আজকের আমেরিকা (২৪)–শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

একদিন লণ্ডনের একটি প্রসিদ্ধ ক্লাবে একজন বিশিষ্ট ধনীর সংগে সাক্ষাৎ হয়। ধনী নিজেই আমার সংগে কথা বলেছিলেন। লণ্ডনে নিজে উপযাচক হয়ে কোন ধনী অথবা সম্মানিতের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা বলতে যায় নি। এই কাজটি আমার কাছে সর্বদা সর্বত্র অপমানজনক মনে হত। ধনী বলেছিলেন, যেমন করে এদেশে আমরা অশ্বেতকায়দেরে নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি, তেমনি যদি আমেরিকানরাও নিগ্রোদের তাদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে পারত তবে সাদা কালো বলে তাদের কোন বালাই থাকত না। হারলামে থাকবার সময় বেশ ভাল করেই অনুভব করেছিলাম, প্রকাম্যভাবে কেউ নিগ্রোদের সঙ্গে মিশতে রাজি নয়, কিন্তু গোপনে অনেকেই অনেক কাজ করে। এরূপ গোপন কাজ আমাদের দেশেও হয়, কিন্তু তা আমরা হজম করতে পারি না। আমেরিকাতে শিশু রক্ষা করার নানা রকমের প্রতিষ্ঠান আছে বলেই সে দেশে ভ্রুণ হত্যা হয় না। কোন কোন মাতার আইন মতে বিবাহ হবার পূর্বেই সন্তান হয়। আমেরিকা সরকার সে রকমের সন্তানকে শিশুসদনে প্রতিপালিত করেন। আমাদের দেশেও আর্যদের সময়ে সেরূপ ছেলে মেয়ের অস্তিত্ব ছিল। সেরূপ একটি ছেলের নাম হল কর্ণ। সে যুগে কর্ণের মত বীর কমই ছিল। কুন্তীর বিয়ে হবার পূর্বেই কর্ণের জন্ম হয়। সমাজের ভয়ে কুন্তী কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দেন কারণ সেরূপ শিশুকে রক্ষা করার ভার সমাজ প্রকাশ্যে গ্রহণ করত না। আমেরিকায় সেরূপ শিশু রক্ষা করার ভার গ্রহণ করেছে। ইউরোপেও সেরূপ শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের ভার সর্বত্রই বিরাজমান। হারলামে এরূপ শিশুর অভাব ছিল না। তাদের কারো বাবা নিগ্রো আর মা আমেরিকান, আবার কারো মা নিগ্রো বাবা আমেরিকান। নিগ্রো মহিলা সন্তানকে কোনমতেই পরিত্যাগ করেন না। আমেরিকান মহিলা নিগ্রো পিতার সন্তানকে শিশু সদনে পরিত্যাগ করে। সেরূপ অনেক শিশু যারা এমন বড় হয়েছে, বিয়ে করে সংসারি হয়েছে তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলে আরাম পেতেন কারণ আমি তাদের ঘৃণা করতাম না। মানুষ হযে মানুষকে ঘৃণা করা বড়ই অন্যায় কাজ। আমেরিকার শ্বেতকায়রা কিন্তু সেরূপ অন্যায়কে এখনও প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।

হারলাম নিউইয়র্ক-এর একটি অংশ। হারলামের মত সুন্দর স্থান দ্বিতীয়টি দেখিনি। লোকে প্যারীর কথা বলে কিন্তু প্যারী হারলামের কাছে হাজার বার হার মানে। তবুও প্যারীর নাম এত কেন? তার একমাত্র কারণ হল, আমাদের দেশের যে সকল হোমরা চোমরা ইউরোপ যান তারা প্যারীতে গিয়ে বেশ আনন্দ করেন। তাদের নিউইয়র্ক যাবার ফুরসত হয় না এবং যদি কেউ ভুল করে নিউইয়র্কে যান তবে হারলামের দিকে যেতে চান না পাছে তাদের সম্মানের লাঘব হয়। কি করে সম্মানের লাঘব হয় তা হয়ত পাঠক মোটেই বুঝবেন না। আমেরিকায় আজও ভারতবাসী অছুতরূপেই গণ্য হয়। যদি কোন পর-শ্রমজীবী বিলাত ভ্রমণ করে আমেরিকায় যান তখন দেখতে পান তিনি একজন ভারতীয হরিজন ছাড়া আর কিছু নন। তাই কোনমতে শ্বেতকায়দের সঙ্গে দিনকয়েক কাটিয়ে মানে মানে দেশে ফিরে আসেন। হারলামের কথা মনেতেই রাখেন, মুখে প্রকাশ করেনন া।

