
এখানে আসার পর দান্তে বলে এক ভদ্রলোকের সংগে পরিচয় হয়। তিনি পৃথিবীর যত পরাধীন জাত আছে তাদের সকলের জন্যেই দরদী। আমাকে পাওয়ার পর তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন এবং আমাকে অনেক লোকের সংগে পরিচয়ও করে দিয়েছিলেন। মি: দন্তের স্ত্রীর অনুরোধে তিনি একটি সভার আয়োজন করেন। সভা একটি কাফেতে হয়েছিল। সভাতে হাজার লোক হবে বলে অনেকেই ধারণা করেছিল। কাফের ম্যানেজার প্রচার করেছিলেন মি: রামনাথ একজন হিন্দু, তিনি অকালটিস্ট স্পিরিচুয়েলিস্ট, অথবা যাদুকর নন, তিনি একজন পর্যটক। তাঁকে হবো (Hobo) অর্থাৎ এডভ্যানচারার বলে যেন ভুল না করা হয়। এই কারণ লোক হয়েছিল অনেক। আমরা যখন সভাস্থলে উপস্থিত হলাম তখন সকলকে আমার আগমনী জানান হল। কথাটা শুনে অনেকেই আমার দিকে দেয়ে দেখল। দুঃখের বিষয় আমার মুখ দেখে কেউ সন্তুষ্ট হল না। শরীরের রং যথায় শিক্ষা দীক্ষার মাপকাঠি তথায় মনুষ্যত্বের স্থান হতে পারে না। অতি কষ্টে মি: দান্তে সভাস্থ সকলকে সান্ত¡না দিযে বললেন, যার যা প্রশ্ন তা লিখে রাখুন, বয়রা তা নিয়ে আসবে। অনেকে আমার রূপ দেখে প্রশ্ন করাটাও হেয় মনে করেছিল। যারা প্রশ্ন করেছিলে তাদের একটি কথার জবাব আমি দিয়েছিলাম। সেই প্রশ্নটির জবাব দিতে আমার আধঘণ্টা লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, ‘Blood preservation is nothing but barbarism. আমেরিকাবাসী যদি সে দোষে দোষী না হত তবে আজ হারলাম তৈরী হত না। শ্বেতকায়দের নিগ্রো-ভয় থাকত না।’ কিন্তু কথাটা বলার সংগে সংগেই মনে হল দেশের কথা। গীতা থেকে আরম্ভ করে সেনবংশ পর্য্যন্ত বর্ণ-শংকরদের ভয়ে অস্থির ছিলেন। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে যদি হরিজনের কথা বলি তবে এখানে তা অবান্তর বলেই গণ্য হবে। বিদেশে গিয়ে কিন্তু এসব কথা বলা চলে না। দেশের এবং জাতের মান ইজ্জত বজায় রাখতে গিয়ে হাজার মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। পৃথিবীর লোক ক্রমেই দেশ বিদেশের সংবাদ নানা ভাবে অবগত হচ্ছে। এরূপ মিথ্যা কতা বলার কোন মূল্য থাকিবে না। সময় থাকতে সংশোধন না করলে ভারতের দিকে কেউ সুদৃষ্টিতে চাইবে না। অতএব হুসিয়ার।
এসব কথা বাদ দিয়ে এখন আমেরিকার কথা বলাই দরকার। ইচ্ছা হল বিশ্ববিখ্যাত ওয়ালস্ স্ট্রীটটা একটি বেড়িয়ে আসি। ওয়াল স্ট্রীট আমার বাসস্থান হতে বেশি দূরে ছিল না। তবুও বাসে করেই রওয়ানা হলাম। বাস থেকে নেমেই পেলাম ওয়াল স্ট্রীট। ধীর পদে নিক্ষেপে সেদিকে হাটতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম এখানে বসেই আমেরিকার ধনীরা পৃথিবীর বাণিজ্য, সাম্রজ্যাবাদ এবং মনরো নীতির ভাষ্য করে থাকেন। শুধু এই স্ট্রীটটুকু দেখার জন্যই আমেরিকা ছাড়াও বিদেশ হতে অনেক লোক আসে।
