আজকের আমেরিকা (২৬)–শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

নিউইয়র্ক হতে বিদায়ের পূর্বে একটা ছোট কাফেতে কয়েকজন লোকের সামনে বসে হঠাৎ কি একটা কথা বলেছিলাম। সেখানে ছিলেন রকফেলার বিল্ডিংএর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। আমাকে তিনি তাঁদের বিল্ডিং সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্ন করেন। আমি তার উত্তর আমার মতেই দিয়েছিলাম। অনেকের ধারণা বড় বড় বিল্ডিংএর ভারে নিউইয়র্ক ডুবে যাবে। আমি বলেছিলাম, ‘হাঁ সেরূপ ধারণা করার মত লোক পৃথিবীতে অনেক আছে তবে আমি সেরূপ হিন্দু নই। শক্ত ‘বটম’ (পাথর) যথায় উপরে ভেসে উঠেছে এবং যথায় গ্রেনেট হাতুড়ি দিয়েও ভাংগা যায় না সে স্থানে অট্টালিকার ভারে নগর ডুবে যাবে তা বাতুলই বলতে পারে।’ বোধ হয় ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মহাশয় সাধারণ লোকের কাছ থেকে এরূপ কথা শুনেননি। তাই আমাকে তাঁর বাড়ি দেখতে নিমন্ত্রন করেন। পরের দিন যখন রকফেলার বিল্ডিং দেখতে গেলাম তখন দর্শকরূপে অনেক লোক তথায় হাজির ছিল। একটি একটি করে অনেক রুম দেখান হল। যখনই আমাকে কোন প্রশ্ন করা হচ্ছিল আমি হাঁ হুঁ করেই জবাব দিচ্ছিলাম। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বললেন, ‘এরূপ বিল্ডিং দেখে আপনার মন যেন উঠছে না বলে মনে হয়, তার কারণ কি?’ আমি বললাম, ‘দেখার মত এমন কিছু এখনও চোখে পড়েনি, যার উপর কোন মন্তব্য করা চলে। কংক্রিট, কাঁচ, লোহা, টিন–এর বেশি এখনও কিছুই দেখিনি।’ তখন তিনি আমাকে ঘরের দরজার সামনেকার কয়েকখানা পাথর দেখালেন।

আমি পাথর সম্বন্ধে কিছু জানতাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই পাথর কখানা যদি পাইরাইটিশ হয় তবে তার ওজন কত হবে?’ আমি বললাম, ‘পাইরাইটিশ গলান যায় কিনা তা আমি জানি না এবং যদি গলান সম্ভব হয় তবে প্রত্যেক খানার ওজন পঞ্চাশ হতে ষাট টন হবে।’ আমার জবাব শুনে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বুঝলেন, আমি আমার একমাত্র মাটির উপর ঘুরেই সন্তুষ্ট হইনি, মাটির নীচের সংবাদও কিছু রাখি। একটুকু বাজিয়ে দেখে আমাকে তাঁদের রেডিও সিটিতে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের দেশে কতগুলি ভাষার সাহায্যে লোকে কথা বলে?’ বুঝতে পারলাম, আমি যা বলব তাই অমনি ব্রডকাষ্ট হবে। জবাব দিলাম, ‘ভারত বর্তমানে একটি মাত্র ভাষা, যা প্রায় সকলেই বুঝে।’

‘তার নাম কি?’

‘হিন্দুস্থানী।’

‘শুনতে পাই ভারতে প্রায় শ’খানেক ভাষা আছে?’

‘আমিও শুনেছিলাম, আমেরিকায় সবাই মিলিয়োনিয়ার।’

‘তবে কি কথাটা প্রপেগেণ্ডা?’

‘অনেকটা তাই।’

‘আপনার জানামতে অন্য কোন ভাষা ভারতে প্রচলিত আছে কি?’

‘হাঁ।’

‘তার নাম কি?’

‘তামিল।’

‘হিন্দুস্থানী এবং তামিল ভাষার মাঝে প্রভেদ কি?’

