আজকের আমেরিকা (১০) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

আতলান্তিক সাগরের বুকে

উত্তরে মেরু হতে শুরু করে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত আতলানতিক সাগর বিস্তৃত। কেপটাউন হতে লণ্ডনে আমি জাহাজে করেই এসেছি কিন্তু তাতে আতলান্তিকের গন্ধ যে পাইনি বলেই মনে হয়েছিল। এবার আমি খাঁটি আতলান্তিক সাগর পার হব। এই উদ্দীপনা যদিও আমার মন আমেরিকার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তবও লণ্ডন নগর পরিত্যাগ করতে কি যেন একটা সংকট এসে দেখা দিচ্ছিল। এখানে বসে ইউরোপের তাজা সংবাদ যেমন পাওয়া যায় আমেরিকায় গেলে কি সেরূপ তাজা খবর পাব? ইউরোপ হবে রণাংগণ, ইউরোপই হবে ভবিষ্যতের মানব জাতির ইতিহাস গড়বার স্থান; সেই ভাংগা গড়ার দৃশ্য দেখব, না আমেরিকায় গিয়ে নতুন পৃথিবী দেখব তাই নিয়ে একটু চিন্তা করতে হয়েছিল। এদিকে জাহাজের টিকিট কেনা হয়ে গেছে, যদি তাই না হ’ত তবে হয়ত আমেরিকা যেতামই না।

লণ্ডনে ভারতবাসীর যেমন সভা সমিতি হচ্ছিল, তেমনি গ্রীক, তুরুক, স্লাভ, ফ্রেন্চ, আরব, জু এসবের রেঁস্তোরায়ও ভবিষ্যতের যুদ্ধ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছিল। আরব এবং জু একই টেবিলে বসে যখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করত, গড়ে উঠেছে তা বাস্তবিক তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সাময়িক ভাবে তৈরী করা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরব এবং ইহুদীতে যে মনোবিবাদ থাকবে না তার শুধু ইহাই প্রমাণ নয়, এসম্বন্ধে আরও দেখেছি আরও শুনেছি। এসব দেখবার জন্যই লণ্ডন তখনকার দিনে আমার কাছে বেশি আরামদায়ক ছিল।

বিদেশী ব্যবসায়ী মহলেও যাওয়া-আসা করেছি। এদের মধ্যে তুরুক, বুলগার, শ্লাভ, মাঝারু, জার্মান, স্প্যানিস, ইটালিয়নো–অনেকের সংগে কথা বলেছি। প্যালেস্টাইনের ইহুদী এবং আরবদের একই রেঁস্তোরায় বসে খেতে দেখেছি। সকলের মুখে এক কথা,–এমন করে জীবন আর কয়দিন কাটবে। যেন সকলেই কিছু একটা পরিবর্তন চায়। সে পরিবর্তন কোন দিক দিয়ে কি প্রকারে আসে, তাই দেখবার জন্যে যেন সকলেই উৎসুক। মাঝে মাঝে দৈনিক ‘ডেলি ওয়ারকার’ পাঠ করতাম। তার সম্পাদক আমাদের দেশের লোক। সেই সংবাদপত্রে কনটিনেণ্টের রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনা থাকত এবং ভারতের সংগে তার তুলনাও হত। শুনলাম, ভারতীয় ছাত্রেরা এই সংবাদপত্র পাঠ করতে ভয় পায়।

লণ্ডন পরিত্যাগ করার দিন পুঁটলি পাঁটলা বেঁধে মিঃ দত্ত এবং গ্রীক সাথীটিকে সংগে নিযে ওয়াটারলু স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। প্রত্যেক গাড়িতে যাঁরা যাত্রী তাঁদের নাম লেখা ছিল। আমারও নাম লেখা ছিল। আমার কম্পার্টমেণ্টে দুজন প্রফেসর এবং একজন ইনজিনিয়ার ছিলেন, আমাকে নিয়ে চারজন। আমাদের দেশের তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ির কথা মনে হওয়ায় বড়ই দুঃখ হল। কমপার্টমেণ্টে উঠে মনে হল সংবাদপত্রের কথা তাই সাথীদের সংবাদপত্র কিনে দিতে বললাম। সাথীরা সেদিন সকালের পাঁচখানা সংবাদপত্র কিনে আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিলেন। গাড়ি চলল সাউথ হামটনের দিকে। গাড়ি কোথাও থামল না। আমি একাগ্রভাবে পথের দুদিকের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। পথের দুদিকের সৌন্দর্য আমাদের দেশের মতই। ফ্রানসের সৌন্দর্য বোধে এবং ব্রিটেনের সৌন্দর্য বোধে অনেক প্রভেদ। ফ্রেনচরা গাছের ডাল কাটে যখন গাছে নতুন পাতা গজায়। এরা শুকনা ডালও ভাংগে না। আমাদের দেশে অভাবে পড়ে অনেকে আজকাল হয়ত শুকনা ডাল ভাংগে কিন্তু পূর্বে তা করত না। এখানে ফ্রেনচ রুচি এবং ব্রিটিশ রুচিতে অনেক পার্থক্য দেখা যায়।

গাড়ি সাউথহামটনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি ইচ্ছা করেই সকলের শেষে নামলাম। আমি জানতমা কষ্ট আমার পথ আগলে বসে আছে। গাড়ি হতে নেমে জর্জিক জাহাজাজের দিকে অগ্রসর হলাম। পাশেই দাঁড়ানো নরম্যানডিও আমেরিকায় যাবে। জার্জিকে যারা যাবে, তারা জেঠির পথ ভিড় করে বন্ধ করেছে। আমার তাতে লাভই হল, আমি দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলাম। চীনা যুবকগণ নিজেদের দেশের সৈনিকের পোষাক পরে জাহাজে উঠছে, তারা চলেছে নড়তে জাপানীর সংগে। তাদের সকলের মুখেই হাসি। অন্যান্য জাহের লোকও বুক উঁচু করে পথে চলছে। শুধু আমারই মুখ ম্লান। আমি বোধহয় এতবড় ডকটাতে একমাত্র ভারতবাসী ছিলাম।

