডিপেন্ডেন্ট ট্রিপে বা সেলফ ডিপেন্ডেন্ট হাইকিংয়ে বের হয়ে যাওয়া (কাধের ব্যাগ বোচকার সব কিছু থাকলেও, দিন শেষে ট্রিপগুলো পুরোপুরি সেলফ ডিপেন্ডেন্ট হত না)। রান্না করার জন্য নওশাদকে দিয়ে একটা কেরাসিন তেলের চুলা কেনা হয়েছিল (চায়ের দোকানে যে চুলা দেখা যায়), মনে হয় কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কোনদিন তা ব্যবহার করা হয়ে উঠেনি। সেই সব দিনে আসলেই কোন জায়গার তথ্য পাওয়া যে কি কঠিন ছিল বলে বোঝানো যাবে না।
যাই হোক সাধারণের জন্য উন্মুক্ত ও নির্ভরযোগ্য ভ্রমণ তথ্য এবং আউটডোর অ্যাকটিভিটি ভিত্তিক ট্রিপের জন্য আগ্রহীদের জন্য শুরু হয় গ্রুপ টিওবি। প্রথম মাসে ১৩ জন সদস্য, ২০০৭ শেষে ৩৫০, ২০০৮ শেষে হাজার ছুঁই ছুঁই।
২০০৭ এর ডিসেম্বরে যে দুইটি দল সাকা হাফং মেপেছিল, তার মধ্যে একটা দল ছিল “নেচার অ্যাডভেঞ্চার” ক্লাব। সেই বছর মার্চে কক্সবাজার হাঁটতে গিয়ে নেচার অ্যাডভেঞ্চারের সাজ্জাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। পরে ভার্চুয়াল টুরিস্টের মাধ্যমে ফোন নাম্বার আদান প্রদান। ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে ফোন। নতুন পাহাড়ে যাবে ওরা। যাব নাকি ওদের সাথে। কোথায়? বলা যাবে না। ওরা তিন জন আর আমি, রূপক আর তারেক ৬ জন মিলে রওনা দিলাম। বাসে উঠে জানতে পারলাম গন্তব্য, সিপ্পি ।
আমরা ঢুকব থানচি বা রুমা নয়, আরো উত্তরের রোয়াংছড়ি দিয়ে। এই দিকে যাওয়া হয়নি সুতরাং নতুন গন্তব্য , নতুন পাহাড়। ফিরে আসলাম নতুন চিন্তা নিয়ে। এর আগে বন্ধুদের সাথে ঘুড়াঘুরি হওয়াতে তা ছিল অন্য রকম, কিন্তু এবার সম্পূর্ণ নতুন মানুষের সাথে ঘুরে নতুন ভাবে ভাবতে শিখলাম। আমরা যেভাবে ভাবি তাই শেষ নয়। অনেক মানুষজন আছে যারা অন্য ভাবে ভাবে ।
সিপ্পি থেকে ফিরে নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকল সাজ্জাদের সাথে। ওদের ক্লাবের অন্য দুই মেম্বার রুবেল ভাই আর হান। রুবেল ভাইয়ের অফিসে বসে দেখলাম গুগল আর্থে রুট ম্যপিং। নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব দেশের সব উঁচু পাহারগুলো মাপতে চায়। তার জন্য স্পন্সরের জন্য কাগজ পত্র বানানো । এর মাঝে নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব থেকে কেওক্রাডংয়ে যাবার কমার্সিয়াল ইভেন্ট প্ল্যান হল। সেই ট্রিপে যাওয়া একজন ছিল সাইদ সৌম্য। টিওবির ইতিহাসে অন্যতম্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সময় মত নিয়ে আসব তাকে।
তখনও এভারেস্ট মারি আমি দিনে কয়েকবার। তাই রুবেল ভাই আর সাজ্জাদের কাছে জানতে চাইলাম কার থেকে যথাযত গাইড লাইন পাওয়া যাবে মাউন্টেইনিয়ার হবার জন্য। দুই জনই বলল বাবু ভাইয়ের কথা। তখনকার দিনে দেশের একমাত্র সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মাউন্টেননিয়ারিং ট্রেইনার। কিন্তু এই বাবু ভাইয়ের এপয়েন্টমেন্ট পেতেই লাগল প্রায় মাস খানেক।
