আজকের আমেরিকা (১৬) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

আমাকে দেখতে পেয়েই কতকগুলি লেয়ার বিক্রেতা কাছে আসল এবং শেয়ারের ফর্দ্দ হাতে দিয়ে শেয়ারের গুণাগুণ বলতে লাগল। তাদের কথায় বাঁধা দিযে বললাম আমি এখানে ব্যবসা করতে আসিনি। ব্যবসায়ীরা কেমন ব্যবসা করছে তাই দেখতে এসেছি, আমি একজন ভারতীয় পর্যটক মাত্র। আমাকে ঠাট্টা করে একজন বলল, ‘যদি আজ লক্ষ খানেক ডলার রোজগার করতে পারি তবে আমিও আপনার মত পর্যটক হব।’ আমি বেশিক্ষণ এদের কাছে না দাঁড়িয়ে সাথীদের নিয়ে হলঘর হতে বেড়িয়ে পড়লাম। ওয়ালল স্ট্রীটে এমন কিছুই ছিল না যা দেখে আমার আনন্দ হতে পারে, তাই সাথীদের নিয়ে হলঘর হতে বেড়িয়ে পড়লাম। ওয়ালল্ স্ট্রীটে এমন কিছুই ছিল না যা দেখে আমার আনন্দ হতে পারে, তাই সাথীদের নিয়ে ওয়ালস্ ষ্ট্রীট পরিত্যাগ করে অন্যত্র আর কিছু দেখার মত আছে কিনা তা দেখাতে বললাম।

লোকে ওয়াশিংটন দেখতে যায়। আমি কিন্তু সেদিকে পা বাড়াইনি সেখানে যেয়ে লাভ কি? ওয়াশিংটনে কি হবে কি না হবে তা ঠিক হয় ওয়ালস্ স্ট্রীটে। এখানে থেকেই আমেরিকার গতিপথ দেখা ভল। শহর হিসাবে ওয়াশিংটন আবার দেখা উচিত ছিল, কিন্তু দক্ষিণ দিকে বর্ণবিদ্বেষ এতই প্রবল যে তাল সামলাতে পারব না বলেই সেদিকে পা বাড়াইনি।

যে সকল ভারতবাসী ভারতের বাইরে যান তাদের প্রত্যেকের উচিত বিদেশীর সহানুভূতি অর্জন করা। সেরূপ সহানুভূতি অর্জন করতে হলে অর্থ এবং সময়ের দরকার। আমার কিন্তু এদুটার কোনটাই ছিল না। তবে যারা বিদেশে আড্ডা গেড়ে বসেছেন এবং দেশসেবাই যাদের একমাত্র কাজ, তারা না করতে পারেন এমন কাজ নাই। লোকমুখে শুনেছি, মি: হরিদাস ও মোবারক আলী এবং আরও কয়েকজন ভদ্রলোক আমেরিকাতে ভারতবাসীর জন্য বেশ খাটছেন, এমন কি তারা নিজের খেয়ে জংগলের মোষ পর্যন্ত তাড়াতে কসুর করছেন না। আর্ল বলডুইন যখন আমেরিকায় লেকচার দিতে গিয়েছিলেন তখন এই দুটি ভদ্রলোক নাকি আর্ল মহাশয়ের প্রত্যেক লেকচারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন।

অনেক চিন্তা করে দেখলাম হারলামে থাকা উচিত হবে না। এদিকে আমার সংগে যে সামান্য অর্থ ছিল তারও একটা সুব্যবস্থা করতে হবে, তাই একদিন বাড়িওয়ালীর মেয়েকে সংগে নিযে একটি ব্যাংকে গেলাম। ব্যাংক ম্যানেজার ইংলিশম্যান, তিনি আমাকে নিগ্রো দুহিতার এক সংগে দেখে কিছুই মনে করলেন না, কিন্তু তার অন্যান্য সহকারীরা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিগ্রোরা কোন ব্যাংকে গিয়ে চেয়ারে বসতে সাহস করে না। আমি অভ্যাসবশেই একটা চেয়ার টেনে বসলাম এবং সংগের নিগ্রো মেয়েটিকেও অন্য একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।

