
অনেক কথা বলে গভীর রাত্রে যখন ফিরছি, মোল্লা সাহেব আমাকে তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেশের লোক কি এখনও বোঝে না যে, তাদের সুখ-শান্তি নাই, সুযোগ-সুবিধা নাই?’ আমার বলার মত আর কিছুই ছিল না। সবিনয়ে মোল্লা মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। পরের দিন একশত আট স্ট্রীটের পূর্বদিকে একটী রুম ভাড়া করে চলে গেলাম। এখানে সবাই সাদা। সাদা লোকের কাছে না থাকলে নানারূপ অসুবিধা হয়। এখানে এসেই নিজের পরিচয় দিয়ে, নানারূপ বিষয় জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্থান পরিবর্তন করার পরই এমন অনেক লোকের সংগে দেখা হল যাতে নিউইয়র্কে পথ প্রদর্শকের অভাব হল না।
অনেকেই হয়ত শুনেছেন আমেরিকার লোক ধনী। আমারও সেই ধারণা ছিল। আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরে কয়েক সপ্তাহ থাকার পরই নিত্য নূতন সংবাদ আমি পেতে লাগলাম। শ্রীহট্ট নিবাসী আমেরিকা প্রবাসীরা এবং অন্যান্য প্রবাসী ভারতবাসীরা আমাকে মিস মেয়ো লিখিত বই এর একটা পাল্টা বই লিখতে বললেন এবং সেই অনুযায়ী নানা স্থানের এবং নানা লোকের সংগে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। যে যা বলতেন সব কিছুতেই আমি সম্রাট নাসিরউদ্দীনের মত ‘তাই হবে’ বলে সায় দিতাম, কিন্তু আমার মনের কথা কারও কাছে বলতাম না। ঠিক কররেছিলাম, আমেরিকাতে ভাল যা কিছু দেখব দেশে গিয়ে তারই কথা বলব। আমেরিকার দোষের কথা স্বদেশবাসীর কাছে বললে তাতে আমেরিকার ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে আমাদেরই।
টাইম্স স্কোয়ার নিউইয়র্ক-এর একটি প্রসিদ্ধ স্থান। টাইমস্ স্কোয়ার দুই ভাগে বিভক্ত, আপ ও ডাউন। আমাদের কথায় বলব পাতালপুরী এবং আকাশ পুরী। মর্ত্য বা উপরের ৪২ নং স্ট্রীট ও ৫ নং এভিনিউ এর সংযোগ স্থলে দিনরাত লোকের ভিড় লেগে থাকে। এমন ভিড় কলকাতার কোথাও দেখা যায় না। জনতা নিয়ন্ত্রণের নিয়মকানুন সর্বসাধারণ দ্বারা শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সংগে প্রতিপালিত হয়। এতে জনতার সকল রকমের সুবিধা হয়। ফুটপাথে যারা চলে তারা একে অন্যকে বাঁয়ে রেখে চলে। আলোর সাহায্যে ট্রাফিক নিমন্ত্রণ হয়; অবশ্য পুলিশও থাকে। পুলিশ দুরকমের। যারা পুলিশের সাধারণ পোষাক পরে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, পথচারীদের নানা বিষযে সাহায্য করে তাদের ছাড়াও আর একরকমের গুপ্ত পুলিশ আছে। তাদের দেখি নি তাদের কথা শুনেছি মাত্র। তারা গুপ্ত পুলিশ, ওদের বলা হয় ‘জিম্যেন’; তাদের পোষাকের কোন বিশেষত্ব নাই। সাধারণ পোষাক পরেই তারা অপরাধীর সন্ধান করে বেড়ায়। শুনেছি, পথচারীদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা করে, ওরা তাদের কাছে ঘেঁষে না। ওদের ধারণা যারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় তারা পকেটমার জাতীয় নিকৃষ্ট জীব হতে পারে না।
