
যে সকল হিন্দু আমেরিকাতে এখনও নাগরিক হতে সক্ষম হয়নি তারা শিক্ষাদীক্ষায় যেমন অনেক পেছনে পড়ে আছে তেমনি তাদের কাজ-কর্মের ফলে ভারতের বদনামও হচ্ছে। ভারতবাসীকে আমেরিকাতে নাগরিক হতে হলে নানারূপ পরীক্ষা পাশ করতে হয়। যেসকল হিন্দু নাগরিকত্ব পায়নি তারা মজুরী করবার অধিকার হতেও বন্চিত হয়। সেজন্যই আমাদের দেশের লোক আমেরিকাতে বাধ্য হয়ে বেকার থাকে এবং নানারূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করে জীবিকা অর্জন করতে বাধ্য হয়। এসকল লোক শিক্ষার অভাবে নিজের নিকটস্থ আত্মীয়ের সর্বনাশ করতেও কোনরূপ সংকোচ মনে করে না। মিথ্যা মোকদ্দমা করা এদের একদিন পেশা ছিল বললেও দোষ হয় না। সেজন্য বোধহয় আজ নিইউয়র্কে যদি কোন অনাগরিক হিন্দু অন্য কোন অনাগরিক হিন্দুর বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়ে মোকদ্দমা করে তবে সেই মোকদ্দমা গ্রাহ্য হয় না।
আমাদের দেশে এমন কতকগুলি আইন আছে যার সাহায্যে যে-কোন লোকে যে-কোন সময়ে গ্রেপ্তার করা যায়। আমেরিকাতে সেরূপ কোন আইন নাই। তথায় প্রথমেই প্রমাণ করতে হয় লোকটি দোষী নতুবা গ্রেপ্তার করা চলে না। ভারতবর্ষ হতে যেসকল লোক খালাসীর কাজ নিয়ে জাহাজ হতে পালিয়ে আমেরিকাতে বসবাস করছে, তাদের যদি জাহাজী আইন মতে গ্রেপ্তার করে ভারতে ফিরিয়ে পাঠাতে হয় তবে প্রমাণ করতে হবে অমুক নামের লোক আমেরিকার অমুক বন্দরে অবতরণ করে এতদিন গা ঢাকা দিযে রয়েছিল। এতটুকু প্রমাণ হবার পর জাহাজী আইনে দোষী লোকটিকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দেয়া হয়। আমেরিকার পুলিশ এখন হিন্দুদের নাড়ীনক্ষত্র জেনে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যদি আমেরিকা হতে জাহাজী আইনে দোষী হিন্দুদের তাড়াতে হয় তবে হিন্দুদেরই সাহায্য নেওয়া দরকার নতুবা এ কাজটি কোন মতেই সম্পন্ন হবে না। তারপর এ কাজটি শুধু বোকর ভারতবাসীর দ্বারাই সম্ভব। ভারতীয় বেকার অর্থের লোভে সকল রকমের অন্যায় কাজই করতে রাজি হয়। কারণ তাদের দেশাত্মবোধ মোটেই নাই, তারা জানে শুধু নিজেকেই বাঁচাতে। সেজন্যই অনেক ভেবে চিন্তে এবং অনেক পরামর্শের পর হয়ত আমেরিকা সরকার আমেরিকা হতে ভারতবাসী নির্বাসনের কাজ ভারতবাসীর উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। এতে আমেরিকার সুবিধা হল অনেক কিন্তু ভারতবাসী আমেরিকাতে আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আমাদের প্রিয় নেতা প্যাটেল যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন তিনি চেষ্টা করেছিলেন যাতে করে ভারতবাসী এসব অন্যায় কাজ হতে দূরে থাকে। তিনি যতদিন আমেরিকায় ছিলেন ততদিন একটিও অনুরূপ ঘটনা ঘটেনি। তিনি কতকগুলি গণ্যমান্য লোককে বলে এসেছিলেন আমেরিকাতে যেন হিন্দুর রক্তে হিন্দুর হাত আর কলংকিত না হয়। কিন্তু উপদেশে কি হয়, পাল্টা উপদেশ যদি পায় তবে ভারতবাসী আসল