ম্যানেজার আমার সংগে কথা বলে একজন সংবাদপত্রের নিপোর্টারকে ডাকলেন। রিপোর্টার আমার দেশ এবং আমার সম্বন্ধে অন্যান্য সংবাদ নেবার পর জিজ্ঞাসা করলেণ এমেরিকায় সাইকেলে বেড়িয়ে আমার কি লাভ হবে? আমি রিপোর্টারকে বললাম ‘এদেশ দেখাই আমার কর্তব্য, দেশে গিয়ে এদেশ সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে পারব। এরই মাঝে বুঝতে পেরেছি, যে সকল ধারণা আমার দেশের লোক আপনাদের দেশ সম্বন্ধে পোষণ করে তা মোটেই সত্য নয। এদেশেও ডিমক্রেসী নাই। এদেশেও লোক অভুক্ত অবস্থায় থাকে। ডিমক্রেসী যে সকল দেশে বর্তমান আছে সেখানে কেউ উপবাস করে না। সোভিয়েট চীন, সোভিয়েট রুশিয়ার তো কেউ উপবাস করে না। সকলেরই কাজ করার অধিকার আছে এবং সকলেই কাজ করছে। পুঁজিবাদীরা মুখে বলে তারা ডিমক্রেটিক, আসলে কিন্তু তারাও এক ধরনের ফেসিস্থ।’ এসব কথা বলাতে রিপোর্টারের সন্দেহ হল আমি ইন্টার ন্যাশনেল কমিউনিস্ট দলের একজন সভ্য। লোকটির ভুল ভেংগে দিয়ে বললাম, ‘আমি কোন দলের লোক নই, আমি একজন পর্যটক মাত্র। তবে অনেকদিন দেশ ভ্রমণ করে খাঁটি ডিমক্রেসীর সন্ধান পেয়েছি বলে এসব কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। আমরা শুনেছি আমেরিকার সকলই ধনী, এখানে এসে দেখলাম বেকার মজুরের সংখ্যাও উপেক্ষা করার মত নয় এবং মজুরীর দামও কমতে আরম্ভ করেছে। তবে একটি কথা শুনে সুখী হবেন মি: রিপোর্টার, আপনারা এদেশে যত উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন অন্য কোন দেশ সেরূপ উন্নতি করতে সক্ষম হয়নি। আমি আপনাদের দেশের খারাপ দিকটা দেখার জন্য আসিনি, আমি এসেছি আপনাদের দেশের ভালর দিকটা দেখতে।’

সংগের নিগ্রো মেয়েটি আমার কথা শুনছিল আর ভাবছিল। সে চেয়ারে বসে থাকতে পারছিল না। তার দুর্দশা দেখে ব্যাংকের কাজ শীঘ্র শেষ করে বাইরে এসে তাকে বিদায় দিলাম। সে বিদায়ের বেলা বলল, ‘সত্বর ফিরে এস, আমি তোমার কথা আজই আমার বন্ধু মহলে প্রচার করব।’ মেরীকে বিদায় দিয়ে এবার আমি সুস্থ মনে পথে বেড়াতে লাগলাম।

নিউইয়কৃ নগরের ঠিক মধ্যস্থলে একটি পার্ক আছে তাকে বলা হয় সেণ্ট্রেল পার্ক। সেই পার্কটি দেখতে বড়ই ইচ্ছা হল। তারপর এ রৌদ্রে কোথায়ই বা আর যাই? সেণ্ট্রেল পার্কে গিয়ে সেই পার্কে বেড়াতে লাগলাম। পার্কটি বেশ বড়। গড়ের মাঠের দ্বিগুণ ত হবেই। তাতে নানারূপ বৃক্ষ। বৃক্ষগুলি সাজানো। মাঝে মাঝে সরোবর আছে। সরোবরে বেলে হাঁস এবং অন্যান্য পাখী এসে বিচরণ করে। মাছও সরোবরে প্রচুর রয়েছে। কিন্তু এখানে সুযোগমতে যদি দুষ্ট লোক কাউকে পায় তবে তাকে হত্যা করে যথাসর্বস্ব হরণ করে। এখানে এসে একজন সিলেটি ভদ্রলোকের সংগে পরিচয় হল। পরিচয় জানলাম তাঁর বাড়ি আমার গ্রাম হতে বার মাইল দূরে। দেশে তিনি মোল্লার কাজ করতেন, এখন তিনি একজন পাকা কমিউনিস্ট। তিনি আমাকে পেয়ে যত আনন্দ পেলেন, আমি তার চেয়ে বেশী আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি যখন আমার পরিচয় পেলেন তখন তাঁর চোখগুটো লাল হয়ে উঠল। তিনি কি কতকগুলো কথা বললেন তার একটাও বুঝলাম না, বোধ হয় হিব্রু ভাষায় কতা বলছিলেন। তার পর তিনি আমাকে একটা রেঁস্তোরায় নিয়ে যান। রেঁস্তোরায় খাবারের যা অর্ডার করলেন তা শুনে অবাক হলাম। খাবার এলে বললেন, ‘গরু গরুই, দেবতা নয়, শূকরও তাই। খেয়ে হজম করতে পারবে তো ঠাকুর?’ আমি নীরবে সবই গলাধকরণ করলাম। কথায় কথায বললেন, ‘মি: প্যাটেল এসেছিলেন। লোকটি ভাল, কিন্তু পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদী বুদ্ধি আর স্বভাব, যতদিন সুযোগ ও সুবিধা থাকে ততদিনই বজায় থাকে, সহজে যায় না।’

