তখনও পুরাপুরি অসামাজিক হই নাই। এলাকার মিলি খালাম্মার বিয়ের অনুষ্ঠান। মোটামুটি অনেক দায়-দায়িত্ব। বেশিরভাগ কাজই বন্ধু বাবুর উপর, সঙ্গে সঙ্গী আমি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে ভাড়া করা শুরু করে মোটামুটি অনেক কিছুই আমাদের দুইজনের হাত দিয়েই হইল। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য বাবু ৫/৭ দিন আগেই চেরাগআলী থেকে চলে আসছে।
সব কিছু আমরা করলেও কিছু কিছু কাজ হেলাল মামা করলেন। এর মধ্যে একটা আল্পনার কাজ। এলাকায় একটা পরিবার ছিল তিন বোন আর এক ভাইসহ এক পরিবার। তিন বোনের তিনটা নাম ছিল আমাদের দেয়া একাউন্টিংয়ে অনার্স (শ্যামা আপা), খারাপ আত্মার ডাইনী সারারা গুল (সাথী), গলা ছিলা মুরগি (বাণী)। এই ধরনের পিকুলিয়ার নামের কাহিনী আরেকদিন বলবো, তবে এঁরা আমাদের শত্রু ছিল। আর ভাইটার নাম ছিল সাহেদ। ভাইটা একটু বদ টাইপের ছিল বদ বলতে নেশাগ্রস্থ আর একটু বাটপার।
তো হেলাল ভাই হলুদ আর বিয়ের আল্পনার জন্য সাহেদ ভাইকে দায়িত্ব দিলেন। তিনি একজনকে ধরে আনলেন আল্পনা করার জন্য। রাত একটার পরে আল্পনা করা শুরু করলেন ভাই। সঙ্গে আমি সহযোগিতা করতে থাকলাম। বারটার দিকেই সাহেদ ভাই আল্পনাওয়ালা ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাওয়া। কথায় কথায় পরিচয় হলো ফজল ভাইয়ের সঙ্গে। মূলত উনাকে ক্রিকেটার হিসেবেই চিনতাম কিন্তু নাম জানতাম না। উনার আল্পনা করাটা পেশা না, শখ। রাত আড়াইটার দিকে উনি বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামলেন। উনার কাজ হইল চারদিকে রং করে দেয়া আমার কাজ চারদিকের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় রং করা। বিশ্রামের সময় বললেন, ‘ভাই সাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হইল কিভাবে? এ লোক তো বাটপার। এখান থেকে যা টাকা পাবে তার অর্ধেক উনি খেয়ে ফেলবে বাকি অর্ধেক দিবে। আমার শখের কাজ তাই আমি আসি তা নাহলে আসতাম না।’ শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে উনি কাজ করেন আর মাঝখান থেকে আরেকজন এসে টাকা খেয়ে চলে যায়, আশ্চর্য!
দুইজনে অনেক রকম গল্প করতে করতে ফজল ভাই কোমর থেকে বাঁশি বের করলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাজাতে পারি কিনা’ আমি উত্তরে, ‘না’ বললাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত রাতে বাঁশি বাজালে কেউ কিছু বলবে কিনা?’ আমি বললাম, ‘সমস্যা নাই বিয়ের অনুষ্ঠান তো।’ উনি সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললেন, ‘ভুলেই গেছিলাম।’ রাত আড়াইটার সময় মুগ্ধ হয়ে একটা মানুষের বাঁশি বাজানো শুনছি। তখন শুধু বাংলা ব্যান্ডই বেশি শুনতাম, মাটির গানগুলা কম শোনা হতো। কিন্তু উনি একটার পর একটা গান বাজিয়ে যাচ্ছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। এক সময় থামলেন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে শিখলেন?’ উত্তরে বললেন, ‘নিজে নিজে।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আল্পনাও কি নিজে নিজে শিখছেন?’ উনি উত্তরে মাথা নাড়লেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমিও কি শিখতে পারবো?’ উত্তরে বললেন, ‘ইচ্ছা থাকলেই পারবেন।’ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রেম করেন?’ আমি ‘না’ বললাম। উনি উত্তরে বললেন, ‘আগে প্রেম করা শিখেন তারপর এইগুলা শিখবেন।’
আমাকে প্রেম নিয়া ব্যাপক জ্ঞান দিলেন। প্রেম করতে হবে অল্প বয়সী কারও সঙ্গে। সমবয়সী কারও সঙ্গে কখনই এই কাজ করা যাবে না। দরকার হলে বয়সে বড় কারও সঙ্গে। আমি ঠিক বুঝলাম না প্রেমের সঙ্গে আল্পনা অথবা বাঁশি বাজানোর শেখার কি সম্পর্ক।
আমরা আড্ডা শেষে ভোর পর্যন্ত আল্পনা করলাম ঘরে, ঘরের বাইরে সব জায়গায়। উনার কাছ থেকে উনার নাম্বারটা রেখে দিলাম। এক সময় উনাকেও ভুলে গেলাম।
