অনেক দামে কেনা, চিত্রা মহল, বৈশাখ

মিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতি হাবিজাবি অনেক বিষয় নিয়েই কথা হয়। অনেক অনেক কথাবার্তার মধ্যে অনেক অনেক পরিকল্পনাও করি। একবার চিন্তা করলাম আমরা তো প্রায়ই এখানে সেখানে ঘুরতে যাই। এখন থেকে ঘুরতে গেলে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় স্থানীয় সিনেমা হলে সিনেমা দেখব। আমাদের প্রথম মিশন ছিল কুয়াকাটায় কিন্তু সেখানে আমরা সফল হই নাই। সিমেনা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। গত দূর্গাপূজার ছুটিতে সিনেমা দেখায় আমাদের প্রথম সফলতা আসে দূর্গাপুর-বিরিশিরি ভ্রমণে। জারিয়া বাজারে ‘রিয়া’ সিনেমা হলে বহু বছর পরে একটা সিনেমা দেখলাম, নাম ‘রাজা বাবু’।

এরপরে টিওবির লাখের বাত্তিতে এক সঙ্গে গেলেও সিনেমা দেখার সুযোগ হয় নাই। বৈশাখে বড় ছুটি পেলেও কোথাও যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। দুই জনে মিলে একটাই পরিকল্পনা করলাম সিনেমা দেখার। ঢাকা শহরের মোটামুটি অনেক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। জীবনে প্রথম সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম গুলিস্তান হলে সেই হলও আজ বন্ধ। ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখেছি এমন অনেক হলও এখন বন্ধ। মিরাজ ভাইয়ের উপরই দায়িত্ব দিলাম সিনেমা হল খুঁজে বের করতে আমার ইচ্ছা পুরান ঢাকার যে কোন একটা হলে দেখতে পারলেই হইল।

মিরাজ ভাই পুরান ঢাকায় চালু আছে এমন কয়েকটা নাম ধরাইয়া দিলেন সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে এমন কয়েকটা হলের নামও। সব হলের নাম দেখে ‘চিত্রা মহল সিনেমা’ নামটা পছন্দ হইল। মিরাজ ভাইয়ের উত্তেজিত ম্যাসেজ, ‘হায় হায়, করছো কি? আর কোন সিনেমা হল পছন্দ হইল না? যদি কেউ দেখে এই হল থেকে সিনেমা দেইখা বের হইতাছি মান-সম্মান তো আর কিছু থাকবে না।’ মিরাজ ভাই পুরান ঢাকার বাসিন্দা ঐ দিকে মোটামুটি পরিচিত মানুষে অভাব নাই। তারপরেও মান-সম্মানের দিকে না তাকাইয়া এই হলেই সিনেমা দেখার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।

পহেলা বৈশাখে ঘুম থেকে উঠেই বনশ্রী, মিটিং-সিটিং শেষ করে যখন মিরাজ ভাইয়ের বাসায় পৌঁছাই তখন বারটা, হাতে অনক সময়। কিছুক্ষণ আড্ডা, বৈশাখী মিষ্টি আর কাঁচা আমের জুস খাওয়া। বের হয়ে কিছুক্ষণ শাঁখারী বাজারে ঘুরাঘুরি গণেশ পূজা দেখা তারপর ‘কল্পনা’ বোর্ডিংয়ে দুপুরে খাওয়া। তারপর হেঁটে হেঁটে চিত্রা মহলে পৌঁছালাম। ভিতরে ঢুকার আগেই আমরা পুরাই টাস্কি। নিজেই নিজেদের প্রশ্ন করলাম, ‘এত লোকজন কেন?’

‘অনেক দামে কেনা’ সিনেমার পোস্টার
‘অনেক দামে কেনা’ সিনেমার পোস্টার

মিরাজ ভাই তাঁর মোবাইল দিয়া ভিডিও করতে ব্যস্ত। পথে দুইজনে আলোচনা করছিলাম সাকিব খানের ছবি ছাড়া তো আর কোন ছবি নাই বাজারে। এর আগেও সাকিব খানের ছবি দেখছি। অন্য কোন সিনেমা হইলে ভাল হইত। আমাদের ভাগ্য ভাল হলের পোস্টার দেখে নিশ্চিত হইলাম সাকিব খান নাই। ডিপজল আর নতুন নায়ক-নায়িকা। অবশ্য পুরাতনও হইতে পারে, আমরা তো আর নিয়মিত ছবি দেখি না।

ভিতরে ঢুকে টিকেট কাটতে যাইয়া নতুন বিষয় আবিষ্কার করলাম। এখানে ডিসি, রিয়েল নাই। মানে আছে অন্য নামে। ডিসির নাম দেয়া হইছে সাগর। আর রিয়েলের নাম দেয়া হইছে ঝিনুক। আমরা সাগরের টিকেট কাটলাম, কাউন্টারে বসা বয়স্ক এক চাচা। কথা বেশি হইল না, মিরাজ ভাই মোবাইলে ভিডিও করতেছে এটা দেখে চাচা বিরক্ত। আমরা দ্বিতীয় তলায় উঠলাম। চারিদিকে লোকজন ভরা। কয়েকজনকে দেখা গেল পরিবার-পরিজনও নিয়ে আসছে কোলে তিন-চার বছরের বাচ্চাসহ। কিছুক্ষণ পরেই বারটার শো শেষে লোকজন বের হয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি সবার পরনেই বৈশাখী পোষাক। তরুণী-মহিলাদের সাজুগুজু ঘামের সঙ্গে মোমের মত গলে গলে পরছে। তারপরেও তাঁদের আনন্দ। মিরাজ ভাই ঘোষণা দিলেন এই হলে তিনি ক্লাশ নাইনে থাকতে শেষ ছবি দেখছিলেন।