আমাকে তিনি তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন না, নিয়ে গেলেন ‘ইনটার ন্যাশনাল’ নামীয় একটি হোটেল। যত রাজ্যের কমিউনিস্ট এই হোটেলটাতে বাস করে। কয়েকজন লোকের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েই তিনি হল ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘কমরেডগণ, এই লোকটার আমার দেশ থেকে দুদিন পূর্বে এসেছে, একদম তাজা। এর সংগে কথা বলে বুঝতে পারবে ভারতে আমাদের কি অবস্থা। যদি পার তো কয়েক দিনের মধ্যে এটাকে মানুষ তৈরি করে ফেল।’ পংগপালের মত অনেক লোক নীচে নেমে এল, তাদের মধ্যে ছিলেন দুজন ভারতীয় ছাত্র। কর্পুরতলার মহারাজা আমেরিকায় এসেছেন, তাঁরই কতা অনেকক্ষণ ধরে চলল। তারপর আমাকে জিগ্গাসা করা হল আমি তাঁরই দলের একজন কি না। মোল্লা মশায লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘না হে, লোকটা পেটি বুরজোয়া, আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি। আমার জন্ম হয়েছে কৃষকদের মাছে, আর ওর জন্ম হয়েছে প্রকৃত পরশ্রমজীবিদের মাঝে। আমাদের রক্ত খেয়ে ওরা বাঁচে, তাই দেখাতে এনেছি এদের আকৃতি প্রকৃতি দেখতে কেমন এদেশে যেমন এরূপ জীবের অভাব নাই, আমাদের দেশেও তেমনি সেরূপ জীবের অভাব নাই।’

কমিউনিজমের আস্থা থাকলেও এরূপ ক্ষেত্রে মন বিরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এদের কথা শুনে আামর মনের পরিবর্তন হয়েছিল, কিছুই ভাল লাগছিল না। এমনি যখন মনের অবস্থা তখন জর্জিক জাহাজাজের একজন অফিসার এসে হাজির হলেন। তাঁকে দেখেই চিনতে পারলাম; তিনিও আমাকে চিনতে পারলেন। দুজনায় একটু কথা হল, তারপর তিনি আমাকে ‘কমরেড’ রূপে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলের মুখের ভাব বদলে গেল। এইবার আমার পালা। মোল্লা মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এমন অশিষ্টাচার করে মানুষকে দলে টানা যায় না। লোককে রাগাতে নাই, বুঝাতে হয়। লোক বুঝুক, তারপর আপনিই বলে বসবে। যারা বুঝেও আসবে না, আজ আমর জন্য যে ব্যবস্থা করেছিলেন সেই ব্যবস্থা তাদের জন্য করতে পারেন। ধর্ম প্রচার এবং কমিউনিচম প্রচার এক নিয়মে হয় না। মনে রাখবেন, ধর্মপ্রচারের পিছনে রাজশক্তি থাকে, কিন্তু কমিউনিজম প্রচারের পিছনে রাজশক্তি থাকে না। কাজেই এরূপ ক্ষেত্রে, কাজে সফল হতে হলে ধৈর্যের দরকার, সাহসের দরকার, সহিষ্ণুতার দরকার। মোল্লা সাহেব, যাকে দলে টানবেন তাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিবেন, শত্রু বলে নয়।’

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.