আজকের আমেরিকা (২৩) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

এসব প্রগতিশীল ভাবুকদের স্থানীয় লোক কমিউনিষ্ট বলে। আমেরিকায় কমিউনিষ্ট পার্টি বে-আইনী। যদি কোনমতে আমেরিকা সরকার কাউকে কমিউনিষ্ট বলে প্রমাণ করতে পারেন তবে তৎক্ষণাৎ তার কাছ থেকে কাজ করবার অধিকার কার্ড কেড়ে নেন। যারা কাজ করবার অধিকারের কার্ড হারিয়েছে তাদের প্রভাব ছাত্র সমাজে বড়ই প্রবল। কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য করার জন্য মোটা রকেরম মাইনে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দায়ীত্ব জ্ঞানশীল যুবক যুবতীরা আগিয়ে আসে না। ছাত্র ফেডারেশন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, হুভার হও আর রুজভেল্ট হও তোমাদের সমর্থন আমরা করব না। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ নতুন। পুরাতনকে আমরা আর আঁকড়ে ধরে রাখতে পার না। আমরা কাজ করার অধিকার চাই। তোমাদের কাছে কাজ ভিক্ষা চাই না।

যখন ছাত্রছাত্রীরা অবৈতনিক সরকারী বিদ্যালয় হতে বের হয় তখন তারা দেখতে পায় তাদের সামনে এক বিরাট অন্ধকার। তারা তাদের মা বাবার উপরও নির্ভর করে থাকতে পারে না তাই যখন তারা কাজের খোঁজে বের হয় তখন কাজের খোঁজ পেতে অনেকের জুতার শুকতলী পর্যন্ত বেড়িয়ে আসে অথচ কাজ যোগাড় হয় না। আমেরিকায় যুবক-যুবতীদের জন্য ভাল মন্দ দুটি পথই খোলা আছে। অনেক ধনীলোক নতুন যুবক-যুবতীদের দিকে অনেক সময় বাঁকা নজরে তাকান এবং তাদের নরকের পথে পৌঁছে দেন তার দৃষ্টান্ত আমি স্বচক্ষে অনেক দেখেছি। যে সকল ছাত্র এবং ছাত্রী বর্তমানে ছাত্র ফেডারেশনে কাজ করে এবং সেই প্রতিষ্ঠানটি চালায় তাদের অনেকের পূর্ব জীবন পাপে নিমজ্জিত ছিল। গ্রেইপস্ পিকার বইখানা তার একটি বিশিষ্ট নিদর্শন যখন এই প্রকারের পথভ্রষ্ট ছাত্র এবং ছাত্রীরা প্লেটফর্মএ দাঁড়িয়ে তাদের আত্মজীবনী লোকে কাছে প্রকাশ্যে বলে তখন লজ্জা যাদের আছে তারা একের মুখ অন্যে দেখতে সাহস করে না। কথাটা এখানে আর বেশি বাড়িয়ে বলার দরকার নাই। যদি এ সম্বন্ধে এর চেয়েও বেশি কিছু জানতে চান তবে স্যানফ্রানসিসকো হতে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ‘পিপুলস্ ওয়ার্ল্ড’ পাঠ করলেই জানতে পারবেন আমেরিকার বুকের উপর ধনীদের নির্মম অত্যাচার কাহিনী। কিন্তু এই শ্রেণীর কাগজ বিদেশে অতি কমই প্রেরিত হয়। প্রথম কারণ হল যে সকল পর্যটক আমেরিকাতে বেড়াতে যায় তারা আশি পৃষ্ঠার সংবাদ পত্রই কেনে। চার পাতার সংবাদপত্র কিনে দশ সেণ্ট খরচ করতে কেউ রাজি নয় দ্বিতীয় কারণ হল বিদেশে গিয়ে, কে কি রকম পলিটিক্স করছে তার সংবাদ রাখতে চায় না। আরাম এবং আনন্দ নিয়ে সকলে ব্যস্ত। প্রগতিশীল লেখক এবং বিবেচক লোক আমেরিকাতে যেতে মোটেই পছন্দ করে।

