
দেখার নেশা একটু যখন মিটল তখন আবার স্নান করলাম। তারপর নীচে নেমে পথের নাম, বাড়ীর নম্বর, স্ট্রীটের নম্বর নোট বুকে লিখে নিয়ে একটু কাফি খাবার ইচ্ছায় সোজা হাঁটতে লাগলাম। একটি কাফির দোকানে গেলাম তাতে দু’জন নিগ্রো এবং তিনজন আমেরিকান বসে কাফি খাচ্ছিল আর নানারকম আলোচনা করছিল। এদের দর্শন-ঘেঁষা কথাবার্তা শুনে মনে হল যেন আমি কোন সন্ন্যাসীর আখড়ায় বসে আছি। এরা যে দর্শনের কথা নিযে আলোচনা করছিল, ইচ্ছা করলেই তাতে মুখ পাততে পারতাম কিন্তু এরূপ করা মহা অন্যায় এবং আমরা যেমন সবজান্তার জাত তাদের সংগে তা চলবে না। বাজে কথা তারা মোটেই বলছিল না। প্রত্যেকটি কথার পেছনে যুক্তি ছিল এবং তারা হাউমাউ করে চিৎকারও করছিল না। কতক্ষণ পরই হয়ত আমি আমেরিকানদের নিগ্রোঘৃণা সম্পন্ধে গাল দিব, কিন্তু এখানে তা পারব না কারণ এখানে সাদা এবং কালো উভয়ে নিযে এমনই এক দর্শনের কথা বলছিল যা আমার আছে নতুন ছিল এবং তাতে ভাববারও বিষয় ছিল। তাই শুধু কাফি খেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বেরিয়ে এলাম।
পথে যাবার সময় একজন জামাইকাবাসী নিগ্রো রমণীর সংগে সাক্ষাৎ হয়। রমণীটি সুন্দরী এবং ডাক্তার। অপরিচিত মুখ দেখেই রমণী আমাকে পথ হারিয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করলে। আমি পথ হারাইনি তাঁকে জানালাম। তবে বলতে বাধ্য হলা গত রাত্রে ওয়াই. এম. সি. এ-তে ঘুমিয়ে আরাম পাইনি, যদি কম ভাড়ায় একটি সাজসরনজাম বিশিষ্ট রুম পাই এবং তা পেতে যদি তিনি আমাকে সাহায্য করেন তবে বড়ই বাধিত হব। তাঁরই সাহায্যে ান্য আর একজন জামাইকাবাসীর বাড়িতে একখানা রুম সপ্তাহে আড়াই ডলারে ঠিক করলাম। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সে রুম। বাড়িওয়ালী বললেন, ভারতীয় খাবার তিনি রেঁধে দিতে পারবেন। জামাইকাবাসী নিগ্রোরা আপনাদের নিগ্রো বলে পরিচয় দেয় না, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান বলে পরিচয় দেয়। তাদের মতে ফিলিপাইন, জাভা আর ভারতবাসীরা ইস্ট ইণ্ডিয়ান। আমেরিকানরা আমাদের হিন্দু বলে, হিন্দু মুসলমান প্রশ্ন এখানে নাই। তবে ব্রিটিশের প্রচার বিভাগের ফলে অনেক ব্রিটিশ-পারিচালিত সংবাদপত্র সেই ভ্রম আজকাল সংশোধন করে দিচ্ছে। মি: শওকত আলি এবং একজন মাদ্রাজী পাদরী সেই ভুল সংশোধন করতেই বোধ হয় সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু পেরে উঠেন নি। ভারতবাসীর হিতাকাংখীর অভাব নাই, বোধ হয় আমেরিকায় আমাদের ইণ্ডিয়ান না বানিয়ে ছাড়া হবে না। সুখের বিষয় কি দুঃখের বিষয় বলতে পারি না, ক্যালিফোরনিয়াতে আমাদের দেশের পাঠানরা নিজেদের ইণ্ডিয়ান বলে কখনও পরিচয় দেয় না–তারা সদাসর্বদা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে ভালবাসে এবং এরিয়ান বলে গর্ব অনুভব করে। এরিয়ান এবং ননএরিয়ান কথা নিয়ে বাংগালী মুসলমান ও পাঠানদের মাঝে অনেক সময় পিস্তলবাজীও হয়ে থাকে। পাঠানরা বাংগালীদের–সে যে ধর্মেরই হোক—এরিয়ান বলে স্বীকার করে না।
