এই লেখাটা আমার অতি পছন্দের একজনকে নিয়ে। মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম। ভাইয়ার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় বাংলামটর ‘সেইফ’ এর অফিসে। ২০১৪তে মনেহয়। বান্দরবানে একটা মাউন্টেইন বাইক রেস আর ম্যারাথন হবে। সেই ইভেন্টের আগে। বান্দরবানের সেই রেসে সে সবার শেষে শেষ করেছিলো। আসলে তাকে পেছনেই থাকতে বলা হয়েছিলো। কোনো সাইক্লিস্টের কোনো এমার্জেন্সিতে হেল্প লাগলে বা রেস্কিউ করতে। তখন অবশ্য আমি জানতাম না এটা। রেস শেষ হওয়ার পর রাতে কোনো একসময় আমি ভাইয়ার পাশে বসে ছিলাম। জিজ্ঞেস করি, আপনি সবার শেষে আসলেন যে? ভাইয়া তখন বলেছিলো, ‘আমি এমনিতেই চালাই সাইকেল। রেস করিনা।’ এরপর তার সাথে আরেকবার মাউন্টেইন ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখা হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।
ফেইসবুকে আমিই এ্যাড করি। ওখান থেকেই উনার ব্লগ পাই। একটা দুইটা করে পড়া শুরু করি। উনার লেখার ধরণ খুব ইন্টারেস্টিং। খুবই আলাদা। মজা পেয়ে যাই। পড়তেই থাকি। লেখায় অযথা, অপ্রযোজনীয় রেফারেন্স বা উপমার ব্যবহার নেই। নিজেকে খুব জ্ঞানী প্রমাণ করার প্রবণতা নেই। সব বিষয় নিয়ে উনার সহজ সরল স্বীকারোক্তি। যা ভাবছেন তাই সহজভাবে লিখছেন। কিছু লেখায় আবার অনেক মজার মজার টুইস্ট আছে। উনার ছোটবেলার স্মৃতিচারণমূলক লেখাগুলো সবথেকে মজার। উনার লেখা পড়ে পড়েই আমি কতজায়গা আর কতজনকে যে চিনেছি।
ভাইয়া আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে আহমদ ছফার লেখা পড়েছি কিনা। বলি, পড়বো পড়বো করেও শুরু করিনি। সে আমাকে আহমদ ছফার ‘গাভি বৃত্তান্ত’ বইটা কিনে দেয়। এই বইয়ের পটভূমি ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ি। তো আমি খুব ভালোভাবে রিলেট করতে পারছিলাম ঘটনাগুলো। এরপর থেকে আহমদ ছফার লেখার বিরাট ভক্ত হয়ে যাই।
‘মেঘদল’ ব্যান্ডের নেফারতিতি, ওম গানগুলো নিয়ে তার ব্লগ ছিলো। মেঘদলের ভোকাল শিবু কুমার শীলকে নিয়েও। মেঘদলের গান আগে রেডিওতে শুনতাম। ব্লগ পড়ে ওদের ২টো এ্যালবামের সবগুলো গান ডাউনলোড করে শুনতে শুরু করি। এখনও আমি প্রতিদিন মেঘদল শুনি। একবার হলেও।
তার অনেক ব্লগ পড়ে আমি অনেকদিন কেঁদেছি। ভাবতাম আর পড়বোনা এর লেখা। আবার অনেক লেখা আছে যেগুলো পড়ে হো হো করে হেসে ফেলতাম। ইনি আরেকটা ইন্টারেস্টিং কাজ করেন। সেটা হলো ফেইসবুকে প্রায়দিনই বাংলা সন, তারিখ আর মাসের নাম দিয়ে স্টেটাস দেন। এর কারণ নিয়েও একটা ব্লগ আছে।
সে এমনিতে খুব কম কথা বলে। আসলে কম বলেনা, অনেক মানুষের মাঝে থাকলে সে চুপচাপ সবার কথা শোনে। কিন্তু তাকে একা পাওয়া গেলে খুব মজার ব্যাপার হয়। তখন সে কথা বলতেই থাকে। যখন কথা বলে তখন অনেক মজার মজার তথ্য জানা যায়। তার সাথে যদি কখনও দেখা হয় তখন আমি হা করে তার গল্প শুনতে থাকি।
ব্লগ থেকেই জানতে পারি যে সে ২০১০ সালে সাইকেলে ৬৪জেলা ঘুরেছে। এই ভ্রমণের কিছু কিছু লেখা সে ব্লগেও লিখেছে। আমি যখন ৬৪জেলার লেখা পড়তাম তখন নোটবুকের একটা ম্যাপের ওপর দাগ কেটে রাখতাম। সে কোন জেলা থেকে কোন জেলায় যাচ্ছে। এই লেখাটা আমাকে সবথেকে বেশি অবাক আর ইন্সপায়ার করে। কিভাবে একটা মানুষ চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা সাইকেল নিয়ে হঠাৎ দেশ দেখতে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে অবশ্য তার বেশ কিছুদিন প্ল্যান করতে হয়েছিলো। টাকাপয়সা যোগার করতে হয়েছিলো। এই পুরো ব্যাপারটা আমার মনে খুব করে দাগ কাঁটে। ভাইয়ার লেখা পড়তে পড়তে আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম আমি কত লাকি আমি এমন একজন ইন্টারেস্টিং মানুষকে সত্যিকারে চিনি।
মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম আপনার বই কবে বের হবে ৬৪জেলার। তো বইটা শেষমেশ বের হয়েছে এবছরের বইমেলায়। আগামী প্রকাশনী থেকে। বইমেলার ২য় দিনই আমি বইটা উপহার পেয়ে গেছি আমার আরেকজন অতি প্রিয় মানুষ Shohag ভাইয়ার কাছ থেকে। আমি আরেক কপি কিনবো আমাদের লাইব্রেরিতে রাখার জন্য।
আজকে বইটা পড়া শুরু করেছিলাম। বইয়ের শুরুতে লেখকের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জায়গায় আমার নাম দেখে একটা বিরাট বড় ধাক্কা খেয়েছি!! কারো বইতে বিশেষ করে এই বইটাতে আমার নাম কখনও থাকবে এটা মোটামুটি আমার কাছে একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা এবং একইসাথে অত্যন্ত খুশির।
ভাইয়া মাঝে একবার ফেইসবুকে লিখেছিলো সে নতুন সাইকেল কিনবে, টাকা দরকার, তাই পুরোনো ২টো সাইকেল বিক্রি করবে। তার মধ্যে ৬৪জেলার সেই সাইকেলটাও আছে। আমি কমেন্ট করেছিলাম এটা কেনো বিক্রি করবেন। এটা আপনার বাচ্চাকাচ্চাদের দেখানোর জন্য হলেও রেখে দেওয়া উচিত। যাইহোক শেষে আমি কিনে আমার কাছে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জানতে পারি আরেকজন সাইকেলটা নিতে চেয়েছে। এরপর জোড়াজুড়ি করতে থাকি। শেষমেশ আমিই সেটার মালিকানা পেয়ে যাই।
আসলে কিন্ত আমি অনেক দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যান থেকে এটা কিনেছি। মানে ভাইয়া যখন বিরাট বড় সেলিব্রিটি হয়ে যাবে (এখনও বিরাট বড়, আরো বিরাট বড়!), যখন এই সাইকেট ট্যুর নিয়ে অনেক অনেক গল্প সিনেমা নাটক তৈরি হবে, তখন আমি এই সাইকেল নিলামে তুলবো এরপর এটা বিক্রি করে অনেক বড়লোক হয়ে যাবো
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