হারলাম

মানহার্টন দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশ হারলাম নামে পরিচিত। এ স্থানের বাসিন্দা সবাই নিগ্রো। হারলামের বাড়ি-ঘর নিউইয়র্ক এর অন্যান্য বাড়ি-ঘরের মতই। যদি নিগ্রোরা এ অনচলে বাস না করত তবে এ স্থানটার এত বদনাম হত না। হারলামে দিনের বেলা আমেরিকানরা খুব কমই আসে। কিন্তু সন্ধ্যার পর হতেই এদিকে শ্বেতকায়দের আগমন শুরু হয়। লণ্ডন, সাংসাই, জিব্রাইল্টার, নীস্ এবং আমার মনে হয় প্যারীও রাতের বেলা হারলামের কাছে হার মানে। রাত্র যখন অধিক হয় তখন অন্যান্য স্থানের লোক হারলামের দিকে আসতে থাকে। তখন হারলাম হয় ভূস্বর্গ। সত্যই হারলাম ভূস্বর্গ। ভূস্বর্গে বসতি ক্রমে বেড়ে চলেছে। পূর্ব্বে ভূস্বর্গের সীমানা ছিল ১০৪ স্ট্রীট পর্যন্ত, বর্তমানে হয়েছে ১০৮ স্ট্রীট। ক্রমেই এর সীমা বাড়ছে দেখে ফাদার হাপকিনের মন কেঁপে উঠছে এবং ফাদার ডিভাইনএর আনন্দ বাড়ছে। উভয়েই খ্রীষ্টধর্ম-প্রচারক। উভয়েই ইহুদী এবং কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। অথচ উভয়ের মধ্যে মতের মিল নাই। ফাদার হাপকিন চাপ নিগ্রোদের নিপাত করে সাদা চামড়াদের একাধিপত্য বিস্তার করতে, শুধু আমেরিকায় নয় পৃথিবীর সর্বত্রই। ফাদার ডিভাইন কিন্তু সেরূপ কিছু চান না, তবে তিনি নিগ্রো নিপাত মোটেই পছন্দ করেন না।

ইটালি যখন আবিসিনিয়া আক্রমণ করল তখন হারলামের নিগ্রোরা আবিসিয়ান্দের সাহায্য করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারে নি। ফাদার হপকিন তখন সুর উঠিয়েছিলেন, আমেরিকার অর্থ যদি এমন করে বিদেশে চলে যায় তবে দেশের দুর্গতি হবে। ‘অ্যামস্টাইরডম নিউজ’ সেই হপকিনা যুক্তিকে খ-ন করার জন্য নানা সক্তি দেখিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংবাদপত্রগুলি যতই বাগযুদ্ধে মাতোয়ারা হল, নিগ্রোরা ততই দুঃখিত হয়ে গির্জায় গির্জায় হাবসী সম্রাটের জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। হাবসী সম্রাটকে সাহায্য করবার কথা ভুলে না গিয়ে পুরাদমে তারা অর্থ জমাতে লাগল। ফাদার হপকিন হঠাৎ একদিন ঘোষণা করে দিলেন, বর্বর সম্রাট হাইলে সেলাসিকে আমেরিকা কোনওরূপ সাহায্য করতে পারবে না। নিজের শক্তি দেখাবার জন্যে কতকগুলো ভাড়াটে গু-াকে তিনি গির্জায় গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন যাতে করে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়ে যায়। ফল তার উলটা হল, দাংগা শুরু হল। শ্বেতকায়গণ হারলামে দোকান করে বেশ দু পয়সা উপার্জন করছিল, সেটি বন্ধ হল। দাংগার কথা সংবাদপত্রে এমন ঘটা করে বার হতে লাগল যে, লোক ইটালি-আবিসিনিয়ার যুদ্ধের কথা ভুলে গিয়ে দাংগার কথা নিয়েই মেতে উঠল। আসল কথা, দাংগা হাংগামা তেমন কিছু হয় নি। আমেরিকায় হপকিনী কীর্তি আমি আফ্রিকাতে কিছুটা উপলব্ধি করেছিলাম। ইউরোপীয়ানরা ইংরেজী সংবাপদপত্র পাঠ করে ফেলে দিতেন না, পুড়িয়ে ফেলতেন যাতে করে নিগ্রোরা ইটালি-আবিসিনিয়ার যুদ্ধের কোনও সংবাদ না পায়।

হারলামের এমন গির্জা নাই, এমন ক্লাব নাই, যেখানে আমি আমার আফ্রিকা-ভ্রমণের কথা না বলেছি। এই কারণেই অনেক নিগ্রো আমার সংস্পর্শে এসেছিল এবং আমাকে অন্তরের সংগে ভালবেসে তাদের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহারের সকল দিকই আমার কাছে খুলে ধরেছিল। আমি তা শুনে সুখী হতাম এবং প্রাণ খুলে তাদের সংগে কথা বলতাম।

