আজকের আমেরিকা (১৮) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

যাঁরা সমুদ্রে বেড়িয়েছেন অথবা নাবিকের সংগে কথাবার্তা বলেছেন তাঁরা হয়ত ভাল করেই জানেন কয়লাওয়ালা, আগুনওয়ালা, খালাসী ও তেলওয়ালা জাহাজে কি কঠোর পরিশ্রম করে। এ সকল চাকরি পেতে এবং তা বজায় রাখতে তাদের তিন মাসের মাইনে সারেংকে দিতে হয়। এইভাবে দিয়ে থুয়ে এবং নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা যখন আমেরিকার বন্দরগুলিতে গিয়ে উপস্থিত হয় তখন স্বতঃই তাদের পালিয়ে যাবার ইচ্ছা হয়। কিন্তু পালিয়ে যাবার পথ সুগম নয়। প্রথমত আমেরিকার বন্দরগুলিতে ভারতীয় নাবিকদের অবতীর্ণ হবার পাশই খুব কম দেওয়া হয়। তারপর যারা পাশ পেয়েও যায়, তারা যখন তীরে নামে, তখন হয় সারেং নয় টেণ্ডল তাদের সংগে থাকে। সারেং, টেণ্ডল সংগে থাকলে পালিয়ে যাওয়া অতীব কঠিন। তা ছাড়া সারেং ও টেণ্ডলগণ সদাসর্বদা নাবিকদের ‘কাফের’ এর দেশে থাকতে মানা করে এবং আমেরিকায় যদি থেকে যায় তবে মরলে পরে নরকে যাবে বলে ভয় দেখায়। অনেকে পালাবার সুযোগ পেয়েও নরকে যাবার ভয়ে পালায় না। যারা নরকের ভয় পায় না, এবং সুযোগ পায়, তারাই পালায়। অনেকে আমার কাছে বলেছে তথাকথিত স্বর্গ মানুষের কল্পিত, বাস্তব স্বর্গে কিছুদিন বসবাস করে পরে নরকে গেলে দুঃখ করার কিছুই থাকবে না। ভারতীয় মজুরগণ আমেরিকাকে খাটি স্বর্গ বলেই ভাবে। বাস্তবিক আমেরিকার বাসগৃহ, পথ ঘাট স্বাস্থ্যবিধান, শিক্ষা প্রভৃতি আমাদের পক্ষে অনেকটা আমাদের দ্বারা কল্পিত স্বর্গেরই মত।

পূর্বেই বলেছি আমেরিকার ডক থেকে বার হতে গেলে চুরি করে বার হওয়া যায় না। তবুও আমাদের দেশের লোক পালায়। আল্লা তাদের হৃদযে ভক্তি দিয়েছেন, বাহুতে শক্তি দিয়েছেন, মগজে বুদ্ধি দিয়েছেন। আমার মনে হয়, পৃথিবীর লোক যা করতে পারে না, আমাদের দেশের লোক যদি সুযোগ ও সুবিধা পায় ত তাও করতে পারে। আমি এখন পূর্ববর্ণিত মোল্লা সাহেবের পলায়ন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বলছি।

রাত্রি তখন তিনটা। নদীতে তখন ভাঁটা পড়েছে। মোল্লা সাহেব রান্নাঘর থেকে বড় বড় দুটা তামার হাড়ি বার করে রশি বেঁধে জলে ছেড়ে দিয়ে সেই রশি ধরে নিঃশব্দে নদীতে নেমে পড়লেন। তারপর ভেসে চললেন সমুদ্রের দিকে। শীতের সময় জলে থাকা কত কষ্ট তা বোঝান কঠিন। সেদিন বোধহয় তাপমান যন্ত্রে এক কি দুই ডিগ্রি উত্তাপ ছিল। মোল্লা সাহেবের শরীর অবশ হতে লাগল, আল্লাকে স্মরণ করে, তিনি ভেসে চললেন। মোল্লার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল। অবশেষে মৃত্যুর হাত ধরেই তিনি তীরে গিয়ে ভিড়লেন।

