যে লেখার শিরোনাম নাই

cropped-cropped-DSC00553.jpg

এই অল্প জীবনে অনেক জায়গায় অনেক রকমের কাজের অভিজ্ঞতা। বিস্তারিত লিখলে হয়তো একটা বই লেখা যাবে। হয়তো সময় সুযোগ হলে একদিন লিখেও ফেলবো। আজকে শুধু সামান্য লেখার চেষ্টা করছি অনেকটা সূচিপত্রের মতো। কাজের হয়তো অনেক রকম ব্যাখ্যা আছে। আমরা যা করি তাই কাজ। আমি আমার জীবনের সেইসব কাজের কথা বলছি, যেসব কাজ করে অর্থ উপার্যন করেছি করছি কখনো নিজের প্রয়োজনে কখনো পরিবারের প্রয়োজনে।

আমার জন্ম নাখালপাড়াতে। তখন পরিবারে ভয়াবহ দুঃসময় চলছে। বয়স নয় কি দশ বছর হবে। পড়তাম তৃতীয় শ্রেণিতে, যদিও বেতনের অভাবে খাতা থেকে নাম কেটে দিয়েছিলেন স্যার, তারপরেও বেশ অনেকদিন আমি স্কুলে গিয়েছি, নাম ছাড়াই স্কুলে সবার সঙ্গে বসে থাকতাম। প্রথম সাময়িক পরিক্ষার সময় থেকে আর যাওয়া হয়নি।

নানার বাড়ি থেকে এক দূরসম্পর্কে এক মামা আসলেন ঢাকায়। থাকেন আমাদের বাসাতেই, নাখালপাড়া বড় মসজিদের সামনে বসে কলা বিক্রি করেন। আমাদের বাসায় থাকার বিনিময়ে প্রায়ই কখনো নিজের টাকায় কখনো আমাদের টাকায় বাজার করে দিতেন। আমার কাজ ছিলো প্রতিদিন রাতে ৭/৮ টার দিকে মসজিদের সামনে যেয়ে ৩০ মিনিট বা ৪৫ মিনিটের জন্য কলা বিক্রি করা। আমি যতক্ষণ রেললাইনের সামনে বসতাম ততক্ষণে মামা বাজার করে নিয়ে আসতেন। সম্ভবত এটাই ছিলো আমার জীবনে প্রথম কাজে ঢোকা।

এর পরে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করলেও পরবর্তী তিন বছর স্কুল থেকে দূরে ছিলাম। অর্থাৎ আমি ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি কোথাও পড়ি নাই। এই তিন বছরে আমি কাজ করেছি পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জায়গায় যেমন, কয়েকদিন একটি টেইলার্সে কাজ করেছি। কাজ করেছি গার্মেন্টসে, সেটা ছিল অল্প কয়েকদিনের জন্য। ইলেক্ট্রনিক দোকানেও কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে বেশ কিছুদিনের জন্য। পান খাওয়ার জর্দ্দা বিক্রি করেছি ফেরি করে বিভিন্ন দোকানে। পাড়ার সিডি/ভিসিডির দোকানেও কাজ করতে হয়েছে। আমার কাজ ছিলো বাসায় গিয়ে সিডি/ডিভিডি সংগ্রহ করা। ২/১ দিন ব্যানার লেখার কাজও করেছি সহকারী হিসাবে। রাজনৈতিক ভাবেও টাকার বিনিময়ে মিছিলে গিয়েছি। সারা রাত ধরে পোস্টার লাগিয়েছি। এই সবই ছিলো বিচ্ছিন্নভাবে টাকার বিনিময়ে কাজ করা। জীবনের প্রয়োজনে। কখনো কখনো পরিবারের প্রয়োজনে।