একদিন বাবু ভাই আসলেন রুবেল ভাইয়ের অফিসে। কিছু কথা বলে এক মাসের একটা রুটিন দিলেন। যতদূর মনে পরে একদিনও সেই রূটিন ফলো করা হয়নি। কিন্তু লাভের লাভ যেটা হয়েছে তা হল মাউন্টেইনিয়ারিংয়ের ভুত মাথা থেকে নামল আর সেই সাথে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভ্রমণ সংগঠনের সাথে পরিচয় হল। ভ্রমণ বাংলাদেশ, দেশের পুরানো ভ্রমণ সংগটনগুলোর মধ্যে একটা। সত্যি বলতে তখনকার দিনের সাথে তুলনা করলে তাদের অ্যাডভেঞ্চার আর আউটডোর অ্যাকটিভিটির তালিকা ঈর্ষণীয়। বাবু ভাই, মনা ভাই আর টুটূ ভাইয়ের গল্পের ঝুরি অফুরন্ত। সেই গল্পের টানেই প্রতি সন্ধায় হাজির হতাম চারুকলার সামনের রাস্তায় । আবার নতুন করে ভাবনার দূয়ার খুলল।
তখনকার দিনে ভ্রমণ দুনিয়ায় ফেইসবুকের থেকে ব্লগ অনেক জনপ্রিয় ছিল। আর সেই ভ্রমণ ব্লগের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ছিল “সাইদ সৌম্য”। আপনাকে ভাবনার অন্য এক দুনিয়ায় নিয়ে যেতে পারবে এমন এক ব্লগ লেখক সে। নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের কেউক্রাডং ট্রিপের পরই যোগাযোগ বাড়ল সৌম্যর সাথে। আর এক সময় সে দ্বায়িত্ব নিল টিওবি অ্যাডমিনের। আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে থাকল টিওবি ভ্রমণ দুনিয়ায়। বাড়ল দৈনন্দিন ভ্রমণ আলাপ আলোচনা টিওবির ওয়ালে। আমরা আজকে যেমন গ্রুপ চ্যাট করি, তখনকার দিনে টিওবির ওয়ালেই আলোচনা হত। কোথায় যাওয়া যায়। কি করা যায়। এমন কি জাস্ট হায় – হ্যালো।
২০০৮ সালের প্রথম রমজানের আগের দিন, হঠাৎ একটা দূর্ঘটনায় পড়ি। ঠোট ও থুতনীতে গোটা দশেক সেলাই নিয়ে যখন বাসায় বসে। তখন কি যেন পাগলামী উঠল মাথায় টিওবির প্রথম দুইটা ইভেন্ট একসাথে দিয়ে দেয়া হইল। প্রথমটা একটা ফটো কনটেস্ট আর ঈদের পর পুজার ছুটিতে কোথাও যাওয়া। সময় দেয়া একটূ বাড়ল টিওবিতে।
এই সময় টিওবিতে যুক্ত হল আরেক অ্যাডমিন। স্বপ্ন দেখার দল নামের আরেক ফেইসবুক গ্রুপের সক্রিয় সদস্য মেহেরুন নেসা। অনেকেই হয়ত জানে না টিওবির প্রথম ইভেন্ট হল একটা ফটোগ্রাফি কনটেস্ট। তার দ্বায়িত্বে আসলেন উনি। তখনকার দিনের অনেক বিখ্যাত মানুষ এটেন্ড করল এই ইভেন্টে। ইভেন্ট হিসেবে খুব অদ্ভুত আর সুন্দরভাবে শেষ করতে না পারার বিচারে একটা অসফল হলেও, এই ইভেন্টই তখনকার দিনের ছোট ট্র্যাভেল কমুউনিটিতে নিজের পরিচয় জানান দিল।