সকলে পাসপোর্ট দেখিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠল আমার বেলা কিন্তু অন্য রকমের ব্যবহার। আমার মুখ দেখেই পাসপোর্ট অফিসারের পিলে চমকে গেল। একজন অফিসার আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি গিয়ে একটা বেনচে বসলাম এবং নানা কথা ভাবতে লাগলাম। ভাবছিলাম আজ হায়দরাবাদের নিজাম যদি আমার মত এখানে এই অবস্থায় পড়তেন, তা হলে তাঁর অবস্থা কেমন হত? অবশ্য জাহাজ আমাকে ফেলে যাবে না তা আমি ভাল করেই জানতাম। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ টিকিট কে আপনাকে বিক্রি করেছে?’

“জাহাজ কোম্পানি।”

“আমেরিকার ভিসা আছে?“

“আছে।”

“কৈ দেখি?”

“এই দেখুন।”

“বহু পুরাতন।”

“তা পুরাতন বটে।”

“সংগে কত টাকা আছে?”

“এ কথাতো অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করেননি, আমার বেলায় কেন?”

“আমার ইচ্ছা। এ জাহাজে হয়ত আপনার যাওয়া হবে না।”

“আপনার অনুগ্রহ।”

পাসপোর্ট এবং টিকিট নিয়ে অফিসারটি আর এক অফিসারের কাছে দৌড়াল। উভয়ে মিলে কোথায় টেলিফোন করল, তার পর ফিরে এসে বলল, “আপনি এই জাহাজেই যেতে পারেন।” আমি তাদের বললাম, “আপনারা যে আচরণ করেছেন, তা শিষ্টাটার নয়, তবু সেজন্র আপনাদের উপর আমার রাগ হয়নি। দোষ আমারই, কারণ আমি পরাধীন দেশের লোক।”

অফিসার বলল, “পরাধীন জাতের মধ্যেও সিংহের জন্ম হয়—চলুন আপনার পিঠের ঝুলিটা এগিয়ে দিই।” এই কথা বলে সত্যিই লোকটি আমার ঝোলাটা নিয়ে আমার সংগে জাহাজের সিঁড়ি পর্যন্ত চলল। জাহাজে উঠে একটু শান্তি পেলাম এবং লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায দিলাম।

আমার কেবিনে নম্বর আমার জানা ছিল। দেখতে লাগলাম কোনদিকে সেই কেবিন। একজন লোক এসে আমাকে কেবিন দেখিয়ে দিল। পিঠ-ঝোলাটা সেখানে রেখে, টুপিটা খুলে, একটু বসলাম। বেশ আরাম বোধ হল। তারপর ভাবতে লাগলাম, আমার জীবনের, আমার দেশের এবং আমার জাতে কথা। যতই ভাবছিলাম, ততই রাগ হচ্ছিল, বাইরে যাবার মোটেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। কেউ আমায় বিদায় দিতে আসেনি, কেউ আমার প্রতীক্ষায় পথ চেযে বসেও ছিল না, তবে কেন জাহাজের চারিদিকে ঘুরে বেড়ান।

কেবিনেই হাত মুখ ধোয়ার গরম ও ঠাণ্ডা জলে ব্যবস্থা ছিল। হাত মুখ ধুয়ে ভাবলাম, গিয়ে দেখি, হয়ত রাজা ষষ্ঠ জর্জ আমেরিকা থেকে ফিরে আসছেন। এই জেটিতেই তাঁর জাহাজ ভিড়বে। কেবিন হতে বার হবার পরই একজন লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম রামনাথ?” বললাম, “হ্যাঁ, কি দরকার?” সে বলল, “এই চিঠিটা আপনার বন্ধু হোর‌্যাসিও দিয়েছে, গ্রীক ভাষায লিখেছে বলেই পড়ে শোনাতে এসেছি।”

পত্রে ছিল, তিনি আমেরিকা যাবেন বলে আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রাখতে পারলেন না কারণ শীঘ্রই ইউরোপে যুদ্ধ আরম্ভ হবে, তাই তিনি কটিনেণ্টে চলে যাচ্ছেন। যদি পারেন, তবে ভারতে গিয়ে কলিকাতার ঠিকানায় আমার সংগে দেখা করবেন। চিঠিতে এ কথাও ছিল যে, পত্রবাহকও গ্রীক,–লোক ভাল; তার সংগে আমি আলাপ করিতে পারি। পত্রটা হাত থেকে নিয়ে দেখলাম, সেটা গ্রীক ভাষাতেই লেখা বটে এবং তারই সেই দস্তখত! আমরা দুজনে জাহাজের ডেকে গেলাম; দেখলাম রাজা জর্জকে অভ্যর্থনা করবার জন্য উপরে বিরাট আয়োজন চলছে। জাহাজ তখন ডক ছাড়েনি। আমি কাস্টম অফিসারের প্রসংগই শুরু করলাম। ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বললাম, দোষটা আমাদের জাতেরই; কারণ আমরা পরাধীন। ভদ্রলোক বললেণ, “আপনাদের জাতের দোষ আর থাকবে না।” কথাটা আমার খুব ভাল লাগল।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.