আমেরিকা আজ নূতন রূপ নিয়েছে। দরিদ্র এবং ছাত্র সমাজ বুঝতে পেরেছে আর লীডার বানিযে দরকার নাই, ভোটাভুটিতে গিয়ে বেগার খেটে কাজ নাই; কর্তৃত্বের মূলে যাঁরা আছেন, তাঁরা থাকেন ওয়ালস্ স্ট্রীটের উপরতলায় বসে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও ডিমক্র্যাসির দোহাই দিয়ে তাঁরা নিজেদেরই অভিপ্রায় সিদ্ধ করেন। কাজ শেষ হয়ে গেলেই তাঁদের দরজায় “ভ্যরি বিজি” লেখা সাইনবোর্ড ঝুলতে থাকে; তেমন করে কিন্তু আর চলবে না। মিস মেয়োও তো বুঝতে পেরেছিলেন। একদা তিনি বাজারে নিলামে বিক্রী হয়েছিলেন, আজ আর সেরূপ আত্মবিক্রীত হবার ইচ্ছা তাঁর নাই। তাই বোধ হয় তাঁর সুবুদ্ধি এসেছে; নূতনভাবে মত্ত হয়ে এবার তিনি দরিদ্র এবং ছাত্র বন্ধুদের সংগে মিশতে এসেছেন। তিনিই করুণ সুরে বলেছেন, রুমিয়ার সংগে আর চালবাজি করলে চলবে না। নিজেদের মাঝে যে নূতন রুশিয়া গড়ে উঠেছে তাকে স্বীকার করতে হবেই। ইহুদী এবং নিগ্রোও মানুষ, তাঁদেরও সমাজে স্থান দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মিস মেয়ো বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতবর্ষ এবং ফিলিপাইন দ্বীপপুনজের সংগে আমেরিকার তুলনা করা অন্যায় হবে। আমেরিকার লোক যা চাইবে তা তাদের দিতে হবেই। যদি না দেওয়া যায় ভবিষ্যতে খারাপও হতে পারে।

পূর্বেই বলেছি লোকজনাকীর্ণ হারলামে দিনের বেলায় শ্বেতকায়রা যান না, অথচ রাত্রে তাদের সেদিকে যাওয়া চাইই। হারলামে এমন কি মোহ আছে যে তথায় রাত্রে যাওয়া অতীব দরকার। একটি মোহ আছে সেই মোহটি হল নাইট ক্লাব। আমেরিকার নাইট ক্লাবগুলি প্যারীকে হার মানিয়েছে। প্যারীর বদনাম আমরা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমেরিকার নাইট ক্লাবের কথা কজন বলেছেন অথবা বলবার সুযোগ পেয়েছেন? আমার সে সুযোগ হয়েছিল কারণ আমি নিগ্রোদের সংগে মিশতে সক্ষম হয়েছিলাম।

যাদের মনে সাহস নাই, যারা পরের দাসত্ব পছন্দ করে, তারাই ধর্মভীরু হয় বেশি। একদিন একটি গির্জাতে নিগ্রোদের উপাসনা দেখতে গিয়েছিলাম। পাদরী মহাশয় পুরুষ হয়েও যেমন করে মেয়েলী ভাব দেখালেন তাতে মনে হয়েছিল এ জাত আর টিকবে না। এ জাত শ্বেতকায়দের সংগে হয় মিশে যেতে বাধ্য হবে নয় ত ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তাদের মিশে যাওয়াটাই চাই কিন্তু আমাদের দেশে যেমন করে আর্য রক্তের সংগে অনার্য রক্ত মিশতে দেওয়া হয় না, তেমনি আমেরিকার শ্বেতকায়রা নিগ্রোদের নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেলতে রাজি নয়। শ্বেতকায়দের গররাজি অথবা নিমরাজিতে কিছু আসে যায় না। মানুষ বাসনার দাস। মানুষ বাসনাকে দাবিযে রাখতে পারে না। নিগ্রোরাও খাওয়া পায়, আমেরিকানরাও ভুরিভোজন করে। আমেরিকার নিগ্রোদের মন প্রিমিটিভ ষ্টেজে নাই অতএব শ্বেত এবং কালোয় মিলন অনিবার্য এই মিলনের ফলেই এমন অনেকগুলি নরনারীর জন্ম হয়েছে যার বর্ণশংকর বলে পরিচিত। নাইট ক্লাবগুলিই সাদায় কালোয় মিলনের স্থান যদি বলা হয় তবে অন্যায় বলা হবে না। অবশ্য তার প্রমাণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না, এটা একটা অনুমান মাত্র। তবে সকল সময় অনেক অনুমান সত্য হয় না। আমার অনুমানও যে ধ্রুব সত্য তা আমি জোর গলায় বলতে পারি না, তবে একথা বলতে পারি সাদায় কালোয় মিলনের ফলে যেসব বর্ণশংকরের জন্ম তাদের জন্মস্থান হারলামেই। সেইজন্য ইউরোপীয়গণ বলেন হারলাম শুধু হালাম নয়, হারলাম একটি পূর্বদেশীয় “হারেম”। ইউরোপীয়গণ কেন হারলামের উপর হারেমত্ব আরোপ করেন, সে কথার জবাব তারাই ভাল করে দিতে পারবেন। আমি পর্যটক মাত্র, আমি কোন কথার বিচার করার অধিকারী নই।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.