‘দুটি ভাষা দুটি মূল হতে বের হয়েছে।’

‘তামিলরা হিন্দুস্থানী বুঝে?’

‘পূর্বে বেশ ভালই বুঝত, মাঝে ইংলিশ ভাষা শিখতে গিয়ে হিন্দুস্থানী ভুলে যায়, এখন তারা আবার পূর্বস্মৃতি জাগিয়ে তুলছে।’

‘অন্য তিনজন ভারতীয় পর্যটক বলেছেন যে ভারতে অন্তত পঞ্চাশটি ভাষা বিদ্যমান।’

‘আমি বলি আমেরিকায় সত্তরটি ভাষার প্রচলন আছে, সে সম্বন্ধে আপনি কি বলতে চান?’

‘আমি বলব মিথ্যা কথা।’

‘আমি বলছি সত্য কথা। ঐ দেখুন গ্রীক, শ্লাভ, ইতালীয়ানো, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগীজ, স্পেনিশ ভাষায় সংবাদপত্র রযেছে, তবুও বলতে চান আমি মিথ্যা বলছি? তারপর মেডিটেরিনিয়ানবাসীদের মধ্যে কত ভষার প্রচল আছে তা যদি দেখতে চান তবে চলুন ২০ নম্বর স্ট্রীটে। এসকল ভাষা তো কতকগুলি লোকের মাঝে সীমাবদ্ধ। ঠিক সেরূপ ভারতেও কতকগুলি ভাষা কতকগুলি লোকের মাঝে সীমাবদ্ধ, কিন্তু সকলেই বোঝে হিন্দুস্থানী। এখন বলুন এই সত্য সংবাদ দিবার জন্য আমাকে কত দিবেন এবং কতইবা মিথ্যা সংবাদ-বিক্রেতাদের দিয়েছেন?’

হঠাৎ চারদিক আলো করে বাতিগুলি জ্বলে উঠল। হাজার লোকে বসে যেখানে থিয়েটার শুনে, প্রবেশমূল্য যেখানে সকলের পকেটে সকল সময় থাকে না, হলিউডের স্টাররা যেখানে কথা বলে ধন্য হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ইমপেরিয়েল বিল্ডিং ছাড়া আর কারো সংগে যার তুলনা হয় না–সেই বিল্ডিং দেখে নয়ন আমার সার্থক হল। আজ আমার পরিব্রাজক-জীবন ধন্য হল–ঠকি নাই বলে, লোভ করি নাই বলে, দেশকে বেচি নাই বলে, ছোট-খাট ভাব আমার হৃদয়ে স্থান পায় নাই বলে। আজ আমি আর নিউইয়র্ক-এ থাকতে চাই না। নিউইয়র্কবাসী তথা আমেরিকাবাসী জেনেছে, ভারতের প্রকৃত পর্যটক টাকায় বশ হয় না, কারু কাছে মাথা নত করে না।

রকফেলার বিল্ডিং-এ বসবার স্থান যেমন করে করা হয়েছে পৃথিবীতে আর তেমনটি কোথাও নাই। বসবার স্থানটিকে ওডিটরিয়াম বলা হয়। পূর্বকালে এরূপ বসার স্থান গ্রীকরা ব্যবহার করত সেই ধরনে লসএনজেলসে অলিম্পিয়া গড়া হয়েছে কিন্তু রকফেলার বিল্ডিংএ বসার স্থান অন্য ধরনের। এর তুলনা শুধু এরই সংগে হয়। আমাদের দেশের লেখকগণ দিল্লীর বাদসার মসনদের কথা বেশ করে বলে ধন্য হয়েছেন। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের সাহিত্যিকগণ দেশ-দেশান্তর ভ্রমণ করতে যাননি। যদি দিল্লীর বাদসার মসনদের বর্ণনাকারিগণ চীন-সম্রাটের মসনদ দেখতেন তবে দিল্লীর বাদশাকে ফরগণা গ্রামের ফকিরই বলতেন, আর বলতেন ভারতবাসীও দরিদ্রের জাত। চীন সম্রাটের প্রাসাদ, মসনদ এসবের সংগে তুলনা করার মত এমন কোন মসনদ অথবা প্রাসাদ ভারতে গড়ে উঠেনি। তাজমহলের নাম এখানে মোটেই বলা চলে না।

