আমাদের পুরাতন বাসা

আমাদের এক বড় ভাই আছেন ইমরান জাহান। উনার মাধ্যমে পরিচয় হইছিল মোহাম্মদপুরের শফিক ভাইয়ের সাথে। শফিক ভাই পেশায় হোমিও ডাক্তার। পাশাপাশি আমাদের নরসিংদীর একই থানায় বাড়ি। শফিক ভাইয়ের সাথে পরিচয় প্রায় ৪/৫ বছর হয়ে গেছে বা আরেকটু বেশিও হতে পারে। আমরা উনার কাছ থেকে নানারকম পরামর্শ নিয়ে থাকি, বলা যায় তিনি আমাদের ছোটখাট অসুখবিসুখের পারিবারিক ডাক্তার। তার সাথে কোন একটা কাজে গেলেও দেখা গেছে গল্প করতে করতে ১ ঘণ্টা চলে গেছে খেয়াল নাই।

আজ অনেকদিন পরে তাঁর কাছে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। বাসা থেকে বের হয়ে, তল্লাবাগ, সোবহানবাগ, লালমাটিয়া দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই পথে ৩৯ মাস ২১ দিন আগে নিয়মিত একা একা হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতাম রাতে। করোনার লকডাউন বাদ দিলে ৬/৭ বছর হবে। তারও আগের হিসাব করলে লালমাটিয়ার সেই রাস্তা মাঠের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় ১০/১২ বছর হবে।

প্রায় প্রতিদিনের রুটিন ছিল অফিস থেকে নীলক্ষেত/কাটাবন তারপর রাজাবাজার হয়ে এই পথে বাড়ি যাওয়া। এতদিন পরে একই পথে যেতে যেতে অনেক পুরানা দিনের কথা সামনে আসতেছিল। এক সময় লালমাটিয়ার রাস্তা ব্লক-এ এর ৫/২ নাম্বার বাসায় কাজ করতাম, এই ঠিকানাতেই আমার প্রথম পাসপোর্ট করা। মাঝে মাঝে থাকতামও সেখানে আর সুরাইয়া ওর হোস্টেল থেকে মাঝে মাঝে খাবার দিয়ে যেত লুকিয়ে। একবার কি এক তরকারি আনছিল, আলম ভাই দেখে ফেলছিল কিভাবে যেন, তারপর লুকিয়ে গিয়ে একটু খেয়ে ফেলছিল। এর পরে যে কত বছর সুরাইয়াকে বলছে একদিন গরুর মাংস খাওয়ানোর জন্য তার কোন হিসাব নাই। ফেসবুকে সুরাইয়ার কোন পোস্ট দেখলেই ঐখানে কমেন্টে গিয়ে মনে করিয়ে দিত।

জাকির হোসেন রোডে বাসা নেয়ার পরে আমরা মাঝে মাঝে লালমাটিয়া মাঠে আসতাম ফুচকা খেতে। সুরাইয়া ফুচকাওয়ালার সাথে কথা বলতে বলতে ফুচকাওয়ালা মামার কত খবর যে নিয়া নিছিল। আমরা একজনের দোকানেই খেতাম সব সময়। এই লোক ফুচকা বিক্রি করে বসিলাতে জায়গা কিনে ফেলছিল। সুরাইয়া বলতো জীবনে কিছুই করতে পারলি না এতদিন ঢাকায় থেকেও।

এইসব পুরানা কথাবার্তা চিন্তা করতে করতেই যাচ্ছিলাম মোহাম্মদপুরের রাস্তা ধরে। চিন্তা করতেছিলাম আমাদের ঐ ভাঙ্গা বাসায় কে কে আসছিল? কাউকেই আমরা আনতে চাইতাম না। তারপরেও লিস্ট ধরলে অনেকেই আসছিল। চট্টগ্রাম থেকে একবার সাকিব আসছিল, টিওবির আজিজ উল্লাহ ভাই আসছিল মনে হয়। সুরাইয়া ছিল না তখন বাহার ভাই আর শাহাদাত ভাই আসছিল। করনোর সময় সম্ভবত একবার তুষার ভাই এসে হাজির হইছিল। ছাদে বসে কত গল্প করছিলাম।