পরবর্তী ২/৩ বছর আবার পড়ালেখায় ফিরে আসলাম। কিন্তু সেই সুযোগও বেশিদিন হলো না। হঠাৎ করেই মা মারা গেলেন। বাবা আমাদের দুই ভাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। একদিন বলেও দিলেন, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে, এবার তোমাদের পথ তোমাদেরই দেখতে হবে। শুরু হলো নতুন পথ চলা। বিভিন্ন জায়গায় কাজ খুঁজছি, এলাকার এক বড় ভাই বাবলু ভাইয়ের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটা কাজ পেলাম, ভলেন্টিয়ারি কাজ। কেন্দ্রের সেই প্রোগ্রামের নাম ছিল বই পড়া কর্মসূচি। একদিন কাজ করলে পেতাম ২৫ টাকা। তাঁরা বলে দিতো এটা ভলেন্টিয়ারি কাজ, যে টাকা দেয়া হচ্ছে সেটা আসা-যাওয়া ভাড়ার জন্য। কিন্তু সেই টাকাটা ছিলো আমার জন্য ভাত খাওয়ার টাকা। এই কাজ করতে করতেই এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের দোকানে কাজ পেয়ে গেলাম, দোকানটি ছিলো মোবাইলের দোকান মানে বিভিন্ন কম্পানির মোবাইল কার্ড বিক্রি করতো, লোকজন মোবাইল ফোনে কথাও বলতো তিন টাকা মিনিটে। তখন ব্যক্তিগত মোবাইলের মিনিট ছিলো সম্ভবত সাত টাকা। আমার বেতন ছিলো তখন ১০০০ টাকা। এক বছর কাজ করার পর একটা সমস্যার কারণে কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।

এরপর শুরু হলো আমার নতুন দুঃসময়। চাকরি নাই, টাকা নাই। টাকার অভাবে বাসা ছেড়ে দিলাম। সারাদিন একবেলা খাই, সেটা রাতে, খালি পেটে ঘুমানো কঠিন। থাকি লাইব্রেরীতে, ছোট ভাই থাকে ওর এক বন্ধুর দোকানে। লাইব্রেরীতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চিশ্তি ভাই। লাইব্রেরীতে কোন টয়লেট নাই। টয়লেট করতে হয় পাসের মসজিদে। সমস্যা হয় রাতের বেলা, রাতে মসজিদের গেট বন্ধ থাকে, দেয়াল টপকে গিয়ে টয়লেট করতে হয়। সবসময় যে এক বেলা খেতে হয়েছে তা না, মাঝে মাঝে চিশতি ভাই তাঁর বাসায় দুপুরে ডেকে নিয়ে খাওয়ায়, কখনো কখনো শাহীন বাগে হাটতে বন্ধু বাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় জোর করে নিয়ে দুপুরে বাসায় খাওয়ায়। মোবাইলের দোকানে বসার সময় পরিচয় হয়েছিলো রোজি নামে একজনের সঙ্গে, আমাকে ভাইয়া ভাইয়া ডাকতো সেও প্রায়ই টিফিনকারিতে করে খাবার দিয়ে যেত। তখন মনে হতো জীবন অনেক সুন্দর। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মানে দুই বেলা ভাত খাওয়া। তিন বেলা না।

এভাবে দুই/তিন মাস যাওয়ার পর কাজ পেয়ে গেলাম এশিয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভায়, যাকে সবাই কাক বলেই ডাকত। কাকে ঢোকার পর জীবনটা অদ্ভূত ভাবে পরিবর্তন হয়ে গেলো। কাকে যখন প্রথম ঢুকলাম তখন বেতন ছিলো ১২০০ টাকা। কাজ ছিলো ঘর-পরিস্কার করা, লোকজনদের চা-নাস্তা দেয়া। সেখান থেকে কিভাবে কিভাবে রাসেল ভাইয়ের মাধ্যমে কম্পিউটারের কিছু কাজ শিখে ফেললাম। এর পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কাক-এ ঢোকার পরেও বেশ কয়েকবার বিচ্ছিন্নভাবে কাক ছেড়েছি, আবার কাক-এ ঢুকেছি। কাক ছাড়ার মাঝে যে কয়টা জায়গায় কাজ করেছি সেটার বর্ণনা হলো এমন, স্পেলবাউন্ডে প্রায় ৪ মাস, সলিমুল্লাহ স্যারের বাসায় প্রায় ৬ মাস, রাসেল ভাইয়ের বাসায় থিসিসের কাজও করেছি প্রায় ২ মাসের মতো। ফ্রি-ল্যান্সেও কাজ করেছি প্রায় ৬ মাসের মতো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ৬ মাস, সেইফ-এ ২ বছর, বর্তমানে ইউলেব ইউনিভার্সিটি প্রায় ৩ মাস হয়ে গেলো।