ওয়ালস্ স্ট্রীট আমেরিকায় অন্যান্য যে কোন স্ট্রীট হতে অল্প পরিসর। এটাকে যদি গলি বলা হয় তবে বোধহয় দোষ হবে না। তবে একথা মনে রাখতে হবে, ভারতে ওয়ালস স্ট্রীটের মত একটিও স্ট্রীট নাই। তাজের তুলনা যেমন তাজই, ওয়ালস স্ট্রেটের তুলনাও শুধু ওয়ালস স্ট্রীটই। স্ট্রীটের দুদিকে উচ্চ প্রাসাদগুলি দাঁড়িয়ে আছে। পথে অনেক লোক চলেছে, কিন্তু কারো মুখে হাসি নাই। তারা খুবই চিন্তিত এবং বেশ অতর্কিতে পথ চলেছে। মাঝে মাঝে একের সংগে অন্যের ধাক্কাও লাগছে। কিন্তু তারা ব্যবসা চিন্তায় এতই তন্ময় হয়ে হাঁটছিল যে শিষ্টাচার সূচক ‘দুঃখিত’ কথাটা পর্যন্ত কারো মুখ হতে বার হচ্ছিল না। আমি এপথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলাম বলেই বোধ হয় অনেকের দৃষ্টি আমার দিকে পড়ছিল। ওয়ালস্ স্ট্রীট দেখতে আমি একা যাইনি আমার সংগে আরও তিনজন ভদ্রলোক ছিলেন। সংগের তিনজন আমেরিকান আমার পেছন পেছন চলছিলেন। একটা কালা আদমীর পেছনে তিনজন সাদা লোক হাঁটছে তা কম কথা নয়, এতে অনেকেরই জিজ্ঞাসু চোখ আমার উপর পড়ছিল। অনেকেই আমার সংগে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাথীরা তাতে বাধা দিচ্ছিল। শুধু জানিয়ে দিচ্ছিল আমি নিগ্রো নই, বিদেশী। ডিভাইন ফাদার যখন পথে চলেন তখন তাঁর সংগে অনেক সাদা লোকও চলে তাই অনেকে হয়ত ভাবছিল আমি নিগ্রো ধর্ম প্রচারক।
সংগের তিনজন আমেরিকানের পরিচয় এখনও দেইনি এবং কি করে তাদের সংগে আমার পরিচয় হল সে কথাই এখন বলছি। নিউইয়র্ক আসার কয়েকদিন পরই গরম শুরু হয়। গরমে উলের সার্ট ব্যবহার করতে কষ্ট হচ্ছিল। শুনছিলাম নিউইয়র্কএ দোকানীরা পর্যন্ত নিগ্রোদের সংগে সৎব্যবহার করে না। দোকানীরা যাতে আমার সংগে সৎব্যবহার করে এবং আমাকে নিগ্রো না ভাবে সেজন্য মাথায় পাগড়ী বেঁধে পথে বের হব ঠিক করলাম। গরমের সময় দুপুর বেলা অল্প লোকই পথে বের হয়। তা বলে মনে করা উচিত নয় যে পথে লোক চলাচল একদম বন্ধ হয়ে যায়। পাগড়ী বেঁধে পথে বের হতে আমার মোটেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। বের না হলে নয় বলে একটা আংশিক নির্জনপথে চলাই ঠিক করলাম। পঞ্চম এ্যাভেনিউ তে না গিয়ে অষ্টম এ্যাভেনিউতেই যাওয়া ঠিক করলাম। পথে বের হয়ে কতকদূর যাবার পরই ইহুদী এবং আরবগণ ‘প্রিস্ট, প্রিস্ট’ (ধর্ম পুরোহিত) বলে চিৎকার করতে লাগল্ তাদের এড়িয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। একটু এগিয়ে যাবার পর তিনটি আমেরিকান যুবতী আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং তাদের হাত দেখে যদি তাদের ভাগ্য বলতে পারি তবে প্রত্যেকে একটি করে ডলার দিবে সে লোভও দেখাল। তাদের কথায় আমি থমকে দাঁড়ালাম। তারা কি চিন্তা করে তিন ডলারের তিনখানা নোট আমার হাতে দিতে চাইল। তাদের ডলার ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তারা আমেরিকান না ইউরোপীয়ান? যুবতীরা বলল তারা আমেরিকান এবং হিন্দু একাণ্টটিস্ট, স্পিরিচুয়েলিস্ট পামিস্ট এসবরে উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। তাদের কথা শুনে আমি বললাম এসব আমি মোটেই বিশ্বাস করি না, তারা ইচ্ছা করলে আমাকে রেহাই দিতে পারে। মেয়েরা বলল, ‘আমেরিকাতে হিন্দু এবং ইউরোপীয় জিপশীরা এসব করেই দুপয়সা রোজগার করে, আপনি তা থেকে বাদ যেতে পারেন না, এসব যদি আপনি না জানেন বলে তবে নিশ্চয়ই আপনি হিন্দু নন।’
‘আপনাদের কি ধারণা যে আমরা এসব করেই দিন কাটাই? মহাত্মা গান্ধির নাম শুনেছেন কি?’