প্যারীতে টাকার অভাব লেগেই আছে। নিউইয়র্কে টাকার অভাব নাই। কিন্তু সে টাকা শুধু ধনীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ তাই নিউইয়র্ক টাকায় বোঝাই হয়েও দরিদ্রতায় পূর্ণ। নিউইয়র্ক ল-ন হতেও বড় এই নগরের সকল কথা যদি জানতে হয় এবং দেখে তা উপলব্ধি করতে হয় তবে অন্তত ছয়টি মাস ক্রমাগত তথায় ঘুরে বেড়ান দরকার। আমার সে সুযোগ হয় নি তবে একথা বলতে পারি সাইকেলে, কারে, এলিভেটারে, বাসে এবং স্যাবওয়েতে যতটুকু ভ্রমণ করেছি ততটা সকলে পেরে উঠে না। এত ছুটাছুটি করে জানতে পেরেছি দরিদ্রতা কেথা হতে এসেছে। পাদ্রীরা বলে মদ খেয়ো না, অথচ মদের দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খুলে রাখার ব্যবস্থা আছে। ঠিক সেরূপভাবে যুবক-যুবতীদের নানা উপদেশ দেওয়া হয় অথচ তাদের ধ্বংসের পথ এত ব্যাপকভাবে খুলে রাখা হয়েছে যে তারা নিজেদের অজ্ঞাতসারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর কি কোন প্রতিকার নাই? প্রতিকার আছে। সে প্রতিকারের জন্য সরকার একেবারে উদাসীন। যারা পারছে তারাই সেই ধ্বংসের পথ হতে ফিরে আসছে আর যারা পারছে না তারাই অকালে অক্কা পাচ্ছে।

গ্যাথো

আমাদের দেশে অনেকেই হয়ত গ্যথো কথাটা মোটেই বুঝবেন না। যেখানে গরীব ইহুদীরা বসবাস করে থাকে, পোল্যা-ের জমিদার এবং ধনীরা তাকেই শ্লেষ করে গ্যথো বলত। পোল্যা- হতে অনেক লোক আমেরিকায় এসে বসবাস করছে। তাদের মাঝে ধনীও আছে দরিদ্রও আছে। যে সকল স্থানে আমেরিকার দরিদ্র লোক বসবাস করে, পোল্যা- হতে আগত ধনীরা সেই স্থানগুলিকে গ্যথো নাম দেয়Ñপরে সেই কথাটি সর্বসাধারণ গ্রহণ করে। এখন আমি নিউইয়র্ক নগরীর একটি দরিদ্র পাড়ার কথা বলব যা গ্যথো নামেই পরিচিত।

ভারতের কত লোক না খেয়ে মরে অথবা রোগে ভুগে মরে তার খবর অতি অল্প লোকই রাখে। কিন্তু গরমের সময় আমেরিকায় অতি গরমে কত লোক মারা গেল সেই সংবাদ রয়টার পৃথিবীর সর্বত্র প্রচার করতে কোনরূপ কসুর করেন না। আমি বুঝতাম না গরমে লোকে কি করে মরে। তাই আমেরিকায় এসে যখন শুনলাম ঐ ‘গৈবী ব্যামারী’ নিউইয়র্কে দেখা দিয়েছে তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না। ব্রডওয়ে ধরে গ্যথোর দিকে চললাম। গ্যথোতে থাকে দরিদ্র এবং বেকার। সেদিকে যেতে হলে একটি ভারতীয় ক্লাব পথে পড়ে। আমার ইচ্ছা হল গ্যথো দেখবার পূর্বে ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে একটু কথা কয়ে যাই। ক্লাবে গিয়ে যখন আমি বললাম আমেরিকার দরিদ্র পাড়াতে বেড়াতে চলেছি তখন তারা একটু আশ্চর্য হল। একজন আমাকে বলল সেখানে ভগবানের আশীর্বাদ পড়ে নি, সেখানকার লোক মহাপাপী। তারা মহাপাপাী বলেই তাদের এই দুর্দশা। আমি কিন্তু তাদের কথায় মোটেই দমলাম না। কারণ আমি ভাল করে জানতাম দরিদ্রতা কোথা হতে এসেছে। তাই চললাম গ্যথোর দিকে।

নিউইয়র্কের এবং আশপাশের ছোট ছোট শহর থেকে দরিদ্র লোক গ্যেথোতে এসে বাস করে। পথ ঘাট শহরের অন্যান্য স্থানেরই মত, তবে শহরের অন্যত্র এক-একটা কমপার্টমেণ্টে যত লোক থাকতে পারে, এ পল্লীতে তার দ্বিগুণএরও বেশি লোক বাস করে। অকর্মণ্য হয়ে যাদের দিন কাটাতে হয় তাদের দিন যে কত কষ্টে কাটে, তা এই পাড়ার লোকরাই ভাল করে জানে।