আমি যে রুম ভাড়া করেছিলাম তার সংগে রান্না করবারও বন্দোবস্ত ছিল। রান্না করবার বাসন চাইলেই পাওয়া যায় এবং গ্যাস যত ইচ্ছা ব্যবহার করা যায়। সেজন্য অতিরিক্ত খরচ দিতে হয় না। রুম ভাড়ার সংগে গ্যাস, লাইট, বাথ, রান্নার বাসন, সপ্তাহে একবার বিছানার চাদর পরিবর্তন এবং দৈনিক একখানা করে ধোয়া নতুন তোয়ালে পাওয়া যায়। এরূপ ঘরের ভাড়া আমেরিকার পূর্বদিকে সপ্তাহে সাড়ে তিন ডলার, উত্তর দিকে তিন ডলার, মধ্যে চার ডলার পশ্চিম দিকে আড়াই ডলার থেকে পাঁচ ডলার, দক্ষিণ দিকে এক ডলার থেকে তিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঘরের আসবাব দু’খানা চেয়ার দুটা টেবিল একটা ইজিচেয়ার। পোষাক টাংগিয়ে রাখবার জন্য পাশে একটা ছোট রুমও পাওয়া যায়। রান্নার বাসন টেবিলের ড্রয়ারে রাখবার বন্দোবস্ত আছে। এই জন্যই দুটা টেবিলের ব্যবস্থা।
বিকালে সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠে একাকী বেড়াতে বের হলাম। দুটা ব্লক পার হয়ে মাউন্ট মরিস পার্ক। তাতেই বেড়াতে লাগলাম আর এলিভেটরগুলি কেমন হুস হুস করে যাওয়া আসা করছে তাই দেখতে লাগলাম। ৮নং অ্যাভিনিউ এর উপর এলিভেটর আছে এবং তারই নীচ দিয়ে আমাকে উক্ত পার্কে আসতে হয়েছিল।
এলিভেটরগুলির দিকে আমি অবাক হযে চেয়ে থাকতাম। মহানগরে যেমন মাটির নীচে রেল পথের দরকার, উপরেও ঠিক সেই রকম দরকার। এলিভেটর না হলে মহানগরের পথে চলা দায় হয়ে উছে। নিউইয়র্ক নগর এই দায়ে পড়েছিল বলেই দায়মুক্ত হবার পথ খুঁজে নিয়েছে। পৃথিবীর লোক হাঁ করে চেয়ে দেখছে এত টাকা কি করে খরচ করতে পারে! মানুষই যে টাকা তৈরি করে এ কথা মানুষ বুঝে না। মজুরীই হল টাকা। মজুরী ছেড়ে দিলে টাকার অস্তিত্ব থাকে না।
পার্ক হতে ফিরবার সময় বিকালের কয়েকখানা সংবাদপত্র নিয়ে এলাম। ইউইয়র্ক নগরে দৈনিক সংবাদপত্রের দাম দুই সেণ্ট এবং তিন সেণ্ট করে হয়। সাপ্তাহিক, মাসিক, এসকল পত্রিকা ছাড়াও অনেক সংবাদপত্র আছে যাতে বিজ্ঞাপন থাকে না। যেমন ডেলী ওয়ার্কার, পিপুল-ওয়ার্ল্ড যাতে পয়সা দিয়ে কেউ বিজ্ঞাপন দিতে পারে না। তাদের বিষয় নিয়েই বিনা পয়সায় বিজ্ঞাপন থাকে, সেজন্য প্রত্যেক দিন চাঁদা উঠছে এবং কোন জেলার লোক যুবক যুবতী সেই পত্রিকাগুলির গ্রাহক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও ঐ সংবাদপত্রগুলির প্রবেশ নিষেধ, তবুও ঐ সংবাদ পত্রগুলিই যুবক যুবতীর আশা আকাংখা ও আদর্শের প্রতীক।
