আজকের আমেরিকা (২৫)–শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

ছোট ছোট কাফিখানায় সস্তা দরে কাফি বিক্রি হচ্ছে। এক পেয়ালা কাফি এবং একখানা মারগারিন মিশ্রিত রুটির টুকরা পাঁচ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট মিষ্টির টুকরার দাম এক সেন্ট। ছোট ছোট মিষ্টির দোকানে খুব ভিড়; ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শৃঙ্খলা এবং ধৈর্য বজায় রেখে কি সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে! এইসব দেখলে আমেরিকার শিক্ষাবিভাগকে ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকা যায় না।

বেরিয়ে দেখলাম মিশনারীরা যেমন একদিকে দাঁড়িয়ে ভগবানের গুণ কীর্থন করছেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে নাস্তিকরাও তেমনি ভগবানের নিন্দা করছেন। আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম, ডিমোক্র্যাসির প্রশংসা করে উচ্চকণ্ঠে লেকচার চলেছে, তার কাছেই আর একদল লোক ডিমোক্র্যাসিকে হিপোক্র্যাসি বলে কমিউনিজম্ লেকচার দিচ্ছে। পূর্বেই বরেছি, গ্যথো গরীবের স্থান। কমিউনিজম্ এখানকার লোকের প্রাণের জিনিস; তবু অন্যান্য বক্তাকে কেউ আক্রমণ করছে না। যার বক্তৃতা ভাল হচ্ছে তার বক্তৃতা লোকে নির্বাক হয়ে শুনছে। যার বক্তৃতা লোকের ভাল লাগছে না তার কাছে থেকে লোক চলে যাচ্ছে। এমনও দেখেছি, কোনও কোনও বক্তার সামনে একটিও লোক নাই তবুও বক্তৃতার বিরাম নাই। মাঝে মাঝে এরূপ বক্তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখনও দেখতাম বক্তা একজন শ্রোতা পেয়েও সুখী। কিন্তু যখনই বলতাম, ‘কালো লোকের আবার ভগবান কি? আপনাদের মত শ্বেতকায়দের সেবা করা, আপনাদের কথা মেনে চলাই হল কালোদের ধর্ম। আপনারাই হলেন আমাদের ভগবান।’ অমনি বক্তৃতার সমাপ্তি হয়ে যেত।

গ্যথোতে বিজলী বাতি প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। বাতির আলো পথই আলোকিত করেছে, কিন্তু অনেক বাড়িতে সিঁড়ি বেয়ে উঠা বড়ই কঠিন। বাল্ভ নষ্ট হয়েছিল, অর্থাভাবে তা আর কেনা হয়নি। অনেকগুলি রুমের অবস্থাও অনেকটা তাই। রুমগুলিতে আলো নাই, বাতাস নাই, তারপর রুমগুলি অপরিষ্কার। অনেকে বলেন স্থানীয় লোকের দোষেই এই এলাকার বাড়িগুলি অপরিষ্কার থাকে। শরীর যখন রুগ্ন থাকে, মন যদিও কাজ করতে চায় তখন কাজ করার ক্ষমতা থাকে না। এ অঞ্চলের লোক অর্থাভাবে অনেকেই রোগগ্রস্ত। সে রোগ আর কিছুই নয়, শুধু পেটের ক্ষুধা মাত্র। সে রোগের অবসান করার জন্য অনেকেই পাঁচ পেনীর কার্ল-মার্কস কিনে পাঠ করে, হয়ত পাঁচ পেনীর বইই একদিন গ্যথোকে সকল রোগ হতে মুক্ত করবে।

একটি বিষয় এখানে দেখতে পাওয়া যায় যা বলতেও আমার মুখ শুকিয়ে আসে। ইংলন্ড হতে যখন আমেরিকার দিকে রওয়ানা হয়েছিলাম তখন কতকগুলি নাবিক আমেরিকায় গিয়ে কে কি আনন্দ করবে তারই কথা বলে আনন্দ পেত। একজন নাবিক বলছিল সে ব্রনজ গিয়ে ছুটির দিনগুলি কাটাবে। ব্রনজ প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার বিনা লাইসেন্সের প্রাইভেট বারবণিতাদের আড্ডাস্থল। যে দেশ পৃথিবীর ধনের মালিক সে দেশে যদি অর্থাভাবে যুবতীরা শরীর বিক্রয় করে তাতে কার না দুঃখ হয়। একেই বলে পূঁজিবাদ। পূঁজিবাদীরা নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে আপনজনের প্রতিও অত্যাচার করতে ছাড়ে না। এতক্ষণ আমি গ্যাথো বলেই সকল কথার অবসান করছিলাম। গ্যাথো হল পোল্যান্ডে। পোল্যান্ডের ধনী, জমিদার এবং শাসক শ্রেণীকে কে না জানে? বাংলাদেশের ধনী, জমিদার এবং উপশাসকদের সঙ্গে পোল্যান্ডের সমুহ মিল আছে সেজন্যই পোল্যান্ডের কথা বাদ দিয়ে আমেরিকার কথা বলাই দরকার।

