পথ

মোহাম্মদপুরে থাকা অবস্থায় মোটামুটি প্রতিদিনই অফিসে হেঁটে আসা-যাওয়া হতো। করোনা আর মোহাম্মদপুর ছাড়ার পরে অনেকদিন বাসাতেই কাজ করার কারণে বন্ধ ছিল এই রুটিনমাফিক হাঁটাহাঁটি।
বছর দেড়েক হলো প্রতিদিন দুইবার করে অফিস-বাসা আসা-যাওয়া করা লাগতেছে। একই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়ার কারণে অনেকগুলা পরিচিত মুখ তৈরি হয়েছে। কিন্তু কারো সাথেই কথা হয় না। কেউ হয়তো আমাকে ঐভাবে লক্ষ্যও করে না। কিন্তু আমি খুবই মনোযোগসহকারে এই পরিচিত মুখগুলাকে দেখি। অনেকের হাঁটার স্টাইল মুখস্থ হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখেই বলে দিতে পারি কে আসতেছে। কিন্তু কারও নাম জানি না। শুধুমাত্র দূর থেকে হাঁটার স্টাইল দেখে মনে মনে বলতে পারি।
অনেকের পোষাকও মুখস্থ হয়ে গেছে। কারণ এই দেড় বছরে মানুষগুলার সাথে কমপক্ষে ৪০০/৫০০ দিন দেখা হয়েছে। সবার তো আর ৪০০/৫০০ জামাকাপড় থাকতে পারে না। তাই পোষাকও পরিচিত অনেকেরই। পরিচিত প্রতিটা চরিত্র নিয়েই আলাদা আলাদা লিখবো।
আজকে একটা দুঃখজনক আশঙ্কা নিয়ে লিখতেছি। সকালে যখন অফিসে আসি একটা নির্দিষ্ট সময় লেকের ব্রিজে একটা কাপলের সাথে দেখা হইত। উনাদের বয়স ৭০ এর বেশি। দুইজনই খুব ধীরে হাঁটেন। আঙ্কেল সামনে আন্টি পেছনে। দুইজনের পায়েই হকি সু। আন্টি বোরখা পরে থাকেন কিন্তু মুখ ঢাকা থাকে না। আঙ্কেল শার্ট আর প্যান্ট পরা, শার্ট সব সময় প্যান্টের ভিতরে ঢুকানো থাকে যেটাকে আমরা ইন করা বলি। আঙ্কেলের হাতে একটা মোবাইল থাকে, মোবাইলে সব সময় লাউড স্পিকারে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজতে থাকে। উনারা গান শুনতে শুনতে হাঁটেন।
উনাদের দেখার পর থেকেই গান শুনতে থাকি আমাকে ক্রস করে যেতে যেতেও এর রেশ থাকে। আমিও হ্যাডফোন দিয়ে সবসময় গান শুনতে শুনতেই হাঁটি। কিন্তু উনাদের দেখলে আমার হ্যাডফোন খুলে ফেলি। উনাদের গানগুলা শুনতে কেন জানি খুবই ভালো লাগে।
পরবর্তীতে আমি নিজেও নিজের মোবাইলে সেই একই গান শোনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনদিনই আমার কাছে কেন জানি ভালো লাগে নাই। শুধু উনাদের ফোনেই কেন জানি শুনতে ভালো লাগতো। অথচ আমার হ্যাডফোন খুব খারাপ ন মোটামুটি ভালো। আমি সব সময় হ্যাডফোনের বিষয়ে খুব খুতখুতে। সাউন্ড আমার ভালো লাগেই। সেটা হ্যাডফোন হোক আর স্পিকারই হোক।
আমি বেশ কিছুদিন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। ধরে নিয়েছি এটাই নিয়তি। আমার হেডফোনে অথবা মোবাইলে ভালো লাগবে না। অফিসে এসে এমনকি বাসায় গিয়েও একই গান শোনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ ভালো লাগাটা আর আসে নাই। সম্ভবত এইটা আশেপাশে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার সময় ছাড়াও ছুটির দিনেও একটু হাঁটতে বের হই ঠিক ঐ সময়। একই পথে হাঁটার জন্য। কারণ দুইটা ঘরে ভালো লাগে না, হাঁটতে ভালো লাগে। আর এই পরিচিত মানুষগুলা তো আছেই।
গত দুই/আড়াই মাস যাবত লক্ষ্য করতেছি। এই কাপলকে আমি আর খুঁজে পাচ্ছি না। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছি। ঐ একই সময়ে যেখানে দেখা হতো সেই ব্রিজের উপর ১০/১২ মিনিট অতিরিক্ত সময় দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিন্তু উনাদের আর দেখা পাই নাই। উনারা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, দুইজনের একজন হয়তো পৃথিবীতে নাই। তাই এই পথে আর আসতেছেন না। তা না হলে এতদিন অনুপস্থিত থাকবে কেন? হয়তো এমন হয়েছে ২/৩ দিন দেখা হয় নাই। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় দেখা হয় নাই এমনটা কখনো হয় নাই।
আজ সারাদিনই মাথা থেকে এই বিষয়টা বের হচ্ছে না।
২৭ ফাল্গুন ১৪৩০

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.