সে স্থানের জলবায়ু ভাল, সেখানে থাকবার স্থানের অভাব হলেও লোকের ক্ষুধা হয়। ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেকে সস্তা খাদ্য খায়। এতে ক্রমেই শরীর দুর্বল হয়। স্নানের অসুবিধা থাকায় অনেকে স্নান করতে পারে না। যদিও বাইরে পরম, তবুও জলের পাইপ খুললে যে জল আসে তা ভয়ানক ঠা-া। ঠা-া জলে স্নান করা শীতের দেশের লোক সহ্য করতে পারে না, তাই তারা বিনা স্নানেই থাকে। ক্রমাগত না খেয়ে, অভ্যাসবশে যখন পথে বেরোয়, তখন অনেক সময় তারা গরম সহ্য করতে পারে না। কাজেই পথে পড়ে যায় এবং দুর্বল হৃদ্যন্ত্র অনভ্যস্ত উত্তাপে সহজেই স্থির হয়ে যায়। একেই বলে ‘ড্রপ ডাউন্’। এই ধরনের মরণ বড়লোকদের কাছে ঘেঁয়ে না, গরীবদেরই বিনাশ করে। সৌভাগ্য বলব কি দুর্ভাগ্য বলব জানি না, গ্যথোয় গিয়ে তিনটি লোককে পথে পড়ে মরতে দেখেছিলাম। পুলিশ এসে তাদের পকেট পরীক্ষা করে একটি সেণ্টও বার করতে পারে নি; পেয়েছিল কতকগুলো মামুলী কাগজপত্র, বাইবেলের পাতা, স্যোসিঅ্যালিজম সসম্বন্ধে ছোট দু-একটা পুস্তিকা ইত্যাদি। বিকালের সংবাদপত্র বেরুল–গ্যথোয় আজ তিনজন লোক ‘হীট ওয়েভ’ সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে। দারিদ্র্যের জন্য, না খেতে পেয়ে দুর্বল হয়ে মারা গেছে, একথা কেউ বলল না। যেখানে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা সর্ববিদিত, যেখানে ডিমক্রেসির পূর্ণ প্রভাব বর্তমান বলে কথিত, সেখানেও মুদ্রাযন্ত্র অবলীলাক্রমে গরীবের কথা ভুলে যায়।

আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর সকল ইহুদীই সুখী এবং ধনী। গ্যথোতে এসে আমায় সে ধারণা ভেঙ্গে গেল। দরিদ্র ইহুদীর দল বেঁচে থাকবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যবসায়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের মেরুদ- ভেঙ্গে দিচ্ছে। গ্যাথোতে সারাদিন কাটিয়ে ঘরে ফিরে গিয়ে অনেকক্ষণ বিশ্রাম করে ফের বিকাল দশটার সময় গ্যাথোতে ফিরে এলাম। ভদ্রলোকরা সাধারণত যে সময়ে হারলামে আসেন আরাম করতে, আমি গেলাম সে সময়ে গ্যাথোতে দরিদ্রের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের উগ্রতা হৃদয়ংগম করতে।

তখনও রাত হয়নি, সবেমাত্র দশটা বেজেছে। দরিদ্রের ছেলেমেয়েরা সারাদিন পথে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে তথাকথিত এমার্টমেন্টে ফিরে চলেছে। অল্পাহারে ও পরিশ্রমে কেউ বা কাতর, কেউ বা প্রায় অর্ধমৃত। খৃষ্টধর্ম প্রচারকরা আমেরিকার জাতীয় পতাকা টাংগিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পাপীদের পরিত্রাণার্থে ডাকছে; কিন্তু খেরে বাঁচবার জন্য কেউ একটা পয়সাও নিরন্নদের দিচ্ছে না। কেউ দাঁড়িয়ে শুনছে, কেউবা কাজ না দিয়েই চলে যাচ্ছে। ছেলেতে ছেলেতে মেয়েতে মেয়েতে পথের উপর দাঁড়িয়ে বেশ বচসা চলেছে সামান্য এক টুকরা রুটির জন্য। পথের কাছে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বৃদ্ধকে বলছে, ‘আজ আর কিছু খেতে পাইনি।’ আমি নিগ্রো-বেশে পথে চলেছি তাই আমাকে কেউ কিছু বলছে না। মাত্র দুএকটা বলবান যুবক মাঝে মাঝে মুখের কাছে এসে বলছে, ‘এই, তোর কাছে সিগারেট আছে?’ যখনই বলছি, ‘হে প্রভু আমিও যে একটা চাই, আপনার কাছে যদি অর্ধদগ্ধ সিগারেটের টুকরা থাকে তবে দয়া করে দিয়ে যান।’ অমনি ‘দুঃখিত’ বলে পাশ কাটিয়ে তারা চলে যাচ্ছিল।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.