আজ যাকে গ্যাথো বলা হচ্ছে গতকাল এই স্থানটুকুকেই ব্রনজ বলা হত। এখনও লোকে অফিসিয়েল মতে গ্যাথোকে ব্রনজই বলে। ব্রনজে ইহুদী থাকে না, খৃষ্টানও থাকে। এখানকার কৃষ্টানরাও দরিদ্র। খৃষ্টান যুবতীরাও এখানে শরীর বিক্রী করতে বাধ্য হয়। ফাঁদার হপকিন, ফাঁদার ডিভাইন তাঁরা শুধু মুখে মুখেই লোক সেবা করছেন কিন্তু তাঁদের মস্তিষ্ক এতই উর্বর যে, কি করে এই জঘন্য বারবনিতাবৃত্তি ব্রনজ হতে লোপ পায় তার ব্যবস্থা করতে অসমর্থ। এখানে ইহুদীরা দরিদ্রতা সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি যাতে করে তাদের দোষ দেওয়া যেতে পারে। ইহুদীরা এখানে আসার পূর্বে খৃষ্টানরাই এখানে বাস করত, তবে কেন এদের এই দুর্দশা? এই দুর্দশনার জন্য আমেরিকার ধনীরাই দায়ী।

ব্রনজ হতে ফিরে আসতে অনেক রাত হয়েছিল। তবুও ইচ্ছা হচ্ছিল আরও দেখি। আরও লোকের সংস্পর্শে আসি। কিন্তু ঠাওর করে উঠতে পারছিলাম না কোনটা দেখতে হবে, কোন বিষয়টা জানতে হবে। টাইমস স্কোয়ার কাছেই। টাইমস স্কোয়ারটা দেখে আসবার ইচ্ছা হল। সেদিকে একটু বেড়াবার পর এক জন পূর্তকরীকোবাসীর সঙ্গে দেখা হয়। লোকটি বেশ বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান। তাকে নিয়ে সোজা ঘরে চলে আসলাম এবং পুর্তরীকোতে আমেরিকানরা কেমন শাসন চালাচ্ছে তারই কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম।

পুর্তরীকোবাসিন্দা ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা বাঙ্গালীর মতই দেখায়, তবে তাঁর চুল অনেকটা নিগ্রোদের মত। তিনি নিজেই বললো ‘যদিও আমার শরীরের গঠন অনেকটা আপনার মতই, তবুও মাথার চুল নিগ্রোদের মতই রয়ে গেছে। আসলে আমি নিগ্রোই। আমার পূর্বপুরুষ এদিকের বাসিন্দা নন, তাঁরা কেনা গোলাম ছিলেন এবং তাঁদের আনা হয়েছিল আফ্রিকা হতে। আমার শরীরে নানা রকমের রক্ত আছে যেমন, স্পেনিশ, ইন্ডিয়ান এবং নিগ্রো। লোকটির সরলতা আমাকে মোহিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, স্পেনিশ রাজত্বের সময় তাদের ভয়ানক দুর্দিন ছিল। আমেরিকানরা যেদিন হতে তাঁদের দেশে পদার্পণ করেছে সেদিন হতেই তাঁদের উন্নতি আরম্ভ হয়েছিল। এখন তারা বেশ সুখেই আছেন।