আজকে যেমন হুট করে আপনি প্রায় সব জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান করতে পারেন, হঠাৎ করে বললেও দুই চার জন বন্ধু বান্ধব যোগাড় হয়ে যাবে না হয় কমার্শিয়াল কোন সার্ভিস প্রোভাইডার এর থেকে সার্ভিস পেয়ে যাবেন। না হয় হুট করে কম্পিউটারের সামনে বসে আর বন্ধুকে ফোন করে পেয়ে যাবেন অন্তত মোটামুটি নির্ভরযোগ্য তথ্য, ২০০৭ বা তার আগে বিষয়টি তা ছিল না।
আগেই বলেছি, বেড়াতে যাওয়া আক্ষরিক এবং বাস্তবিক ভাবে ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাহুল্য। আজকে যেমন ট্রেন্ডিং ডেস্টিনেশনে বেড়াতে না গেলে জাত চলে যায়, তখনকার দিনে বিষয়টা সামাজিক না হলেও পারিবারিক অপরাধ হিসেবে দেখা হত। পরিবারের যে ছেলেটা (শুধু ছেলে বলছি, কারণ প্রকৃত অর্থেই মেয়েদের অংশগ্রহন ছিল কম। তাই বলে ছিল না বললে ভুল হবে) মাঝে মধ্যে হুট করে বের হয়ে যেত তাকে নিয়ে পরিবারের দুশ্চিন্তা আর হতাশার শেষ ছিল না। এই ছেলেকে দিয়ে কি হবে। বাপের টাকায় শুধু ঘুরে বেড়ায়।
ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি তখন ছিল মাত্র কক্সবাজার কেন্দ্রিক। তা ছাড়া রাংগামাটি (মূলত কাপ্তাই লেক) আর সিলেট বিভাগে কিছু জায়গা (জাফলং, লাউয়াছড়া, চা বাগান আর মাধবকুণ্ড)। ট্রেকিং বা ক্যম্পিং ট্রিপ ছিল কিছু ছন্নছাড়া পোলাপানের কাজ। ট্রেকিং বা ক্যাম্পিং ট্রিপগুলো মূলত কিছু ক্লাব বা ছোট ছোট দল করত, আর এই দলগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল। ছোট দলগুলোতে ঢুকতে পারা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। আর ক্লাবগুলোও তাদের রক্ষণশীল মনভাব প্রকাশ করত যোগ দিতে চাইলে। অপরদিকে সত্যি কথা বলতে ক্লাবগুলো ছিল আমাদের মত সাধারণ পোলাপান যাদের একটু অ্যাডভেঞ্চার আর আউটডোর অ্যাকটিভিটির ঝোক আছে তাদের কাছে স্বপ্নের দুনিয়ায় বাস করা এলিট শ্রেণির লোকজন। মাস খানেক পর পরই তারা বের হয়ে পরে কাধে ইয়া বড় ব্যাগ নিয়ে, সঙ্গে তাঁবু আর কতকি। কত অদ্ভূদ আর স্বপ্নের মত জায়গায় যায় তারা। কি রোমাঞ্চকর আর অদ্ভূত তাদের জীবন। দুই একটা ক্লাবের সাথে মিশতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়ে উঠেনি। বিএমটিসি মূলত মাউন্টেইনারিং ফোকাস আর নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের লক্ষ যত দ্রূত সম্ভব দেশের সব পাহার চুড়ায় অভি্যান চালানো। বিটিইএফ একটু ক্লাসিক জায়গা, আর দুই-চারটা ক্লাব যেখানে গেছি, যেয়ে মনে হয়েছে তাদের সকল অভিজান পর্ব শেষ। এখন নতুনদের টাকার বিনীময়ে জ্ঞান বিতরণ করে ধণ্য করছে।