‘হা শুনেছি তিনি একজন ফকির ছাড়া আর কিছুই নন।’
মেয়ে তিনটিকে কাছে ডেকে এনে বললাম, ‘আপনারা হিন্দুদের সম্বন্ধে যে ধারণা করে রেখেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। হিন্দুদের মাঝে অনেক লোক আছেন যারা আপনাদের চেয়ে কম সভ্য নন। শিক্ষায় দীক্ষায় এমন অনেক হিন্দু আছেন যাদের সংগে আপনাদের দেশের অতি অল্প লোকেরই তুলনা করা যেতে পারে। এখন আপনারা পথ দেখুন।’ আমি এখন হতে আর পাগড়ী ব্যবহার করব না, এতে লোকে যদি আমাকে নিগ্রো ভাবে অপব্যবহার করে তাও মাথা পেতে নিব। যখন আমি মেয়ে তিনটির সংগে কথা বলছিলাম তখন উল্লিখিত ভদ্রলোক তিনজনের একজন আমার সংগে পরিচয় করেন এবং পরে অন্য দুজন এসে যোগ দেন।
আমেরিকায় দুটি রাষ্ট্রনৈতিক দল আছে। এই দুটি দলের মাঝে কখনও মতের মিল দেখা যেত না। এক দল অন্য দলকে টেক্কা দিয়ে নতুন কিছু করে জনসাধারণের সহানুভূতি অর্জন করত। এতে ফল ভালই হত। আমেরিকার পরিষ্কার এবং সুন্দর পথ ঘাট, বাড়ি ঘর, আর্থিক এবং নৈতিক উন্নতি তারই ফলে গড়ে উঠেছিল। আমেরিকার পূজিবাদীরা ভেবে দেখল, এরূপ দলাদলির ফলে তাদের বেশ ক্ষতি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তাদের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এদিকে আমেরিকান কনস্টিটিউসন মতে এরূপ দল ভেংগে দিবারও অধিকার তাদের ছিল না। তাই তারা একটু নতুন পথ অবলম্বন করল। সে পথটি হল জনমতের প্রতিনিধিদের বশীভূত করে রাখা। কি প্রকারে সে কাজটি হয় তা এখানে বলার বিষয় নয়। আমি শুধু জেনেছিলাম এবং বেশ ভাল করে বুঝেছিলাম যে আমেরিকা জনপ্রতিনিধির অনেকেই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ওয়ালস স্ট্রীটের বশীভূত এবং ওয়ালস স্ট্রীটের ধনীরাই আমেরিকার কাজ কর্মের চাবিকাঠি তাদের মুঠার মাঝে রেখে দিয়েছে। দুদিকের দৃশ্যবলী দেখার জন্য ওয়ালস্ ষ্ট্রীটে আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে চলতে লাগলাম। বড় বড় বিল্ডিংগুলি দেখে সেখানে কি হয় না হয় তার কিছুরই সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই সাথীদের একটি পাবলিক স্থানে নিয়ে যেতে বললাম। সেয়ার মারকেট কাছেই ছিল, আমরা সেয়ার মারকেটের হলঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম। হলঘরে তখন অনেক লোক দাঁড়িয়ে বেচাকেনা করছিল। সেয়ারের দাম ক্রমাগতই নামছিল এবং বাড়ছিল। আমি সেয়ারের দাম উঠা নামার দিকে একটুও তাকাচ্ছিলাম না, শুধু লক্ষ্য করছিলাম লোকের আচার ব্যবহার, কারণ আমেরিকায় যাবার পূর্বে একদিন বোম্বের সেয়ার মারকেটে গিয়ে কতকগুলি পাগল দেখে ভয় হচ্ছিল এদের হাতেই যাদি আমাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিতে হয় তবে বড়ই বিপদে পড়তে হবে। সুখের বিষয় ওয়ালস স্ট্রীটের সেয়ার মারকেট সেরূপ নয়। এখানে শৃংখলা বিরাজমান। ক্রেতা এবং বিক্রেতাগণ ধীরে কথা বলছিল। এক দলের কথার শব্দ অন্য দলের কানে পৌঁছছিল না। এটাকেই বলে ইউরোপীয় সভ্যতা। এখানে একে অন্যের সুযোগ এবং সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখেই কাজ করে। বম্বেতে সেরূপ কিছুই নাই।