সবাই লাইন ধরে ভিতরে ঢুকতেছে। সবারই বেশ তারা আমাদের কোন তারা নেই। এর মধ্যে তারাহুরো করে ঢুকার জন্য কেউ কেউ ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল। বরিশালের এক ছেলে বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল বরিশালের ভাষায় উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেচামেচি শুরু করে দিল। মারামারি লাগবে লাগবে ভাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত মারামারি বাঁধলো না। এর মধ্যে মিরাজ ভাই দর্শনার্থীদের মধ্যে একজনের ছোটখাট সাক্ষাৎকার নিয়ে নিলেন। বুঝা গেল সাকিব খানই সবার প্রিয় নায়ক।

টিকেট কেটে ঢোকার সময় কথা হইল টিকেট চেকারের সঙ্গে, নাম লিটন। প্রায় দশ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। আমরা ভিতরে ঢুকলাম সিনেমা শুরুর আগে দুয়েকটা বিজ্ঞাপন। হঠাৎ পর্দায় ছবি দেখে দুইজনেই চমকে উঠলাম। পর্দায় চার্লি চ্যাপলিনের ছবি ভেসে উঠল। ছবির পাশাপাশি চ্যাপলিনের ছোট্ট বায়োগ্রাফি ১৬ এপ্রিল তারিখ চ্যাপলিনের জন্মদিন, আগে জানতাম না। বলা যায় এটা আমাদের দুইজনের জন্যই চমক।

সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত। কানায় কানায় পূর্ণ সিনেমা হলে কেউ জাতীয় সঙ্গীতে দাঁড়ালেন না। শুধু আমরা দুইজন আর একজন দাঁড়ালেন। যথা সময়ে সিনেমা শুরু হলো। সিনেমা শুরুর পর পর আরো চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ঢোকানো হল। তাঁদের জন্য আলাদা চেয়ার। এই চেয়ারের নাম দেয়া হইল আলগা চেয়ার। এদের টিকেটের টাকাও কম। আমাদের জন্য চেকার ভাল দুইটা সিটই দিলেন। পাশাপাশি কোত্থেকে একটা বড় ফ্যানও দিয়ে গেলেন একদম আমাদের পাসেই সেই ফ্যান রাখা। এর আগে অবশ্য একজন এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছেন সম্ভবত হলের ম্যানেজার। তিনি সম্ভবত ভেবেছেন আমরা পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক। ভিতরে মেটামুটি গরম। সবাই মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখছে। প্রথমেই মারামারি দিয়ে সিনেমা শুরু। অর্ধেক সিমেনা পর্যন্ত আমরা কাহিনী কিছুই বুঝলাম না। শুধু মারামারি আর গান। মিরাজ ভাইয়ের ভাষায় ক্যামেরা ম্যান ক্লোজ শর্ট ছাড়া আর কিছু শিখে নাই। তবে গানের ভিডিওগ্রাফি বেশ ভাল। আমাদের ধারণা গানের শর্ট অন্য কেউ নিয়েছে।

অনেক দিন পরে সিনেমা দেখতে এসে খুব একটা খারাপ লাগল না। ডিপজলের প্রথম ছবি দেখেছিলাম ‘ভয়ঙ্কর বিষু’ গ্যারিসন সিনেমা হলে সেই সিনেমা হল এখন আর চালু নাই, বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দুইজনের বেশ আশ্চর্য লাগলো এতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা আসছে মায়েদের সঙ্গে। একটা বাচ্চাও কান্নাকাটি করলো না। বিরতীতে আমরা বের হলাম। চিত্রা মহলের দেয়ালে পুরানো কিছু ছবির পোস্টার দেখলাম। দেখতে বেশ ভাল লাগলো, মিরাজ ভাই কয়েকটা ছবিও তুলে নিলেন।

পুরনো সিনেমার একটি পোস্টার
পুরনো সিনেমার একটি পোস্টার

 

বিরতীর পরে আমরা আবার ঢুকলাম। আরো কিছুক্ষণ মারামারি আর গান দেখার পর আমরা কাহিনীতে প্রবেশ করলাম। পরিচালক খুব দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে আধা ঘণ্টায় পুরা সিনেমার কাহিনী বুঝিয়ে দিলেন। সিনেমার পুরাটাই গান আর মারামারিতে ভরপুর, কাহিনী খুবই সংক্ষেপ। আমরা যখন পুরা সিনেমা দেখে বের হই তখন বাইরে বের হয়ে দেখি দর্শক আরো দিগুণ। অনেকেই টিকেট পাবে না এটা নিশ্চিত। আমরা একরাশ বিস্ময় নিয়ে সিনেমা হল ত্যাগ করলাম।

.

০৪ বৈশাখ ১৪২৩

.

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.