কথা ভুলে যায়। পরাধীন জাতের লোক ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানই বেশি দেখে, জাতের সম্মান যাতে বাড়ে সেদিকে মোটেই তাকায় না। একটা ইউরোপীয়কে বেশ করে নিন্দা করে, তার মা-বাবাকে বেশ করে গাল দাও সে হয়ত কিছুই বলবে না, কিন্তু যেই তার জাতের বিরুদ্ধে কিছু বলতে অমনি সে তোমাকে মারতে আসবে। জাপানীরাও তাই। একজন জাপানীর সামনে তার ধর্মকে বেশ করে গাল দাও, তার মাতার চরিত্রে কলংক আছে বল, সে তোমাকে এড়িয়ে যাবে, কিন্তু যেই তার জাতের বিরুদ্ধে, তার দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলেছ অমনি সে তোমার ঘাড়ে লাফিে পড়বে। হয় সে মরবে নয় তোমাকে মারবে। আমরা তার বিপরীতে। তারই ফলে আমরা পরাধীন।
আমাদের দেশের লোক আমাদের কি করে সর্বনাশ করে তারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া ভাল মনে করি। আফ্রিকা হতে লণ্ডন আসার পর আমার মন এতই দমে যায় যে বর্ণ-বিদ্বেষের অত্যাচারকে আমি যেমন ঘৃণা করতাম তেমনি অবহেলাও করতাম। আমার মনে সদাসর্বদা হিন্দুর জাতিভেদের কথাই মনে আসত বেশি করে এবং সেই জাতিভেদের অত্যাচার হতে ভারতবাসীকে কি করে মুক্ত করা যায় তারই কথা চিন্তা করতাম। নানা চিন্তায় অনেক সময় আমার দরকারী কথাও মনে থাকত না। যা হউক তখনকার দিনের ‘দেশ’ কাগজের লেখক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে মাঝে মাঝে পত্র লিখে প্রকৃতিস্থ রাখতেন। তিনি আমাকে পত্রযোগে জানিয়েছিলেন নিউইয়র্কে অনেক বাংগালী বাস করে এবং তাদের মাঝে অনেকেই নিরক্ষর। লণ্ডনে হিন্দুস্থান এসোসিয়েসনের সেক্রেটারী মি: সুরাত আলীও এই শ্রেণীর কয়েকটি লোকের ঠিকানা দেন। সেই ঠিকানা অনুযায়ী নিউইয়র্কে একখানা পত্রও লিখেছিলাম। তার পরই আবার সকল কথা ভুলে যাই।
নিউইয়র্কে দু’ সপ্তাহ থাকার পর কয়েকজন সিলেটি মুসলমানের সংগে সাক্ষাৎ হয়, তারা আমাকে একটি প্রশ্ন বেশ জোর দিয়েই জিজ্ঞাসা করে, সেই প্রশ্নটি হল আমি কোন্ জাহাজে এবং কবে এসেছি। যখন আমি বললাম জর্জিক নামক জাহাজে এসেছি তখন তারা আমার কথায় বিশ্বাস করল না এবং আমাকে বেশ ভাল করেই অবহেলা করল। আমিও তাদের সংগে কথা বললাম না। আমি ভাবলাম এরা নিরক্ষর এবং মূর্খ।
ঘটনাক্রমে একদিন একজন হিন্দু বাংগালীর সংগে সাক্ষাৎ হয় তিনি সিলেটি মুসলমানদের এক সংগে থাকেন এবং এদের যাতে উন্নতি হয় সেই চেষ্টাই সকল সময় করেন। তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে যান এবং আরও তিনজন সিলেটি মুসলমানের সংগে পরিচয় করিয়ে দেন এই তিনজন সিলেটি মুসলমান আমি আমি কোন্ জাহাজে এসেছি সে প্রশ্ন করেনি তবে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এমন কোনো সিলেটি মুসলমান আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনি কোন্ জাহাজে এসেছেন?” আমি বলেছিলাম তিনজন লোক আমাকে সেরূপ প্রশ্ন করেছে তবে তাদের নাম