অনেকদিন পর মুন্নি আন্টির বিয়ে। শরীফ মামা ডেকে বললেন, তিন তলা পর্যন্ত আল্পনা করতে ঘরের ভিতর সহ। তোর কেউ পরিচিত থাকলে নিয়ে আয়। হাতে সাতশ টাকা ধরিয়ে দিলেন। পাঁচশ টাকা যে আল্পনা করতে তার টাকা আর দুইশ টাকায় রং। আমি ফজল ভাইকে খুঁজে বের করলাম। জিজ্ঞেস করলাম ভাই আপনে তিনতলা সিড়ি আল্পনা করবেন আর চার রুমের একটা ফ্ল্যাট কত দিতে হবে? উনি উত্তর দিলেন, ‘আপনে দিয়েন কোন সমস্যা নাই।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘রং কিনবো কোত্থেকে?’ উনি বললেন, তিনি সব নিয়ে আসবেন। এইসব নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হবে না।
আবার দুইজনে মিলে আল্পনা করলাম। উনি মূল কাজ করলেন আমি তাঁর সহযোগী। কারণ আমি আসলে আল্পনার কিছুই জানি না। কিন্তু রং করতে ভাল লাগে। মাঝখানে বিশ্রামের সময় রাতে আবার সেই মুগ্ধ হয়ে বাঁশি বাজানো শুনা। উনাকে বোকার মত প্রশ্ন করলাম ভাই আপনে কি সব সুর বাজাতে পারেন? উনি হেসে দিয়ে বললেন, সব পারি। আমি বললাম ভাই ‘তেরে নাম বাজান’। উনি হেসে দিয়ে বাজালেন। আরো কিছু মন খারাপ করা কিছু গানের সুর বাজিয়ে বললেন, প্রেমে পড়ছেন? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ উনি বললেন, ‘সমস্যা কি?’ উত্তরে বললাম, ‘হবে না।’ উনি বললেন, ‘বাঁধা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘ধর্ম।’
উনি হেসে বললেন, কোন সমস্যা নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আরো কয়েকটা মন খারাপ করা সুর বাজালেন। তারপর আমরা কাজে মন দিলাম। উনি চলে গেলেন। পরদিন উনাকে টাকা দিতে যাব। মামা সাতশ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু উনাকে কিভাবে সাতশ টাকা দিব বুঝতে পারছিলাম না। একজন শিল্পীকে কিভাবে এত কম টাকা দেই। কিভাবে কিভাবে যেন আমি আরো তিনশ টাকা ম্যানেজ করলাম। সাতশ টাকা আমি কোনভাবেই দিতে পারছিলাম না। আর মামাকেও বলতে পারতেছিলাম না আরো কিছু টাকা দেন। তাই নিজে থেকে তিনশ টাকা দিয়ে এক হাজার টাকা সমান করে দিলাম। আর আরো সমস্যায় পড়লাম আরেকটা কারণে উনি টাকা চান না। চাইলে হয়ত এত খারাপ লাগতো না। আর শিল্পের মূল্য তো নিশ্চয়ই টাকা দিয়ে হয় না।
উনাকে টাকা দিতে গেলাম, খুবই লজ্জিত হয়ে বললাম ভাই আপনাকে উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারলাম না। কিছু মনে কইরেন না। টাকাটা উনাকে দিলাম উনি টাকাটা না গুনেই পকেটে রেখে দিলেন। বললেন, ‘আপনে যদি কোনদিন টাকা ছাড়াও আমাকে ডাকেন আমি আসবো। শুধু রঙ্গের টাকা দিবেন, লজ্জিত হওয়ার কিছুই নাই।’
এরমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। পছন্দের মানুষটি আরেকজনের হয়ে গেছে। পছন্দ করি কিন্তু বলাই হইল না। মা মারা গেছে। এখানে সেখানে কাজ করে কাক-এ এসে মোটামুটি স্থায়ী হলাম। নানা রকম চিন্তাভাবনার মাঝে নতুন কিছু করতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা হইল বাঁশি বাজানো শিখবো। ফজল ভাইয়ের কথা মনে পড়লো, উনি যদি একা একা এত কিছু শিখতে পারেন তাহলে আমি কেন পারবো না?
নাখাল পাড়ায় ফিরে উনার খোঁজ লাগালাম একদিন পেলাম। অনেকদিন পর দেখা দেখেই হেসে উঠলেন। আরে তুমি এতদিন পর? কি অবস্থা? সব বললাম। নাখাল পাড়া ছেড়ে দিয়েছি, এলিফ্যান্ড রোডে থাকি। আরো বললাম বাঁশি বাজানো শিখতে চাই। উনি একটু মন খারাপ করে বললেন আমি তো বাঁশি বাজানো ছেড়ে দিয়েছি বলতে গেলে, খুবই কম বাজাই। আমি খুবই অবাক হলাম। তিনি তাঁর বাসার সামনে নিয়ে গেলেন। বাইরে দাঁড় করিয়ে ভিতরে গেলেন সঙ্গে নিয়ে আসলেন ছোট একটা ট্রামপেট। বললেন এইটা নিজে নিজে শিখতেছেন। আমাকে দুয়েকটা সুর বাজিয়েও শোনালেন। বললেন এইটা খেলনার পুরাপুরি শেখা হইলে আসলটা কিনবেন।
আমাকে একটা বাঁশি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার জন্য।’ আরো বললেন একটা কথা বলি শোন, ‘তোমাকে আমার কেন জানি অনেক পছন্দ হইছে। তোমার হাসিটা এত সুন্দর কেন জানি না। আল্লাহ সবাইকে সবকিছু দেয় না। তোমাকে সুন্দর একটা হাসিমুখ দিয়েছেন।’ উনি রেললাইন ধরে মহাখালীর দিকে হেঁটে চলে গেলেন। একবারও পিছনে তাকালেন না। আমি তাকিয়ে থাকলাম। বাঁশিটা ভাল করে দেখলাম, একপাশে খোদাই করে লেখা বৃষ্টি। সম্ভবত উনি নিজেই যতœ করে লিখেছেন এই নাম…
.
২৮ ফাল্গুন ১৪২২