নদীতীরে লোকজন ছিল না, নদীর তীর নীরব এবং নিস্তব্ধ। মোল্লা সাহেব তীরে উঠে শরীরটাকে ঝেড়ে অবসন্ন পায়ের উপর সাহস করে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ডক থেকে বার হয়ে একটা কাঁফেতে গিয়ে এক গিনি ফেলে দিয়ে কাফি চাইলেন। কাঁফের মালিক এরূপ লোক অনেক দেখেছে, অনেক সাহায্যও করেছে। মোল্লার প্রতি তার দয়া হল এবং একটি ঘরে নিযে দিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে, খাইয়ে, ঘরের উত্তাপ বাংলা দেশের উত্তাপের মত করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মোল্লা পরম আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে উঠেই মোল্লা বুঝলেন তার সাহায্যকারী গতরাত্রে তাকে প্রথম নম্বরের হারাম ‘সরাব’ খাইয়ে দিয়েছিল। এতে তার ভয়ানক রাগ হয়। প্রাণদাতা বন্ধুকে মোল্লা ‘কাফের’ বললেন তারপর তার ঘর পরিত্যাগ করলেন। পথে অনেক স্বজেলাবাসীর সংগে দেখা হল। কাফের ও কাফেরী কাজের কথা বলার সংগে অকপটে নিজের পলায়ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। এমন কি কোন জাহাজ হতে পালিয়ে এসেছেন তাও বলে দিলেন। মুসলমান ভাইএর কাছে সত্য না বললে পাপ হবে ভেবেই বোধহয় মোল্লা সাহেব সত্য কথা বলেছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই যেদিন লোকটির একটু চৈতন্য হল সেদিন বুঝলে আমেরিকা থেকে বিদায় করে দেবার জন্য পুলিস তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং এই বিপদের মূলে আছে তাঁরই মুসলমান জাতভাই, সেইদিনই তাঁর মনে এক বিদ্রোহী ভাবের সৃষ্টি হয়। তিনি নাম পরিবর্তন করলেন, দাড়ি গোঁফ মুণ্ডন করলেন, কাফেরী টুপি মাথায় দিলেন, ইংলিশ শেখবার জন্য নৈশ বিদ্যালযে যেতে লাগলেন, নূতন ভাবের নূতন ফুল মোল্লার হৃদয়ে ফুটে উঠল। ফুলের ফল যে কি হয়েছে তা বর্ণনা পূর্বেই দিয়েছি।

নিউইয়র্ক নগরে পূর্বে এমন কযেকজন ভারতীয় ছিল যারা এই ধরনের লোককে ধরিয়ে দিলে টাকা পেত কিন্তু নূতন আইন প্রচলিত হওয়ার এই ধরনের নীচ অপচেষ্টা বন্ধ হয়েছে। নিউইয়র্ক পৌঁছবার পর অনেক স্বদেশবাসী, মোল্লাসাহেবের মত তাদের পূর্ব অভ্যাস অনুযায়ী আমাকেও ঘিরে ধরেছিল; কিন্তু যখন জানল যে আমি যাত্রীরূপে এসেছি এবং এদেশে থাকব না তখন তারা উক্ত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দিল।

এত দুঃখকষ্ট সহ্য করেও যারা আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছে, নিজের স্বদেশবাসী হয়ে এবং এমন কি নিজের জাতভাই হয়েও সামান্য লাভের জন্য এদের পুলিসের নিকট ধরিয়ে দেয় এবং ভারতে ফিরিয়ে পাঠাবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়–এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে? এটাও সহ্য করা যায়, যেহেতু এসব কাজ যারা করে তাদের হিতাহিত জ্ঞান নাই বললেও চলে। কিন্তু তার চেয়েও বড় দুঃখের বিষয় হল, অনেক শিক্ষিত ভারতবাসী আমেরিকাতে গিয়ে বাজে কাজে দিন যাপন করে অথচ এই সব হিতাহিত জ্ঞানশূন্য স্বদেশবাসীদের সৎবুদ্ধি দিয়ে পথে আনার কোন ব্যবস্থাই করে না। হউক না এ সকল লোক মুসলমান ধর্মাবলম্বী? বিদেশের লোক ত ধর্ম বিচার করে না, অথবা ধর্ম দিয়ে জাতের নামকরণও করে না, এটা জানা সত্ত্বেও উদাসীন হয়ে এসব নিরক্ষরদের উপকার না করা মহা অন্যায় কাজ। অনেকে আবার “ফেলোসিপ অব রিলিজিয়ন” নিযে বেশ চিৎকার করেন, এবং সে চিৎকার আমি স্বকর্ণে শুনেছি। কিন্তু এই নিরক্ষর মুসলমানরা কি সকল ধর্মের বাইরে? যে সকল ভারতীয় ধর্মপ্রচারক আমেরিকায় গিয়ে ধর্মপ্রচার করেন তাদের দৃষ্টিও ওদের দিকে পড়ে না। বিঠল ভাই প্যাটেল যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন তিনি এসব অশিক্ষিত লোকের মাঝেই বসে থাকতেন। এসব অশিক্ষিত লোক তাঁকে আপনজনই করে নিতে পেরেছিল কারণ বিঠল ভাইও এদের অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। অনেক আমেরিকান বিঠলভাইএর অনুরাগীদের সংখ্যা দেখে তাজ্জব হয়েছিল। যারা স্বদেশবাসীকে মূর্খ এবং অপদার্থ ভেবে দূরে রাখতে চান তাঁরা বোধহয় জানেন না, তাঁরা সমাজের কতবড় শত্রু।