বর্তমান সময়ের বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল কি করে পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের একটি হয়েছিল এখানে তা বক্তব্য বিষয় নয়। সময় আসলে তাজমহলের ‘আশ্চর্য’ জিনিসটুকু আপনি প্রকাশিত হবে।

পুর্তরীকো ভদ্রলোককে সংগে নিয়ে আরও অনেকগুলি বড় বড় অট্টালিকা দেখতে গিয়েছিলাম। অট্টালিকাগুলি দেখে বড়ই আনন্দ হয়েছিল। নিউইয়র্ক নগরের বড় বড় বিল্ডিংএর একটি বিজ্ঞপ্তি পত্র আছে। সেই বিজ্ঞপ্তি পত্র অনুযায়ী নিউইয়র্ক নগরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ভবিষ্যতের পর্যটকগণ যদি দেখেন তবেই ভাল হবে কারণ বিজ্ঞপ্তি পত্রের ওদল বদলও হতে পারে।

রেডিও সিটি দেখে মনে একটা কি ভাব হল তা বলতে পারি না। একদম রুমে এসে মি: ও মিসেস মুখার্জির কাছে পত্র লিখেই তা পোস্ট করলাম এবং সাইকেল বের করে ছোট ঝোলাটি কেরিয়ারে বেঁধে সটান চিকাগোর পথে এসে দাঁড়ালাম।

আজ আমি নিউইয়র্ক হতে বিদয়া নিব।

চিকাগো নিইউয়র্ক হইতে অনেক দূরে। হাজার মাইল পথ চলে তবে কয়েক দিনের মাঝে ভেবে পথে বেরিয়েছিলাম কিন্তু আমার মনে ছিল না আমাকে একটি বৃহৎ সেতু পার হতে হবে। এরূপ সেতু পৃথিবীতে আর নাই বললেও চলে। উপর দিয়ে চলেছে এলিভেটর, তার নীচে চলেছে মোটরগাড়ির লহর। মিনিটে মিনিটে সেতুর নীচে ফেরী বোটগুলির চিমনিগুলি উপরের পথিকদের নাকমুখ ধোঁয়া দিয়ে কালো করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে দৃশ্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হল না, হতে পারে না। চলতে হবে, নতুবা পথ বন্ধ হয়ে যায়, ঘাড়ের উপর লোক এসে পড়ে। সেতু পার হয়ে গিয়ে একটা ফাঁকা স্থানে এসে চোখ ভরে নিউইয়র্ক নগরের রূপ দেখতে লাগলাম। নগরের পরিচিত বন্ধুদের বলে আসিনি কেথায় যাব। তাই কাছের একটি মোটর স্ট্যাণ্ড হতে ফোন করে বাড়িওয়ালীকে আমার পথের নির্দেশ দিয়ে জানালাম, ‘আজ যদি কেউ আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে আসে, তবে জানাবেন আমি কোনপথে গিয়েছি।’ বাড়িওয়ালী আমাকে জানালেন যে, এরই মাঝে কয়জন লোক এসে চলে গেছে এবং বলে গেছে আবার তারা আসবে। বাড়িওয়ালীকে জানালাম, ওয়াল্ড ফেরারের কাছেই কোথাও রাত্রি কাটাব এবং ঠিকানা জানালে যেন বন্ধুবান্ধবদের তিনি জানিয়ে দেন। বাড়িওয়ালী গুডবাই বলে রিসিভার রেখে দিলেন। এতদিনের পরিচয় নিমেষে কেটে গেল। একই বলে পথপ্রবাসের বন্ধুত্ব।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.