আজকের আমেরিকা (১৪) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

আনন্দের লীলাভূমি, টাকার আড়ত নিউইয়র্কে এসে রাত্রি দুটা পর্যন্ত পথে হেঁটে বেড়ালাম। কেউ আমাকে লক্ষ্য করেনি, সকলেই ব্যস্ত। এত বড় নগরে কে কার সন্ধান রাখে? তাতে আমি আনন্দিতই হলাম। আমার আকৃতি অনেকটা নিগ্রোদের মত। নিজের পরিচয় কারও কাছে দিলাম না আর পরিচয় দিবার প্রয়োজনও ছিল না। হাতে টাকা আছে, পেট ভরে খাবারের বন্দোবস্ত আছে, এবং আমেরিকার সুখ-দুঃখের সংবাদ নেবার মত ক্ষমতা আছে। আমি যদি অপরিচিত হয়ে বেড়াই তবে দুঃখ করার কি আছে? একটি পুরান কথা মনে পড়ে গেল। আমার গ্রামের একটি লোকের সংগে একবার কলকাতায় দেখা হয়। তার পরনে মাত্র একখানা ধুতি, গায়ে একটা গেনজি আর ট্যাঁকে কতগুলি পয়সা। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এভাবে ঘুরে বেড়াবার কারণ কি। গ্রামে তো কখনো এভাবে থাকতে দেখিনি। লোকটি বলেছিল, ‘কলকাতা দেখতে এসেছি, দেখে চলে যাব। জাঁকজমক করে চোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাভ কি?’ আমিও নিউইয়র্কে প্রায় দু’সপ্তাহ সেইভাবেই কাটিয়ে ছিলাম। তাতে দিন কেটেছিল ভালই। কেমন করে ভালভাবে দিন কেটেছিল তার একটা দৃষ্টান্ত দিলাম।

হারলামে নিগ্রোরাই থাকে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ওয়ার্ল্ডফেয়ারের তরফ থেকে নানারূপ প্রচার চলছিল। সেখানে রুশিয়ারও একটি প্যাভেলিয়ন খোলা হয়েছিল। সেই প্যাভেলিয়নটি দেখার জন্য তথায় গিয়েছিলাম। রুশিয়ার প্যাভেলিয়ন দেখবার জন্য লোক আগ্রহাম্বিত ছিল। সেখানে নিগ্রোদের কাছে সস্তা দরে খাদ্য বিক্রয় করা হ’ত কারণ নিগ্রোরা আমেরিকানদের মত মোটা মজুরী পেত না। সে সকল খাদ্য আমেরিকানদের কাছে পঞ্চাশ সেণ্টে বিক্রি হত সেই খাবারের জন্যই নিগ্রোদের কাছ থেকে পনের সেণ্ট নেওয়া হ’ত। আমি সে সুযোগ পরিত্যাগ করিনি। রুশিয়ার প্রদর্শনীতে গিয়ে সর্বপ্রথমই খাবারের ঘরে গিয়ে খেতে বসলাম। এমন সুস্বাদু দই, ঘোল, ক্রিম, সিদ্ধ করা সবজী স্লাভ জাত ছাড়া আর কেউ তেরী করতে পারে না। রুশ দেশীয় যুবতীরা সেই সুখাদ্য থালায় করে নির্যাতিত লোকের সামনে এনে রাখছিল। তারা ভাংগা ইংলিশে কথা বলছিল। যখন তারা কথা বলছিল তখন তাদের গালভরা হাসি দেখে অনেক নিগ্রোই আনন্দে আটখানা হয়ে পড়ছিল। তাদের কার্যপদ্ধতিও অন্য রকমের। যেন কলের পুতুলের মত কাজ করে যাচ্ছিল। যুবতীরা শুধু খাবার দিয়েই কাজের শেষ করছিল না। যাদের নেকটাই অসাবধানবশত স্থানভ্রষ্ট হচ্ছিল, যুবতীগণ তা যথাস্থানে বেঁধে দিচ্ছিল। খাবার শেষ হয়ে যাবার পর যখন নিগ্রোরা চলে যাচ্ছিল তখন সেই সুন্দরী মেয়েরা তাদের কোট প্যাণ্ট ব্রুস দিযে ঝেড়ে দিচ্ছিল।

যেই রুশিয়ার প্রদর্শনীতে যাচ্ছিল সেই হাসিমুখে একটা তৃপ্তির ভাব নিয়ে বের হয়ে আসছিল। সেই তৃপ্তির সংগে যে ভাবধারা নিয়ে আসছিল তা আমেরিকার পুঁজিবাদীদের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। নিগ্রোরা প্রকাশ্যেই বলছিল আমেরিকাতে কবে রুশদেশের মত সোভিয়েট স্থাপন হবে। সোভিয়েট রুশের নতুন কর্মপদ্ধতি দেখে প্রত্যেকের মনেই নবজাগরণের প্রেরণা আসছিল। এসব কারণেই বোধহয় সোভিয়েট রুশিয়ার প্রদর্শনীতে এত ভিড় হত।