পরাধীন দেশের লোক স্বাধীন দেশে গিয়ে অনেক সময়ই খাপ খাইয়ে বসবাস করতে পারে না। আমরা অনেক বৎসরের পরাধীন। আমাদের নানা দোষ থাকবারই কথা। এসব দোষ অনেক সময় আমরা অনুভব করতে পারি না। বিদেশীরা আমাদের দোষ অতি সহজে বুঝতে পারে। আমেরিকাতে ভারতের শিক্ষিত লোক ক’জন গিয়েছিলেন তার সন্ধান আমি পাইনি। যারা আমার সামনে এসেছেন অথবা যাদের আমি সন্ধান করতে পেরেছি তাদের কথাই আমি বলছি। এই লোকগুলির মাঝে কয়েকজন বেশ গুণী লোকও দেখেছি, কিন্তু শিক্ষিত এবং গুণী হলে কি হয়, বহু বৎসরের পরাধীনতা আমাদের দেশের শিক্ষিত এবং গুণী লোককেও অন্ধ করে রেখেছে। যারা একদম অশিক্ষিত অবস্থায় আমেরিকায় গিয়েছে তারা বরং অনেক সময় যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে পারে। দেশের কথা ভাবে, বিদেশীর সংগে খাপ খাইয়ে বসবাস করতে পারে। তবে এরূপ লোকের সংখ্যা খুবই কম। এরূপ লোক সাধারণত বাংলার একেবারে অজ পাড়াগাঁ হতে কলকাতায় এসে একদম নিউইয়র্ক অথবা সানফ্রানসিস্কোতে গিয়ে জাহাজ হতে নেমে সরাসরি ইউরোপীয়দের সংগে মিয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় ধর্মের প্রভাব এদের অন্ধ করে রাখতে পারেনি, ইমপিরিয়েলিজমএর হিন্দু-মুসলমানীও এদের কাবু করতে সক্ষম হয়নি। এরা হিন্দু হয়ে জন্মেছে আর মরবেও হিন্দু হয়ে, ইণ্ডিয়ানত্ব এদের কাছে কখনও পৌঁছবে না। ১৯৪০ জানুয়ারী মাস পর্যন্ত আমেরিকার অশিক্ষিত হিন্দুদের মাঝে কোনরূপ বিকার দেখা দেয়নি। এখন যদি সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে থাকে তবে তা আমার অগগ্যাত।

আমেরিকাতে যে সকল হিন্দু স্থানীয় লোকের একপাড়ায় থাকে না অথবা এক পাড়ায় থাকবার মত মানসিক শক্তি অর্জন করেনি তারাই সংখ্যায় বেশী। এরা কখনও আমেরিকার নাগরিক হতে পারবে বলে মনে হয় না, কারণ এরা এখনও শিক্ষা এবং কৃষ্টি হতে অনেক দূরে রয়ে গেছে। যাঁরা আমেরিকার নাগরিক হয়েছেন তাদের শিক্ষা যেমন হয়েছে তেমনি হয়েছে তাঁদের কালচারের উন্নতি। ত্রিপূরা জেলার শ্রীযুক্ত জগৎবন্ধু দেব মহাশয়ের নাম এখানে উল্লেখ করে বাস্তবিকই আমি গর্ব অনুভব করছি।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.