আজকের আমেরিকা (১২) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

জাহাজ ধীরে ধীরে হাডসন নদীতে গিয়ে প্রবেশ করল। আমি ডেকে বসে নদীর দুই তীরের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম। বাস্তবিক সে দৃশ্য উপভোগ্য। বড় বড় বাড়িগুলির উপর মেঘমালা ঝুঁকে পড়েছে। বিজলি বাতির আলো তাতে পড়ে আঁধারে-আলোর সৃষ্টি করেছে। সেই আঁধারে আলো দেখবার মত। আজকের দিনটা যে আমাকে হাজতে বাস করতে হবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম বলেই নামবার জন্য তাড়াহুড়া করছিলাম না। একজন আমেরিকান আমাকে আকাশস্পর্শী বাড়িগুলির পরিচয় দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “ওই দেখুন ওয়ালস্ স্ট্রীট। ওয়ালস স্ট্রীটই পৃথিবীর সমদুয় ব্যবসায় এবং আমেরিকার পলিটিক্সের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করছে। বাঁদিকে পড়ল হারলাম, হারলামই হল আমেরিকার প্যারি।” কথা বলতে বলতেই জাহাজ কূলে এসে ভিড়ল। সিড়ি পাতা হল, ইমিগ্রেশন অফিসার এলেন, সমস্ত যাত্রীরা ডাক্তারের সামনে যেতে লাগল। যারা আমেরিকা প্রবেশের আদেশ পেল, তারা নিজেদের অনেক ভাগ্যবান মনে করল। শেষটায় আমাদের দুজনেরও ডাক পড়ল। আমেরিকান ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁর ডাক্তারী পরীক্ষা হল না, ডাক্তার শুধু, ‘গুডবাই’ বলেই তাঁকে বিদায় দিলেন। আমার ডাক্তারী পরীক্ষা হবার পর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে হাজির করা হল। অফিসার আমার পাসপোর্ট একদিকে রেখে দিয়ে বললেন, “এখানে বসুন, পরে দেখব।” এ যে ঘটবে তা আমার জানাই ছিল। আমি চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পাশে এসে জাহাজে লাগার জায়গাটা দেখতে লাগলাম।

দুদিকে কাঠের দেওয়াল রয়েছে। এই দেওয়াল ডিংগিয়ে পার হওয়া সাধ্যাতীত। একদিকে নদী এবং একদিনে জাহাজ থেকে নামবার গেট। এই গেটে প্রবেশ করতে সকলেরই পাসের দরকার হয়। এমন কড়া ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের খালাসীরা যে কি করে জাহাজ থেকে পালিয়ে সাঁতার কেটে শহরে যায়, তা বলা শক্ত। এসব যখন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম তখন ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ডেকে বললেন, “একজন ইউরোপীয় মহিলা আপনার সংগে দেখা করতে চান, বসুন এখানে, এখনই তিনি আসবেন।” নূতন করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে চেয়ারে বসলাম।

মিনিট পাঁচেক পরেই সেই ইউরোপীয় মহিলা এসে আমাকে সংবাদ দিলেন যে একজন হিন্দু মহিলা এখনই আসবেন আমার সংগে দেখা করতে, আমি যেন এখানেই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করার সময় হঠাৎ মনে হল তিনি কমলা দেবী মুখার্জ্জি নন তো, উপেনবাবু যার কথা আমার কাছে লিখেছিলেন? এতে মনে একটা আশার সনচার হল।

মিনিট দশেক পরেই, পরনে শাড়ি, কপালে সিঁদুরের টিপ, পায়ে ভারতীয় স্যাণ্ডেল, একটী মহিলা আসতে লাগলেন। আমেরিকান, ইউরোপীয়ান সকলেই তাঁকে পথ ছেড়ে দিয়ে টুপি খুলে সম্মান জানাতে লাগল। তাঁর পথ পরিষ্কার, তাঁকে আর লোক ঠেলতে হল না। আমার কাছে আসা মাত্র আমিও দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে তাঁকে নমস্কার করলাম। আমরা যেমন করে ‘বন্দেমাতরম’ গান গাইবার সময় দাঁড়াই বা ইংরেজরা যেমন করে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গায়, ইমিগ্রেশন অফিসাররা ঠিক তেমনি করে সবাই একসংগে তাঁকে সম্মান দেখাতে দাঁড়ালেন।