ঐ বাসায় আমাদের অনেক কষ্টই করতে হইত। বেশি টাকা ভাড়া লাগবে তাই আমরা একটা ভালো বাসায়ও যেতে পারতাম না। বৃষ্টিতে ঘরের ভিতরে পানি পড়তো অনেক, শীতের সময় সুরাইয়া পায়ে মোজা, কান টুপি, শীতের যত কাপড় আছে সব পরে একদম জুবুথুবু হয়ে থাকতো। আমি বলতাম কার্টুনের মতো লাগতেছে। বাসায় ফেরার পরে খাওয়ার পরপরই সুরাইয়া ঘুম দিত। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতাম, সুরাইয়ার ঘুমানোর পরে আমি উঠে কাজে বসতাম। ভোরে উঠে সুরাইয়া ঘরের সব কাজ শেষ করে ফেলতো, পড়াশোনা আমার জন্য খাবার রেডি করা সব। আমি ঘুম থেকে উঠেই কোনরকমে হাত-মুখ ধুয়ে তারপর অফিসে ছুটতাম। প্রতিদিনের রুটিন এমনই ছিল।

আমি যখন রাস্তায় একা একা হাঁটতে থাকি তখন দেখা যায় এসব কিছুই মাথায় আসে। অনেক সময় কল্পনায় নানা রকম ফ্যান্টাসিতেও চলে যাই। হয়তো অপরিচিত কোন এক গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতেছি, পাখি দেখতেছি। বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখতেছি। আবার আজ এমনও ভাবতেছিলাম, আমরা লালমাটিয়া মাঠে বসে আছি। ফুচকার অর্ডার দিয়ে বসে আছি, ফুচকা আসলে খাবো, সত্যবতী মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতেছে। এই যে কল্পনা করতে পারতেছি, কল্পনায় অনেক সুন্দর সুন্দর সময় কাটাতে পারতেছি। হয়তো এত এত মানুষিক সমস্যার মধ্যেও এই কল্পনার করতে পারার কারণেই বেঁচে আছি। নিজের একটা জগতে ঢুকে গিয়ে সকল তিক্ত বিষয়গুলা ভুলে যাই কিছুক্ষণের জন্য। বেশিক্ষণ ভুলে থাকা যায় না, একটু পরেই আবার জেগে উঠতে হয়।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন আমার যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, জাকির হোসেন রোডের মাঠের পাশ দিয়ে সেখানে না ঢুকে আমি আমাদের পুরানা বাসার রাস্তায় ঢুকে গিয়েছি। একদম বাসার গেটের কাছে এসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবিও বের করেছি, তালায় হাত দিতে যাব তখন মনে পড়লো আমি তো শফিক ভাইয়ের কাছে যাচ্ছিলাম। এখানে আসলাম কিভাবে?

এখন কাজের কারণে যে বাসাটায় থাকতে হচ্ছে সেটা অনেক ভালো বাসা। টাইলস করা, আধুনিক সুযোগসুবিধা অনেক কিছুই আছে। অনেক টাকা ভাড়া, আরামের জায়গা। কিন্তু আমি জানি এটা আমার বা আমাদের বাসা না। এইটা আরেকজনের বাসা, এখানে কিছুদিনের জন্য থাকতে আসছি। আমাদের সেই পুরানা ভাঙ্গাচোরা বাসাটায় যে শান্তি ছিল, সেটা অন্য রকম। ঐ শান্তি এই আধুনিক অন্যের বাড়িতে নাই। একটু দেরিতে বাসায় ফিরলেও, ভাড়া বাসা হলেও মনে হতো নিজের বাসাতেই যাচ্ছি। শত সমস্যার মধ্যে নিজের বাসা, নিজের স্বাধীনতা।

৬ চৈত্র ১৪৩০

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.