এইবার পাতালের কথা বলছি। লণ্ডনের মত এখানেও ভূগর্ব রেলপথ আছে। কিন্তু লণ্ডনের চেয়ে লোকের চলাচল বেশী এবং স্টেশনগুলিও তুলনায অনেক বড়। টাইমস স্কোয়ার-এর স্টেশনের সংগে চেয়ারিং ক্রসের তুলনা হতে পারে না। টাইমস স্কোয়ার হাওড়া স্টেশনের দ্বিগুণ। লোক চলাচল উপরে যেমন, নীচেও তেমনি। গাইড আছে, সে পথের সংবাদ দেয়। ডলারের ভাংগানি নিয়ে কয়েকটী লোক বসে থাকে, তাদের কাছে একশত ডলারের নোটও ভাংগানো যায় এবং তার জন্য কোন রূপ বাট্টা দিতে হয় না। সুবিধা সব রকমে বিরাজ করছে। একটা দেখবার মতন জায়গা বটে। সেখানে গিয়ে অন্তত চার ঘণ্টা কাটালে স্থানটি কিরূপ তার কিছুটা বুঝতে পারা যায়।
জায়গাটার কিন্তু বদনাম আছে। কয়েক দিন নানা লোকের সংগে সেখানে যাওয়া আসা করছিলাম, পরে একদিন একাকী গিয়ে বুঝতে পারলাম বদনাম যা আছে তা সত্য বটে। এই স্থানটি দেখে মনে হল মিস মেয়োকে গিয়ে বলি, তিনি যেমন ভারতবর্ষের নর্দমা ঝাঁট দিয়ে বই লিখেছিলেন তেমনি হারলামের কোণ থেকে আরম্ভ করে টাইম্স্ স্কোয়ারের বুক পর্যন্ত ঝাঁট দিয়ে যদি বই লিখতেন তবেই বলতাম তিনি স্বাধীন লেখিকা। কিন্তু দেখা হয় নি। মুনলাম তিনি কোনও হিন্দুর (অর্থাৎ ভারতবাসীর) সংগে সাক্ষাৎ করেন না।
মর্ত্য আর পাতালের কথা বলছি, এইবার স্বর্গ বা আকাশের কথা বলি। গংগা নদীর উপর একটা পুল আছে–সেরূপ পুল যদি হাওড়া থেকে আরম্ভ করে চন্দননগর পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয় এবং তার উপর যদি বোম্বাইএর মত ইলেকট্রিক ট্রেন চলে তবে তা দেখতে যেমন হবে, এলিভেটরও ঠিক সেরূপ। এলিভেটরের উপর লিফটএ করে ওঠা যায়, পায়ে হেঁটে উপরে উঠার সিঁড়িও আছে। যাদের ভুঁড়ি মোটা তাদের পায়ে হেঁটে এলিভেটরে উঠতে দেখা যায়। অনেকের বিশ্বাস হেঁটে এলিভেটরে উঠলে পেট কমে। টাইমস স্কোয়ারের কাছে, এলিভেটরের স্টেশনে বিকাল বেলা এবং রাত্রি দুটার পর ভয়ানক ভিড় হয়। এখানে নূতন জীবনের স্বাদপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণীরই ভিড় বেশী।
নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি, এই তিনটি মাস নিউইয়র্ক নগরের গরিব লোকের পক্ষে বড়ই কষ্টকর সময়। যাদের ঘরভাড়া দিবার ক্ষমতা থাকে না, শীতে তাদের বড় কষ্ট হয়। শীত মানুষকে যেমন পরিশ্রমী করে তেমনি শক্তিহীনও করে দেয়। যাদের শক্তিহীন করে দেয়, তারাই বিপদে পড়ে। শীতের তীব্রতায় পথে আশ্রয়ের সন্ধানে হেঁটে যখন একেবারে কাতর হয়ে পড়ে তখন সেই ধনী দেশের গরিব লোকেরা আণ্ডার গ্রাউ- রেলওয়েতে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। পাতাল শীতের সময় গরম থাকে। কিন্তু খাবার খেতে তাদের আবার মাটির উপর উঠে আসতে হয়। উপর নীচে যাওয়া আসা করতে দশ সেণ্টের দরকার। অথচ দশ সেণ্ট খরচ করলে ছোটখাট গরিব-হোটেলে রাত কাটান যায়। তবু গরিবেরা পাতাল প্রবেশ করে, শুনেছি শীত ছাড়া আরও কারণ আছে। কিন্তু সেকথা আমার বলে দরকার নাই, মিস্ মেয়ো যদি তা বলতেন তবেই ভাল হত। শোনা যায় আমেরিকায় এই শ্রেণীর গরিবদের মনের গতি তত ভাল নয়।