তিনি দুঃখ করে বললেন কতকগুলি বিদেশী লোক তাদের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করছে। এই চিৎকাররের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কতকগুলি আমেরিকানও বলছে পুর্তরাকোদের স্বাধীন করে দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সকল রকমের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করা হউক। অনেকে আবার পুর্তরীকোর সঙ্গে হিন্দুস্থানেরও তুলনা করে। তারা বলে ভারতবর্ষ যদি বৃটিশ শাসন হতে মুক্তি পাবার জন্য আন্দোলন চালাতে পারে তবে পুর্তরীকোও সেরূপ মুক্তি সংগ্রাম চালাবার যোগ্য। আমি পুর্তরিকো ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কি স্বাধীনতা চান না? ভদ্রলোক হেসে বললেন ‘না মহাশয়, আমরা স্বাধীনতা চাই না। আমেরিকানরা যদি আমাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা চায় তবে তা আমরা দেব না।’

পুর্তরীকো পুরাতন একটি দ্বীপ। দ্বীপের আদিম আধিবাসীরা অনেক বৎসর ধরে পুর্তুগীজ এবং স্পেইনিশদের সঙ্গে লড়াই করে একেবারে নির্মুল হয়। পরে এই দ্বীপে নিগ্রোদের আগমন হয়। নিগ্রোরা পর্তুগীজ এবং স্পেনিশদের গোলাম ছিল। নিগ্রোদের দ্বারা সকল কাজ হত না বলে ইন্ডিয়ানদের আমদানী করা হয়। স্পেনিশরা পুর্তরীকো দ্বীপের উন্নতি অতি অল্পই করেছিল; পরে আমেরিকানরা যখন এই দীপটি দখল কল তখন দাসব্যবসা একদম উঠিয়ে দিয়ে আমাদের সমূহ উন্নতি করতে থাকে। পুর্তরীকো পার্বত্যদেশ। এদেশে জমির বড়ই অভাব। আমরা আমেরিকার গমের উপরই নির্ভর করি। আমাদের লোকবল নাই এবং যা আছে তাদের শিক্ষাও তেমন নাই যাতে করে আমরা আমেরিকাকে ছেড়ে দিয়ে একদিনও টিকতে পারি।

আমাদের দ্বীপে যে সকল আমাদের কাজ করে তাদের মাইনের সঙ্গে আমাদের মাইনের কোন প্রভেদ নাই। আমরা যখন আমেরিকায় আসি তখন আমেরিকানদের সঙ্গে থাকতে পাই, যা স্থানীয় নিগ্রোরা পায় না। আমেরিকার বাইরে থেকে যদি কেউ আমেরিকানদের সমান মজুরী পায় তবে আমরা পাই এবং ফিলিপাইনেরাও পায়। ফিলিপাইনোরা স্বাধীন হাবার উপযুক্ত কারণ তাদের লোকবল, এবং তাদের দেশের মাটির নীচে এবং উপরে দরকারী জিনিস পাওয়া যায়। আমাদের দেশে আম, কাঁঠাল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু আম কাঁঠাল বিক্রি করে কি আমরা বাঁচতে পারি? আমরা আমেরিকার ঘাড়ে উঠে বসেছি, কোন মতেই আমরা আমেরিকার ঘাড় হতে নামব না। আমেরিকার অসৎ লোক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুক, তাদের কথা কে শুনে?

বাস্তবিক পুর্তরীকো দ্বীপ হতে আমেরিকার কোন লাভই হয় না। পিমীর এবং স্কটরা নামক দ্বীপ দুটি রক্ষা করার জন্য বৃটিশ সরকার যেমন বিনা দ্বিধায় টাকা খরচ করেন, তেমনি আমেরিকাও পুর্তরীকো দ্বীপটির রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হল। আসলে পুর্তরীকো দ্বীপ কখনও একটি ব্যবসায়ের স্থান হবে না।

পুর্তরীকো ভদ্রলোক সে রাতটি আমারই সঙ্গে কাটিয়ে পরের দিন হতে আমার ঘরে রীতিমত আসতে থাকেন এবং তাঁর সাহায্রে আমি আমেরিকার অনেক কথা জানতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই পুর্তরীকো ভদ্রলোক আমেরিকার প্রায় দেশই ভাল করে বেড়িয়েছেন। একদিন তাকে ‘হিন্দু আমেরিকা’ সম্বন্ধে কতগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে বলেছিলেন হিন্দুদের সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না, তবে আরব সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁর বেশ অভিজ্ঞতা আছে। ঘটনাক্রমে তিনি টানজিয়ার্স হয়ে স্পেনে যান এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। স্পেনের সঙ্গে আরব সভ্যতার সমূহ সম্বন্ধ রয়েছে এবং স্পেনিশ সভ্যতাই দক্ষিণ আমেরিকার সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.