মহিলাটির এত সম্মানের কারণ প্রথমে ঠাহর করতে পারি নি। যাইহোক তিনি আমাকে বললেন যে, তিনি শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের চিঠি পেয়েছেন এবং আমাকে নিয়ে যাবার জন্যই এসেছেন। তিনি আরও বোধহয় কিছু বলতেন, কিন্তু একজন ইমিগ্রেশন অফিসার টেবিলের কাছ থেকে উঠে এসে তাঁকে ডাকলেন এবং আমার সংগে কোনও কথা বলতে নিষেধ করলেন। মহিলাটি যতক্ষণ না কোনও আসন গ্রহণ করলেন সব ইমিগ্রেশন অপিসারই ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কমলাদেবী মুখোপাধ্যায় আসন গ্রহণ করেই অফিসারের সংগে নানা কথা আরম্ভ করলেন। তারপর আমার কথা উঠল। কমলা দেবী বললেন, তিনি যে সাপ্তাহিক পত্রের লেখিকা, আমিও সেই সাপ্তাহিক পত্রে লিখে থাকি এবং সেই সূত্রেই আমার সংগে তাঁর পরিচয়। তারপর আর কি কথা হল তা আমি শুনতে পাই নি, কারণ আমাকে দূরে গিয়ে বসতে বলা হয়েছিল। শেষ কথা শুনলাম “ও, কে,” তারপরই পাসপোর্টে সিলমোহর পড়ল এবং অফিসাররা “ও, কে,” উচ্চারণ করে একসংগে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায দিলেন। কমলাদেবী আমার হাত ধরে বার হয়ে পড়লেন। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।

আমার লাগেজ পরীক্ষা করা হল, তারপর আমরা একটা বড় পথে এসে পড়লাম। পথটি দেখবার মতই। ছত্রপতি শিবাজী যেমন দিল্লী প্রবেশের সময় এদিকে সেদিকে বড় তাকান নি, আমিও তেমনি কোনও দিকে না তাকিয়ে একটি ট্যাক্সি ডেকে সাইকেলটা তাতে বোঝাই করে কমলাদেবী মুখোপাধ্যায়কে ভাল করে বসিয়ে ৪২নং স্ট্রীটের ওয়াই.এম.সি.এ-এর দিকে রওনা হলাম। লণ্ডনের জাহাজের এজেণ্টও আামকে নিতে এসেছিলেন। তিনিই ওয়াই. এম. সি. এ-এর ম্যানেজারের কাছে আমার আগমনী নিবেদন করলেন। ম্যানেজার নীচে এসে আমার মুখ দেখেই বললেন, “বড়ই দুঃখের সংগে জানাতে হচ্ছে, আমাদের এখানে একজন লোক রাখবারও স্থান নাই।” আমি বুঝলাম ব্যাপারখানা কি। তৎক্ষণাৎ কমলাদেবীকে বললাম, আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এখন আমার থাকার স্থান আমিউ খুঁজে বার করব। অতএব যদি অনুমতি দেন ত আপনাকে গিয়ে রেখে আসি।”

আমার অপমানে তিনিও বোধ হয় অপমান বোধ করেছিলেন। তাই অপমানের বোঝা আর বইতে না চেয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লেন এবং বললেন, যেখানেই থাকি না কেন কাল সকালে যেন তাঁর কাছে ফোন করি।