অনেক দরিদ্র শ্বেতকায়কে তথায় গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা কি ভাবছিল তা আমার বলার ক্ষমতা নাই সত্য, কিন্তু যখনই ইংলিশ ভাষায় দক্ষ রুশ গাইডগণ এসব ধ্যানস্থ আমেরিকানদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলত, তোমাদেরও কাজ করার ক্ষমতা আছে, কাজ কর, দেখবে তোমাদের দেশেও সোভিয়েট রুমের মত কিছু গড়ে উঠেছে তখন তাদেরও মনে চাঞ্চল্য এসে দেখা দিত।

সোভিয়েট প্রদর্শনীতে বড় বড় চিত্রপট এবং কিউরিয়োর কোনরূপ জাঁকজমক ছিল না। প্রদর্শনীটাকে দূর হতে যেন একটা বিরাট কিছু দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে হত। বাড়িটার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে মাটির তৈরী একটা প্রকা- মানুষেল মূর্তি। তার ডান হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল। মূর্তিটির মুখ এমনি ভাবে গঠন করা হয়েছে যে দেখলে মনে হয় যেন সেই মাটির মানুষ বলতে চাচ্ছে–‘গরিবের দল এবং সর্বহারাগণ, আর ভুলে থাকিস না, ভিক্ষা করে আর কোন দরকার নাই, এবার তোদের পাওনা বুঝে নে।’

সোভিয়েট প্রদর্শনীতে সিনেমারও আয়োজন ছিল। রুশ দেশের সিনেমার সংগে অন্য কোন দেশের সিনেমার মোটেই মিল নাই বললে কোন দোষ হয় না। রুশ সিনেমায় পুরাতন ঐতিহাসিক ঘটনার উপর সত্যের দীপ্তি ফুটে উঠছিল। কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করা হচ্ছিল না। সিনেমায় দেখান হচ্ছিল, জারের আমলে এক টুকরা রুটির জন্য পুত্রকন্যার সামনে কি করে মাতা তাঁর শরীর বিক্রয় করছেন আর কেমন নিঃসংকোচে পুঁজিবাদীর দল সেই মাতার প্রতি কুব্যবহার করছে; যুবক যুবতীরা অন্নচিন্তা করে অকালে কিরূপে বার্ধক্য পেয়েছে। সে সব করুণ দৃশ্য অনেকক্ষণ দেখবার মত পাষাণ মন অনেকেরই ছিল না। অনেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠছিল আর জারের নামে নানারূপ কটুক্তি বর্ষণ করছিল। ইহুদী এবং যারা অখৃষ্টান তাদের প্রতি কত অত্যাচার চলছিল তার দৃশ্যও দেখান হত, কিন্তু ইে দৃশ্য দেখে কেউ কাঁদত না শুধু গম্ভীর হয়ে ভাবত। আমিও ভাবতাম। ভাববার বিষয়ই বটে।

কাছেই ইটালীয়ানদের প্রদর্শনী। নিগ্রোরা সেই প্রদর্শনীতে যেত এবং দেখত। তারা বুঝতে চেষ্টা করত কোন শক্তির প্রভাবে সিনিয়র মুসলিনী সম্রাট হাইলে সেলাসীকে রাজ্য ছাড়া করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রদর্শনী দেখে তারা সে বিষযের কোন সন্ধানই পেত না। সেখানে গিয়ে তারাও দেখত আমিও দেখতাম। এই প্রদর্শনীটি হল একিট ঠকের আড্ডা। নীচের তলার প্রবেশ দ্বারে লেখা রয়েছে ‘বিনামূল্যে এখানে ইটালীতে প্রস্তুত নানারূপ জিনিষ বিতরণ করা হয়।’ কথাটা মোটেও অন্যায় নয়। প্রত্যেক দেশেই অনেক জিনিষের নমুনা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম এখানেও সেরূপই কিছু হবে, কিন্তু প্রবেশ করে দেখি এখানে সেরূপ কিছু নয়। যে জিনিষ বাজারে দশ সেণ্ট করে বিক্রি হয় সেরূপ জিনিসের দাম এখানে পঁচিশ সেণ্ট করে লেখা রয়েছে। আমি তা দেখে জিনিসও কিনিনি কাউকে গালও দেইনি, কিন্তু নিগ্রোরা সেখানে গিয়ে যখনই দেখেছে এটা টাকা রোজগারের একটা ফাঁদমাত্র, তখনই তারা রাগ করে মুখ হতে থু থু ফেলে প্রদর্শনী হতে বের হয়ে এসেছে।