এছাড়া বিচ্ছিন্ন ভাবে যে সব কাজ করেছি, চাকরি থাকা অবস্থায় ফ্রি-ল্যান্সের মতো। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে হরলিক্স ফিউচার ফোর্স প্রোগ্রামে ২০ দিনের মতো। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে তিনটা বইয়ের কাজ করেছি। রাব্বি ভাইয়ের সঙ্গে পিক-৬৯ এর হোম ডেলিভারির কাজ, পিক-৬৯ এ গাইডের কাজ। আরো অনেক করেছি বিচ্ছিন্নভাবে।

আমার জীবনটা যুদ্ধের মতো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে হবে।

আজীবন সবার সামনে হাসিমুখ নিয়েই যেতে চাই।

Comments

comments

Comments

  1. মাঝে মাঝে পিছনে ফিরে তাকানো ভালো, জীবনটাকে বোঝা যায় ভালোভাবে। ভালো থাকো।

  2. Foysal

    Great write up. And a great story to tell. just keep fighting and smile , this is life. 🙂

  3. Humayra

    (y) ভাই! কিছু বলবার ভাষা নেই… অদ্ভুত একটা অনুভূতি খেলে যাচ্ছে বুকের ভেতর। অনেক অনেক দোয়া আর শুভ কামনা।

  4. mreedul

    you are a hero buddy .
    Hero hote lafay duniyay onek lok ase , kintu hero hote pare keu keu , for me u r already a hero and tumi jibone obossho e aro onek dur jaba … proud of u

  5. Muhammad Imran

    কিছু কিছু আগেও বলছিলেন আমাকে। পুরোটা শুনে অনেক বেশি চমতকৃত হলাম!

  6. মেহেরুন

    হাসিটুকু যেন এই রকমি থাকে সব সময়… 🙂

  7. আপনাদের মত বড় ভাই-বোনেরা আছেন বলেই আমি এগিয়ে যেতে পারছি সামনের দিকে। সঙ্গে থাকলে হয়তো আরো অনেক দূর যাব।

    সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

  8. Awal

    inspiring for people like me… lots of respect

  9. নতুন এক শরীফকে চিনলাম। বিনম্র শ্রদ্ধা তোমায় ভাই।

  10. শিশির

    আমি নিজের কিছুটা স্মৃতি শেয়ার করি।পড়াশুনায় প্রচুর টান আমার,তবে অর্থের কারনে তা করা হয় নাই।কিছু সময় বাবার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেছি,তবেই চাল কিনে রান্না করা হবে।কোন এক ঈদে আত্বীয়দের দেয়া পুরানো জামা পরে অনেক খুশি হয়েছিলাম।আজ আমার বা আমার পরিবারের অবস্থান অনেক ভালই।তবে হটাৎ যখন নিশ্চুপ থাকি,তখন বাবার সেই ফিরে আসার দিনের কথাটা মনে পড়ে যায়।
    তবে আপনার স্মৃতিগুলা বড্ড শক্তিশালী,অনেক আলাদা।আপনার জীবন সুন্দর এক গল্প,যে গল্প অন্যরা পড়ে শেষ করতে পারবে না।দোয়া আর ভালবাসা রইলো সুন্দর এই গল্পের ধারকের জন্য।

    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.