অপমান লাঘব করবার জন্যই বোধহয় কমলাদেবী বললেন, “আপনার বাইসাইকেল নিয়ে এখানে আসা ভাল হয়নি। অন্য একজন বাংগালী ভূপর্যটক এসেছিলেন, তার সঙ্গে এ বালাই ছিল না।” আমি বললাম, “এই নিয়েই আমি পথ চলি এবং আমেরিকায় এই নিয়েই চলাফেরা করব। যাক এটার জন্য ভাবতে হবে।”

তিনি চলে যাওয়াতে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম। তারপর অন্য একটা ওয়াই. এম. সি. এ-তে গেলাম এবং সেখানেও সেই ‘স্থানাভাব’; সাদা চামড়ার ওয়াই. এম. সি. এ-তে স্থানলাভের আশা সুদূরপরাহত বুঝে হারলামের দিকে রওনা হলাম এবং নিগ্রোদের ওয়াই. এম. সি. এ-তে স্থান পেলাম।

রুমের ভাড়া এবং ট্যাক্সির মজুরি দিয়ে নিকটস্থ একটি নিগ্রো হোটেলে খেতে গেলাম। খাওয়া শেষ করে দু সেণ্টের একখানা সংবাদপত্র কিনে বোধহয় নবম তলায় অবস্থিত একটি রুমে এসে দরজা খুলেই মনে হল এটা ওয়াই. এম. সি এ-ই বটে। তবে হাতে টাকা প্রচুর রয়েছে, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করা কর্তব্য। ভিতর থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে এই গভীর রাত্রে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র পাঠ করতে আরম্ভ করলাম। অনেকক্ষণ সংবাপত্র পাঠ করে রাত্রি তিনটার সময় ঘুমালাম। সকালে আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে যখন বাইরের দিকে তাকালাম তখন দেখলাম অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। ১৩৫ নং স্ট্রীটের পশ্চিম দিকে ওয়াই এম. সি এ অবস্থিত। রাস্তার দুদিকে বড় বড় বাড়ি তবে বাড়িগুলির অবস্থান আমাদের দেশের বাড়ির মত এলোমেলো ভাবে নয়। ‘ব্লক’ করে বাড়ি সাজান। তা সে নিগ্রো পল্লীই হোক আর সাদা চামড়াদের পল্লীই হোক। এই পৃথিবীতে জার্মানী আর আমেরিকা ছাড়া কোথাও এরূপ ‘ব্লক’ প্রথায় বাড়ী তেরী হয় নি। তবে রুশিয়ায় এ নিয়মটি প্রবর্তিত হবে বলে মনে হয়। ব্লক পদ্ধতিতে বাড়ী করলে পিচ দেওয়া বড় পথকে খুঁড়তে হয় না, যেমন আমাদের কলকাতায় হয়ে থাকে। ব্লক প্রথায় বাড়ি করা হয় বলে, জল, গ্যাস বিজলি বাতি প্রভৃতি এমন সুন্দরভাবে রাখা হয় যে, তার সংগে পথের সম্পর্কই থাকে না। সবই পেভমেণ্টের নীচে চলেছে।

দাঁড়িয়ে হাঁ করে পথের দু পাশের বাড়িগুলি দেখতে লাগলাম। দেখলাম প্রত্যেকটি বাড়ির জানালা বন্ধ। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না কে কোথায় বাস করছে। পথে স্রোতের মত মোটরকার, মোটরলরি, ট্যাক্সি এবং বাস চলছে। একটু দূরেই এলিভেটারে বাড়ির উপর দিয়ে গাড়ি চলছে। কতক্ষণ এমনভাবে চেয়ে ছিলাম তার ঠিক ছিল না, শুধু চেয়ে থাকতেই ইচ্ছা হচ্ছিল। আকাশে গাড়ি, মাটিতে গাড়ি, মাটির নীচে গাড়ি। এমন দেশ পৃথিবীতে মাত্র একটীই। আমেরিকা ছাড়া কোথাও আজ পর্যন্ত এলিভেটর সিস্টেমে ট্রাম চলার প্রথা প্রবর্তিত হয়নি।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.