ইটালী দেশের প্রদর্শনীর বাড়িটার উপর একটি স্ত্রীমূর্তী। মূর্তীটির গড়ন বেশ সুন্দর। তারই পাশ দিয়ে একটি কৃত্রিম জলস্রোত বয়ে আসছে, যেন গংগা গোমুখী হতে নীচে নেমে আসছে। বাইরে সৌন্দর্যের বেশ সমাবেশ করা হয়েছে আর ভিতরে করা হয়েছে ঠকাবার সুবন্দোবস্ত। এটা আমি অথবা নিগ্রোরাই শুধু অনুভব করেনি। প্রদর্শনী দেখতে যারাই এসেছিল তারাই বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিল; এটা একটা ঠকের আড্ডা।

দক্ষিণ আমেরিকাতে আমি যাইনি। সেখানের রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধেও আমার কোন সংবাদ জানা ছিল না, তবে যে সকল দক্ষিণ আমেরিকাবাসী রেড ইণ্ডিয়ান প্রদর্শনী দেখতে এসেছিল তারা ইটালীয়ান প্রদর্শনীর প্রতি বড়ই খারাপ মত পোষণ করছিল। ইটালীয়ান মিশনারীরা তাদের দেশেও নাকি বেশ অন্যায় আচরণ করছিল এবং বাইবেল পরিত্যাগ করে তারা নাকি মুসলিনী প্রবর্তিত ফেসিজম্ গ্রহণ করে তাই প্রচার করছিল। মেকসিকো এবং ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে সসিয়েলিজমের অনেক প্রচার হওয়ার ফলে সেই দেশগুলিতে পুঁজিবাদীদের সমূহ ক্ষতি হয়েছে এই সংবাদটি আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছিলাম। এদুটি দেলের লোকই আবার প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিল বেশির ভাগ। তারাই ইটালীয়ানদের প্রদর্শনী দেখে নানারূপ খারাপ মন্তব্য করছিল্ প্রত্যেক প্রদর্শনীর দরজার সামনে একটা প্রকাণ্ড বই ছিল। সেই বইটিতে যার যা ইচ্ছা মন্তব্য লিখতে পারত। অনেকেই ইটালীয় প্রদর্শনীর বইএও নানারূপ মন্তব্য লিখেছিল। সেইসব মন্তব্য পাঠ করেই আমার উপরোক্ত ধারণা হয়েছিল। আমি যা লিখেছিলাম তা অতি অকেজো, কারণ আমি বিদেশে গিয়ে যখনই কোন বই-এ মন্তব্য লেখতাম তখন বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা ব্যবহার করতাম না। যদিও অপরের পক্ষে তা অকেজো, আমার পক্ষে কিন্তু তা বড়ই দরকারী হয়ে পড়ত। আমার লেখা দেখে অনেকে আমার পেছন নিত এবং জিজ্ঞাসা করত আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। যদি ইংলিশে মন্তব্য লেখতাম তবে হয়ত কেউ আমার দিকে চেয়ে দেখত না। বিশ্বমেলাতে অনেকদিনই গিয়েছি এবং অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু তা হল মেলা সংক্রান্ত বিষয়। এ বিষয় নিয়ে এখন আর বেশি বলা উচিত হবে না। আমি বিশ্বমেলা দেখবার জন্য সেখানে যাইনি আমি গিয়েছিলাম কালো লোকের প্রতি সোভিয়েটদের কিরূপ ব্যবহার তাই জানতে।

আজ ভারতের কথা আমেরিকার অল্প লোকই চিন্তা করে। যে সকল বকধার্মিক আমেরিকায় হিন্দুয়ানীর কথা বলে দুপয়সা করে খান তারা ভাল করেই অবগত আছেন তাদের অবস্থা আমেরিকায় কিরূপ? আমি এসম্বন্ধে কিছুই বলব না কারণ এসম্বন্ধে যদি বেশি বলতে যাই তবে এবিষয়েই একখানা বই লিখতে হবে। আজ আমেরিকায় ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পক্ষ হয়ে দুকথা যদি কেউ বলে তবে দুটিমাত্র সংবাপত্রের কথা আমি বলতে সক্ষম হব। সেই সংবাদপত্র দুটি হল পিপুলস্ ওয়ার্ল্ড এবং ডেলি ওয়ার্কার। কখন কখন আমরা আমেরিকার অন্যান্য সংবাদপত্রে ভারতের কথা শুনতে পাই, তা হল তাদের স্বার্থ কথা বলা, এর বেশি এসম্বন্ধে আর কিছু বলা চলে না।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.