জানি না। সেদিনই এই তিনজন লোকে আমাকে তাদের আড্ডায় নিয়ে যায়। আড্ডাটি একটি অজ্ঞাত স্থানে অবস্থিত। নিউইয়র্ক-এর মত স্থান, যথায় কেউ পথ ভুল করে না, তথায়ও তাদের আড্ডায় যাবার সময় আমার পথ ভুল হয়েছিল। আমরা গিয়েছিলা টেকসিতে। কখন যে কোন্ পথ ধরে কোথায় গেলাম তার কিছুই বুঝলাম না। যখন আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছলাম তখন সে স্থানে কয়েকজন লোককে আরবি ধরনে বসে কাফি খেতে দেখলাম। আমি যাবামাত্র তিনজনই এক সংগে উঠে আমাকে সম্বর্ধনা করলেণ। আমি একখানা মাদুরের ওপর বসলাম। এক পেয়ালা কাফি আমাকে খেতে দেওয়া হল এবং একজন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আমার পরিচয় পেয়ে অন্য একজন একটি দেরাজ খুলে আমার প্রেরিত চিঠিখানা আমার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন এটা আমারই চিঠি কি না? আমার হাতের লেখা চিঠি তৎক্ষণাৎ চিনলাম এবং বললাম, “মহাশয়গণ আশা করেছিলাম আপনারা জাহাজে যাবেন এবং জাহাজ হতে নামতে সাহায্য করবেন কিন্তু সেদিন আপনারা আমাকে মোটেই সাহায্য করেন নি।” উপবিষ্ট ভদ্রলোকদের মাঝে যার বয়স একটু বেশি বলেই মনে হল, তিনি বললেন, “আমরা ভেবেছিলাম আপনি জাহাজ হতে পালাতে চান এবং সে বিষয়ে আমাদের সাহায্য চান। যদি জানতাম আপনি পেসেন্জার হয়ে আসছেন তবে কমের পক্ষে হাজার লোক গিয়ে আপনাকে সম্বর্ধনা জানাতাম। আমরা আপনানে উপযুক্ত সম্মান দিতে পারিনি বলে বড়ই দুঃখিত এবং যাতে আপনি উপযুক্ত সম্মান পান তার ব্যবস্থা করা হবে।” তারপরই শুরু হল অন্য কথা। সে কথার সংগে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না সেজন্য আমি মুখ ফিরিয়ে বসে কাফি খাচ্ছিলাম।
আমার সংগে এদের আর বিশেষ কোন কথা হল না। সেদিনের মত বিদায় নিয়ে আমি চলে এসেছিলাম এবং এদের কথা একরূপ ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন একজন লোক এসে আমাকে জানাল যে সিলেটি মুসলমানদের মাঝে একটি সভা হবে এবং সেই সভায় আমার ভ্রমণকাহিনী বলতে হবে। নির্ধারিত দিনে সভাতে উপস্থিত হবার পর একজন লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই সভায় এমন কেহ কি আছে যে জিজ্ঞাসা করেছে আপনি কোন্ জাহাজে এসেছেন?” যে কয়জন লোক আমাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিল তাদের দেখিয়ে দিলাম। এই কাজটি করার পরই আমাকে সে রুম হতে বের করে দিয়ে অন্য রুমে বসতে দেওয়া হল। বের হয়ে যাবার পূর্বে শুধু শুনেছিলাম “ধরে ফেল”। সিলেটি কথায় ধরে ফেল কথাটাকে বলা হয় “ধইরা ফালাও”। কোনও জীব হত্যার সময় এরূপ কথার ব্যবহার হয়ে থাকে। চিন্তিত মনে আমি আমার মেসে এসে শয্যা গ্রহণ করেছিলাম। সেদিন বিকালবেলা কারো সংগে সাক্ষাৎ করিনি। যাতেকরে কোনও হিন্দুর সংগে দেখা না হয় সেজন্য বলুওয়ার্ড নামক স্থানে অনেকক্ষণ ভ্রমণ করে একটি রুশ দেশীয় ফিলম্ দেখে রুমে ফিরে আসি।