সেই থেকে সবসময় সমাধান খোঁজা, যেহেতু বন্ধু নেই নতুনদের সাথে কেমনে যায় ঘুরে বেড়ানো আউটডোর অ্যাকটিভিটির সাথে। মুখের থোব্রা ভেংগে পরে থাকা অবস্থায় মিলে গেল সেই সুযোগ প্রথমবার না হয় আমি নিজেই আয়োজন করি। ২০০৮ সালে ঈদের ছুটি আর পূজার ছুটি একসাথে পরেছিল। ঈদের পরদিন ভ্রমণ বাংলাদেশের সাথে নিঝুম দ্বীপ (একটা অসাধারণ ট্রিপ ছিল, যাদের ভ্রমণ গল্প এতদিন শুনে এসেছি তাদের সাথে ভ্রমণে বের হওয়া একটা স্বপ্নের মত) আর ফিরে এসে টিওবির প্রথম ট্রিপ। প্রথমে কথা ছিল হয় সাগরে (কুয়াকাটা) না হয় পাহাড়ে (ক্রেউক্রাডং না হয় সিপ্পি)। যেহেতু নিঝুম দ্বীপের প্ল্যান হয়ে গিয়েছিল তাই সিস্টেম করে সাগর বাদ দিলাম। আর সৌম্য যেহেতু আগের বছর কেওক্রাডং ঘুরে এসেছে তাই আমাদের টার্গেট হয়ে গেল সিপ্পি।
ভাংগা চোপা নিয়েই ট্রিপ মিটিংয়ে গেলাম, টিএসসিতে। আমি আর সৌম্য সহ ১২-১৫ জন হবে। সবার এই প্রশ্ন সেই প্রশ্ন, টিকিটের টাকা দেয়ার দিন আসলে জানা গেল সৌম্যর দুই বন্ধু যাবে ওর সাথে আর ইউএন এর এক কর্মকর্তা। কত ভাবছিলাম অন্য ক্লাবে যেরকম দেখেছিলাম সেভাবে নতুনদের শেখাব, সেখানে কি কোন ইউ এন কর্মকর্তা, আর সৌম্যর বন্ধুতো ঘরের মানুষ। ইউএন ব্যাটার এই বুড়া কালে আবার শখ চাপল কেন? ট্রিপ বাতিলের জন্য অনেক ইতি উতি করলাম সৌম্যর সাথে, কিন্তু জুত হল না। ২০০৮ এর পুজার ছুটিতে আমরা গেলাম সিপ্পি আরসুয়াং। আর সেই ইউএন এর ভদ্রলোকটিই হল আমাদের ফজলে রাব্বি। সিপ্পির বাকি গল্প আপনারা পেয়ে যাবেন ভ্রমণ কথামালা-১ এ।
এত আজাইরা প্যাচালের পিছনে একটাই কারণ টিওবি কিভাবে আর কি জন্য তৈরি হয়েছে সেই কথা বলা। ২০০৭ এর সাথে আজকের ২০২০ তুলনা চলে না। তখনকার যে লক্ষ ও উদ্দেশ্য নিয়ে টিওবি তৈরি হয়েছিল আজ তা হয়ত তা পূরণ হয়ে গেছে। এখন ট্রেকিং বা ক্যাম্পিং খুব সাধারণ ব্যাপার। খোঁজ করলেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় আউটডোর ইকুইপমেন্ট। গত একযুগে বাংলাদেশে ট্র্যাভেলিং লোকেশন এক্সপ্লোর হয়েছে অনেকগুণ। আমরা পরিচিত হয়েছি অনেক রকম আউটডোর অ্যাকটিভিটির সাথে। এখন বৃহস্পতিবার রাতে বাস স্টান্ডে দাঁড়ালে বড় বড় হেভারস্যাক কাঁধে, তাঁবু হাতে দেখা যায় অনেক মানুষকে। নির্ভরযোগ্য তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। পার্বত্য অঞ্চলে গেলেই কিডন্যাপ হয়ে যাবার জুজু বুড়ি আর নেই বললেই চলে। ২০০৭ এ বসে আমরা এই স্বপ্নটাই দেখতাম। আর এই স্বপ্ন থেকেই আমাদের যাত্রা। এক যুগ, কম সময় নয়। আমি কখনই বলব না এর পুরোটাই টিওবির অবদান। কিন্তু বাংলাদেশের ট্র্যাভেলিং এবং আউটডোর অ্যাকটিভিটির যাত্রায় গত এক যুগ ধরে এই সংগঠনটি সামান্য হলেও অনুঘোটক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
এই যাত্রায় আমরা যেমন পেয়েছি মানুষের ভালবাসা আর উৎসাহ, ঠিক তেমনি টিওবির নামে আছে একটি বড় অভিযোগ। টিওবি তথ্য উন্মুক্ত করে বিভিন্ন জায়গার পরিবেশের ক্ষতি করেছে।
