ভারতবর্ষ যেমন ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামায় আমেরিকার লোক বিজ্ঞানের এত উন্নত স্তরে উঠেও তেমনি সেই ভাগ্যের কথা ভুলে নি। যেখানে ভাগ্যের দৌরাত্ম্য সেখানে জুয়া খেলার প্রাবল্য। বিশ্বমেলাও সে দোষ থেকে বঞ্চিত হয় নি দেখলাম। ছোট ছোট ঘর বেঁধে জুয়ার সব আড্ডা হয়েছে। লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য মাইক্রোফোনের সাহায্যে বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, জুয়ারড়ীদের পকেট খালি। যাদের জুয়া খেলার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তারেদও পয়সায় কুলাচ্ছে না। আমেরিকার অর্থ সর্বসাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে আর ছড়ান নাই, আমেরিকার অর্থ কেন্দ্রীয়ভূত হয়েছে। অর্থের ধর্মই হল তাই। আমার ভ্রমণ সময়ে তিনটি বিশ্বমেলা দেখেছি। সর্বপ্রথম বিশ্বমেলা দেখেছিলাম ভ্রসেল্মে । সেখানে ভারতের কতকগুলি চিত্র দেখান হয়েছিল। সেই চিত্রগুলি কুৎসিত ছিল। যে কোন লোক তা দেখে ভারতবাসীকে বর্ব্বর বলে নির্ধারণ করতে পারত। দ্বিতীয় বিশ্বমেলা দেখলাম নিউইয়র্কে। এটি সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। এখানে ভারতের কোন প্রদর্শনী খোলা হয়নি দেখে সুখী হয়েছিলাম।
গ্রেট বৃটেনের পক্ষ থেকে এখানে একটি প্রদর্শনী খুলা হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীর পুরোভাগে একটি গোলকে, বৃটিশ সাম্রাজ্যে কি করে সূর্য অস্ত যায় না তাই দেখান হয়েছিল; লক্ষ্য করে দেখলাম, অনেক দর্শক এই দৃশ্যটি দেখেই থমকে দাঁড়ায়। দর্শকদের মুখভংগি দেখে বেশ ভাল করেই বুঝতে পারা যায় তারা যেন এই দৃশ্যটি দেখতে ভালবাসে না। এই দৃশ্যটি দেখার পর প্রত্যেকের মুখেই হিংসার ভাব ফুটে উঠছিল। যারা সাম্রাজ্যবাদ ভালবাসে তাদেরই এই দৃশ্য দেখে অন্তর জ্বলে, আমার কিন্তু সেরূপ কিছুই হয়নি কারণ আমি বেশ ভাল করেই জানতাম, সাম্রাজ্য বলে কারো কিছু থাকবে না।
তারপরই ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের বংশ পরিচয়ের চিত্র। জর্জ ওয়াশিংটন নাকি ইংল-ের রাজপরিবারের রক্তের সংগে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বেশ ভাল কথাই। রাজার রক্তে এবং প্রজার রক্তে প্রভেদ আছে বলে যারা পরোক্ষভাবে প্রচার করে তারা আদীম যুগের লোকের মনোভাব পোষণ করে। রাজা সমাজেরই একজন, তার রক্তের গুণগরিমা এক দিন নির্যাতিত লোক করত। যারা ডিমক্রেট বলে বড়াই করে তাদের পক্ষে রাজার রক্তের পরোক্ষভাবে বাহাদুরী করা পুরাতন বর্বরতাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি সে দৃশ্যটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর অন্যদিকে চলে গেলাম।