আমেরিকায় যারা এসব সংবাদ রাখে, তাদের বলা হয় “পারসেনটেজ”; আমেরিকার এই “পারসেনটেজ” পার্টির লোক রোজই বাড়ছে তাই আজ রুজভেল্ট চিৎকার করেও অনেক কাজে অনেকের সাড়া পান না এবং পাবেন বলে বোধও হয় না। এরা ওৎ পেতে বসে আছে সুযোগ পেলেই আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করবে বলে। এই হল আমার ধারণা। কমিউনিস্টি দলের লোককেই উপহাস করে পারসেনটেজ বলা হয়।
ভাবছিলাম আজ রাত্রে বাইরে যাব না। পকেটে একতাড়া নোট রয়েছে। ভয় হল যদি নিউইয়র্কের গুণ্ডার পাল্লায় পড়ি, তবে পথে বসতে হবে। হঠাৎ মনে হল অতীত দিনের স্মৃতি, যেদিন পৃথিবী পর্যটনে বের হয়েছিলাম সেদিন পকেটে একটি পয়সাও ছিল না। আজ টাকা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, চুলায় যাক টাকা, আমেরিকাকে আমার দেখতেই হবে। তখন রাত প্রায় এগারটা। বের হয়ে পড়লাম পথে।
বিজলি বাতির আলোয় হারলামের প্রশস্ত পথগুলি আলোকিত। ব্রডওয়েতে বেড়াতে হলে এই শীতেও ঘাম বের হয়, বিজলি বাতির উত্তাপে। দূর হতে মনে হয় যেন আগুন লেগেছে। পনচম এ্যভেনিউ এবং একশত দশ স্ট্রীট ইস্ট যেখানে মিলেছে সেখানে দাঁড়ালাম সেণ্ট্রাল পার্কের কাছে। আলোকোজ্জ্বল সুন্দর পথ, তারই উপর অগণিত মোটর গাড়ি ও বাস চলছে। যারা ‘জ্যয় রাইড’ করতে বের হয়েছে দোতালা বাসে, তাদের হাসির ফোয়ারার উচ্চ কলরবে আকাশ মুখরিত। কাছেই বড় বড় হোটেলে মদের বোতলের ছিপি খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সুন্দরী তরুণীর কলহাস্য আনন্দের সৃষ্টি করছে। যুবক যুবতী আপন মনে পথ চলেছে এবং সরাদিনের পরিশ্রমের অবসাদ দূর করছে। তারা কখনও ছোট ছোট রেস্তোঁরায় প্রবেশ করে লাইট রিফ্রেশমেণ্ট খেয়েই বের হয়ে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তটিকে যেন তারা আনন্দে ভরিয়ে তুলছে। কাছেই একটা সিনেমা গৃহে নাচ চলছে। আমেরিকায় একদিকে চলেছে ঐশ্বর্যভোগের আয়োজন আর এক দিন রয়েছে নিরন্ন বেকার ও ক্ষুধিতের ব্যর্থ জীবনের করুণ দৃশ্য। কিন্তু ঐ যে দৃশ্য আমার সামনে, তা দেখে মনে হয় না আমি আমেরিকার কোথাও ভ্রমণ করছি মনে হয় শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বসে আছি। শ্রদ্ধানন্দ পার্কের চারিদিকে সর্বহারা দল বাস করে তার সংবাদ কেউ রাখে না। যারা সেই সংবাদ রাখেন তাঁরা আসুন আমার আমেরিকায় বর্ণিত স্থানে। দেখবেন এখানেও সর্বহারার দল নতমুখে বসে আছে। কেউ সরাদিনে এক টুকরা রুটি খেয়েছে, আর কেউ অভুক্ত অবস্থায়ই পথের দিকে চেয়ে বসে আছে। আমেরিকার ব্যাংকে প্রচুর স্বর্ণ আছে, বাগানে ফল আছে, মাঠে প্রচুর গম আছে, নদীতে জল আছে, দোকানে কাপড় জুতা সবই আছে কিন্তু ঐ ভিখারীদের কিছুই নাই। পরনে ছেঁড়া ট্রাউজার, গায়ে ছেঁড়া কোট, কারও গায়ে শার্ট আছে, কারও গায়ে তাও নেই! নেকটাই কিন্তু তবুও ঝুলছে।