আমেরিকায় বেকারদের জন্য সাপ্তাহিক খাইখরচ বাবদ সাহায্য দেওয়া হয় কিন্তু মনে রাখা উচিত, সাহায্য সহজলভ্য নয়, তাতে সুপারিশের দরকার হয়। তাছাড়া নাগরিকের অধিকার না থাকলে এ সাহায্য পাওয়া যায় না। সুপারিশ ও নাগরিকের অধিকার লাভ ভারতবাসীর পক্ষে যেমন কষ্টকর, ই্উরোপীয়দের পক্ষে তত কষ্টকর না হলেও সহজে তারাও নাগরিক হতে পারে না। এ এক বড় বালাই। গরিবদের বিক্ষোভের পুনজীভূত ধূমরাশি উর্ধাকাশে উঠছে, এখন বাকী শুধু অগ্নির সনচার; হয়ত একদিন অনুকুল বাতাসের সনচার হবে এবং আগুনও দেখা দিবে। তখনই প্রকৃতভাবে আমেরিকায় ‘বাই দি পিপুল, ফর দি পিপুল, অপ দি পিপুলের‘ স্বরূপ বিকশিত হবে।
গত বৎসরের হিসাব মতে আমাদের দেশের লোক আমেরিকায় মাত্র তিন হাজার ছিল। নিউইয়র্ক, ডিট্রয়, স্টকটন, লুগাই ও ইমপিরিঅ্যাল ভ্যালিতেই তারা থাকে। অন্যান্য স্থানে যে দু-একজন আছে তাহারাও উক্ত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত তবে তাদের সংগে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এখন আমি আর সকলের কথা ছেড়ে দিযে নিউইয়র্ক-এর ভারতীয়দেরই কথা বলব।
নিউইংর্ক-এর হিন্দুদের সংখ্যা পাঁচ-শ থেকে ছয়-শ; এর মধ্যে বাংগালীম মুসলমানই শতকরা নব্বইজন। বাকী দশজন অন্যান্য ভারতবাসী। তাতে পানজাবী, পাসরী, বাংগালী হন্দিু, সিংহলীও আছে, এবং তারা প্রত্যেকেই দেশ থেকে ভাল রকম লেখাপড়া শিখেই গিয়েছিল। বাংগালী মুসলমানরা আমেরিকাতে নাবিক হয়ে যায় এবং জাহাজ থেকে পলায়ন করে চিরতরে আমেরিকায় বসবাস করবার চেষ্টা করে। যে কয়জন শিক্ষিত লোক আমেরিকায় গিয়েছে তারাও ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। আমেরিকা সরকার বর্তমানে একটা আইন পাশ করেছেন। যে সকল বাদামী (Brown) ও হলদে (Yellow) বিদেশী ১৯২১ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে আমেরিকায় পৌঁছেছিল তারা অর্ধ-নাগরিকরূপে গণ্য হবে। অর্ধ-নাগরিকের মানে হল তাদের নির্বাসন (Deportation) দেওয়া হবে না। আমেরিকার নাগরিক হলে যে সুবিধা পাওয়া যায় সে সব সুবিধা অর্ধ-নাগরিকরা পাবে না; তবে মাত্র আমেরিকায় থাকতে পারবে। এরা কাজকর্ম পায় না। আমেরিকার নাগরিকরা যেমনভাবে কাজ পেয়ে থাকে এদের সে অধিকার নাই। এরূপ অর্ধ নাগরিক হওয়া কত কষ্টকর তা যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁরাই ভাল করে জানে।