আমেরিকার তরফ থেকে কতকগুলি দ্রব্য একটি ভূগর্ভে রক্ষিত হয়েছিল। কি কি দ্রব্য রক্ষিত হয়েছিল তার লিষ্ট আমার জানা নাই। তবে শুনেছি একখানা বাইবেলও রক্ষিত হয়েছে। আমেরিকার লোকের ঠিক ধারণা রয়েছে পৃথিবীটা একবার লয় হবে এবং পৃথিবীরই আবার গঠন হবে। বৈজ্ঞানিকদের জানা উচিৎ যা একবার লয হয় তা আবার সেই আকৃতি এবং প্রকৃতিতে গড়ে উঠে না।
আমেরিকার পল্লীগ্রাম
প্রভাতে উঠে মেলা পিছনে রেখে এগিয়ে চললাম। অনেক গ্রাম পথে পড়তে লাগল। মনে হল আমার গ্রাম দেখা উচিত। তাই গ্রামে গ্রামে সময় কাটাতে আরম্ভ করলাম। ইউরোপের অনেক গ্রাম দেখেছি, কিন্তু আমেরিকার গ্রাম অন্য ধরনের। গ্রামে বিজলী বাতি, গ্যাস, গরম ও ঠাণ্ডা জলের কল, আধুনিক স্বাস্থ্যনিবাস, পেট্রল স্ট্যাণ্ড, হোটেল, রেস্তোঁরা, কেবিন সবই বর্তমান। গ্রাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং কোলাহলহীন। প্রত্যেক গ্রামে ছোটদের স্কুল এবং বড়দের কলেজ আছে। সব গ্রামই জনবহুল। ছোট গ্রামে শুধু ছোটদেরই স্কুল আছে। আমাদের কলকাতা শহরেও এমন কোনও স্কুল-গৃহ নেই যার সংগে সেসব গ্রামের স্কুল-গৃহের তুলনা করতে পারা যায়। অনেকে বাংলো করে বাস করে এবং সেরূপ স্বাস্থ্যপ্রদ বাংলো ভারতে কোথাও দেখি নি।
আমেরিকার গ্রাম এবং ইউরোপের গ্রামে অনেক প্রভেদ রয়েছে। ইউরোপের গ্রামের পথগুলি প্রায়ই বাঁকা, ফুটপাথ অপ্রশস্ত, বাড়ীর ভিটি কোথাও বেশ উঁচু আর কোথাও একেবারে নীচে নেমে এসেছে। আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চলে কোনও সময়ে ইউরোপের মতই বাড়ি ঘর এবং বাঁকা পথ ছিল, কিন্তু যখন থেকে ফোর্ড কোম্পানী মাটি কাটার কল তৈরি করেছে, সে সময় থেকে পার্বত্য গ্রামেও সোজা পথ, সমান লেভেলে বাড়ি গড়ে উঠেছে। আমেরিকার গ্রামে নতুনের গন্ধ পাওয়া যায়। ইউরোপের গ্রামে পূরাতনের প্রাধান্য বর্তমান। আমরা ভারতবাসী, আমরা ইচ্ছা করেই বলব, আমেরিকার গ্রামও একদিন পুরাতন হবে, ইউরোপের গ্রামের মত হবে। আমি বলছি তা হবে না। আমেরিকার গ্রাম চির নতুন থাকবে। হয়ত বর্তমান অবস্থা হতে আমেরিকার গ্রাম আরও উন্নত হবে, কারণ আমেরিকাতে এখনও ধর্মের বদখেয়ালী নাই। ভবিষ্যতে ‘অধর্মরূপী ধর্ম’ পৃথিবীর উপর তাণ্ডব নৃত্য করতে সক্ষম হবে না।
আমেরিকার গ্রামে ক্রমেই লোক সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে প্রত্যেকটি গ্রাম শহরে পরিণত হবে। শহরের লোক আনন্দে দিন কাটাবে। ইউরোপের পরনেই আমেরিকার গ্রাম গড়ে উঠেছে। আমেরিকার গ্রাম কিন্তু ইউরোপের গ্রামের ছাপ প্রায় মুছতে বসেছে। ইউরোপের প্রত্যেকটি গ্রামের ঠিক মধ্যস্থলে একটি চার্চ থাকে। চার্চকে কেন্দ্র করে গ্রামের গঠন হয়। আমেরিকার গ্রামে সেরূপ কিছুই নাই। গ্রামের মধ্যস্থলে বিদ্যালয়, সিনেমা, বিচারালয়, দোকান, বাজার এসব থাকে বটে কিন্তু তাতে গ্রামের সৌন্দর্য্য মোটেই লোপ হয় না, বরং বাড়ে। গ্রামের পাশে গোলাবাড়ি থাকে না, গৃহপালিত জীব দেখতে পাওয়া যায় না। গ্রাম দেখলেই আনন্দ হয়। আমার আনন্দ হত গ্রোসারী দোকান দেখে। দউ, দুধ, ক্রিম, ঘনদুধ, নানারূপ মিঠাই, শাক, শবজী এবং নানারূপ ফলমূল স্তরে স্তরে সজ্জিত দেখে। এসব দেখে সুখী হতাম কিন্তু ভোগর করার উপায় ছিল না।