হ্যাঁ, এটা সত্যি ২০০৭ এ ঘুরে আসা কোন জায়গায় ২০২০ এ আমরা গিয়ে হতাশ হই। কিন্তু একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, আমরা কি আসলেই কোন কিছু গোপন করার ক্ষমতা রাখি? এখানে প্রকাশ না পেলে এই তথ্যগুলো অবশ্যই অন্য কোথাও প্রকাশ পেত। উদাহরণ স্বরূপ বলি রাতারগুলের কথা। হাম্মামের ঘটনার পর টিওবির চেষ্টা ছিল নতুন কোন জায়গা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে যাতে প্রকাশ না পায়। তারপর দেখা গেল জাতীয় পত্রিকাগুলো রাতারগুল, নাফাকুমের মত জায়গাওগুলো নিয়ে চমৎকদার প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করল।
আমার মতে ২০০৯ এর শেষ থেকে গ্রুপের ওয়াল পুরোপুরি এর সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১২ এর পর থেকে গ্রুপের অ্যাডমিনদের বড় এক অংশ প্রায় নিস্ক্রিয়, বাকি অ্যাডমিন এবং মডারেটররা গ্রুপের ওয়াল পরিষ্কার রাখতেই ব্যস্ত ছিল। ফেইসবুক যেখানে এই সময়ের সবচেয়ে বড় বিপনন যন্ত্র সেখানে গত একযুগে টিওবি একটা কথা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে যে এটি কারো কাছে কখনোও বিক্রি হয়নি, যদিও তার অনেক লোভনীয় সুযোগ ছিল। আমরা শুধু এই গ্রুপের ওয়ালের ঝারুদার । একটা জিনিষ খেয়াল করলে দেখবেন এই গ্রুপটি কখনও কোন ব্যক্তি কেন্দ্রিক ছিল না। আর এই লম্বা সময়েই এর অ্যাডমিন মডারেটর প্যানেলে কি পরিমাণ রদবদল হয়েছে। মজার কথা এই মুহূর্তের বেশিরভাগ মডারেটরকে আমি চিনিই না।
টিওবি শুধু কিছু বেসিক নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিত ও আউটডোর একটিভিটিকে জনপ্রিয় করার লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাবার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে গেছে। কিন্তু গ্রুপ কিন্তু এগিয়েছে এবং টিওবির পরিচয় তাই হয়েছে তার সদস্যদের কার্যক্রমের ভিত্তিতে। যেহেতু গ্রুপের প্রাথমিক লক্ষ অনেক আগেই পূরণ হয়ে গেছে, তাই আমরা মাঝে মাঝে ভাবি গ্রুপটাকে বন্ধ করে দিতে। কিন্তু কিছু পাগলের ভালবাসার জন্য তা আর হয়ে উঠে না। কিন্তু হয়ত একদিন বন্ধ হয়ে যাবে এই গ্রুপ বা নতুন কোন লক্ষে এগুবে এর কার্যক্রম, আর তা নির্ভর করছে এর সদস্যদের উপর।
এখান থেকে শুরু টিওবি, আর আপনারা অনুরোধ করলে মেহেরুন, রাব্বি, ফয়সাল, সালেহীন, মৃদুল, শরীফ বা অন্য কেউ আপনাদের শোনাবে সিপ্পি অভিযান পরবর্তী ঘটনা আর তাদের টিওবি ভাবনা।
আমি অন্তত অপেক্ষায় রইলাম…
পুনশ্চঃ জানি অনেক কিছু বলা হয়নি। কিন্তু এতটুকু লিখতেই সব তেল বের হয়ে গেছে। যদি কখনো পারি বলা হবে আবার, না হলে থাক … কি আর লাভ …।
লেখক: জামান রাহাত খান
moddhobitto poribarer sontander ghuraghuri ekhono oporadher chukhe dekha hoy.