কৃষ্ণ গহ্বর

আমি প্রচুর স্কুল পালাতাম। জীবনে প্রথম স্কুল পালাইছিলাম তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে। আমি সর্বচ্চো স্কুলে গেছি চতুর্থ শ্রেণিতে। সারা বছরে মাত্র ১২ দিন অনুপস্থিত ছিলাম। আর ক্লাশ নাইনে এসে সব মিলিয়ে মনে হয় ১২ দিন ক্লাশে ছিলাম। তাও ঐ ১২ দিন ছিল বিশেষ বিশেষ কারণে। নাম ডাকার ক্লাশ ছাড়া অন্য ক্লাশ করি নাই। প্রথম ক্লাশের পরে টিফিনের আগে আরো দুইটা ক্লাশ হইত। সেই দুইটা ক্লাশ আমি কোথায় ছিলাম? টয়লেটে বসে থাকতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা ছোট টয়লেটে বসে থাকা দাঁড়িয়ে থাকা। কি অদ্ভুত না? এই রকম কত যে উল্টাপাল্টা কাজ করছি, হিসাব ছাড়া। কেন করতাম জানি না। টয়লেটে বসে বসে কি করতাম? নানা রকম গল্প বানাতাম। তখন থেকেই কল্পনায়। আমার কল্পনার দুনিয়ায় এত এত গল্প ঘুরাফেরা করে। প্রতিটা চরিত্র জীবন্ত, প্রতিটা চরিত্রের সাথেই আমার পরিচয় আছে। কিন্তু লিখে উঠা হয় না আর।
আমি অনেক বছর পরে এসে আবিষ্কার করেছিলাম আমার ধৈর্য্য আর চিন্তা করা সবই আসছে ঐ স্কুলের টয়লেট থেকে। কিছুক্ষণ বসে থাকতাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা সেটা চিন্তা করতে করতে অপেক্ষা করতাম স্কুলের ঘণ্টার জন্য। এটা একটা নেশার মতো। আমি তখন বেশির ভাগ সময়ই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বিশেষ করে সেকেন্ডর কাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। এই কাটাটা থামে না, চলতেই থাকে। এক সময় আবিষ্কার করলাম যন্ত্রটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে একটা ধাক্কা দেয়। ঐখানে মনে হইল কাটাটা কিছুক্ষণ বেশি থামে। থমকে যায়। কাটাটা আরেকটা ধাক্কা দিয়া দিয়া চলতে থাকে। সব জায়গা এক সেকেন্ড থাকলেও নির্দিষ্ট জায়গায় এসে কাটাটা সম্ভবত দেড় সেকেন্ড অপেক্ষা করতো। এই সেকেন্ডের কাটার মতো জীবনে অনেকবার অনেক সময় আসছে আমার পুরা পৃথিবীটাই থমকে আছে। একটুও আগাচ্ছে না। আমি তখন নিচের দিকে নামতে থাকে। শূন্যে নামাটা কিসের সাথে তুলনা করবো বুঝতেছি না। দশ-তলা বিশ-তলা বিল্ডিংয়ের সাথে এটা তুলনা করা যাবে না, কারণ এর শেষ নাই অসীম। কৃষ্ণ গহ্বরের সেই অসীম গর্তটার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
ঘড়ির কাটাটার ধাক্কার মতো আমিও একটা ধাক্কা খেয়ে আবার জেগে উঠি। কল্পনার কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বের হয়ে আসি। তাকিয়ে দেখি চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলো। এই আলোর সাথে স্বাভাবিক হতে আমার অনেকটা সময় লাগে।
২৭ কার্তিক ১৪২৯

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.