প্রত্যেক গ্রামের একটু দূরেই পাইকারী বাজার। পাইকারী বাজারে শুধু দোকানীরাই যায়। দোকানীরা পাইকারী বাজার হতে মাছ, মাংস, সবজী, দুধ, মাখন ইত্যাদি কিনে নিকটস্থ ফেক্টরীতে গিয়ে “ড্রেস” করে। “ড্রেস করার বাংলা শব্দ আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। হবার কথাও নয়। সেজন্য ‘ড্রেস’ শব্দটি ব্যবহার করলাম। যেদিন আমাদের দেশ স্বাধীন হবে, পাইকারী বাজার হবে এবং তার কাছে ড্রেস করার ফেক্টরী হবে সেদিন ড্রস করার বাংলা শব্দ আপনি গড়ে উঠবে। ড্রেস করা কাকে বলে এখন তাই বলছি।
ধরে নেওয়া যাক একজন মাছ বিক্রেতা আধ মণ ওজনের একটা মাছ কিনল। আমাদের দেশ হলে মাছবিক্রেতা শিয়ালদহ হতে সেই মাছটা ঝাকায় করে অন্য কোন বাজারে নিয়ে গিয়ে তাই কেটে বিক্রি করত। আমেরিকায় তা হতে পারে না। ঝাঁকায় করে মাছ সহরের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। মাছবিক্রেতা নিকটস্থ ফেক্টরীতে যেতে বাধ্য এবং সেখানে গিয়ে সে মাছটাকে তার ইচ্ছা মত কাটবে আইস ছাড়াবে, ধুযে পরিষ্কার করে, জল নিংড়িয়ে ফেলবে, তারপর ওয়েল পেপারে পেক করে খুচরা বাজারে নিয়ে আসবে। ক্রেতা সেই মাছ আর না ধুয়েই কড়াইয়ে চড়াতে পারে। ক্রেতাকে মাছ কেনার পর বাড়িতে এসে কাটতেই হয় না ধুইতেও হয় না। অন্যান্য জিনিসও ঠিক সে রকমেরই ছোট বাজারে আনতে হয়।
ইংলণ্ডে আস্ত গরু, শূকর ঘরের ভেতর ক্রিয়ার্থ টাংগিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় ভেড়ার হাড় সমেত মাংসও দেখতে পাওয়া যায়। আমেরিকার কোথাও সেরূপ দৃশ্য দেখা যায় না। আপনার সারকুলার রোডে অথবা হুগ মার্কেটে ইংলণ্ডের নমুনা সকলের চোখেই পড়ে অনেকেই সেদৃশ্য এড়িয়ে যান, অনেকে মুখ হতে থুথুও ফেলেন, কিন্তু ‘বিলেত ফেরতা’ বাবুদের ইংল-ে সেরূপ দৃশ্য দেখে থুথু অথবা মুখ ফেরাতে দেখিনি। আমেরিকায় সেরূপ দৃশ্য কোথাও দেখা যায় না। আমাদের দেশে যে সকল গৃহপালিত জীবকে হত্যা করা হয় তা শহরের ভেতর দিয়ে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, আমেরিকায় তা কখনও হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও হতে পারবে না। কশাইখানা সর্বদাই গ্রাম অথবা শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সেখানে আজকাল মোটর যোগে জীবকে হত্যা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। মোটরের যখন ব্যবস্থা ছিল না তখনও গ্রামের ভেতর দিয়ে কশাইখানাতে গৃহপালিত জীব নিয়ে যাওয়া হত না।