আমেরিকার পত্তন হতেই কতকগুলি নিয়ম প্রচলিত হয়েছিল যা পুরাতন মহাদেশে প্রচলিত ছিল না। পুরাতন মহাদেশের শহর অথবা গ্রাম দেখলে মনে হয় যেস সবই দোকান, সবই বাজার কিন্তু আমেরিকায় তা নাই। শহরের অন্তস্থলে নীরবতা বিরাজ করছে। যে স্থানে বাজার, বিচারালয় এসব রয়েছে সে স্থানকে বলা হয় ডাউন টাউন। ডাউন টাউন ছেড়ে দিয়ে কয়েক ব্লক অগ্রসর হলেই গ্রাম্য ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এজন্যই আমেরিকার গ্রাম ইউরোপের গ্রাম হতে অনেক সাজানো এবং আরামপ্রদ।
এসব দিক দিয়ে গ্রামগুলি বাস্তবিক সুখের। কিন্তু আমার কাছে একটি কারণে তা বিশ্রী মনে হতে লাগল। গ্রামের লোক নিগ্রো এবং হিন্দুকে একই চক্ষে দেখে, সেজন্য কোনও হোটেলে তাদের স্থান দেয় না, এমন কি অনেক সময় বিপদ আপদে সাহায্যের কথাও ভুলে যায়। অনেক বক্তৃতা করলে, অনুনয় বিনয় করলে হয়ত কারও দয়া হয়, নয়ত নিগ্রোদের মতই আমাদেরও সংবর্ধনা হয়ে থাকে। ছোট ছোট গ্রামে নিগ্রোদের থাকার জন্য কোনও কেবিন নাই। এই রকম ছোটখাট অভাব আমাকে বিব্রত করে তুলছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আজই সাইকেলটাকে ট্রেনে অন্যত্র পাঠিয়ে দিই কিন্তু তা করলাম না। আমি নিগ্রো গৃহস্থের বাড়ি খুঁজে তাদেরই মধ্যে থাকতে লাগলাম। আমার উদ্দেশ্য–অন্তত পক্ষে কয়েকখানা গ্রাম দেখে এ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করে নেওয়অ। সাইকেলে লেখা ছিল “হিন্দু ট্রেভালার’, তাতে কাগজ এঁটে দিলাম। লোকে আর বুঝতে পারছিল না আমি কোথাকার লোক। এতে আমার অসুবিধা মোটেই হয় নি। কেউ কোনও প্রশ্ন আমাকে করত না, আপন মনেই দিন কাটাতাম। শেষে ব্রিংহামটন নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের কাছে এসে বেশ বড় এক নিগ্রোপল্লী পেলাম; এবং তাতে কয়েক দিন থাক ভেবে একটা হোটেলে স্থান নিলাম।
নিগ্রোদের মধ্যে বসে সময় কাটান একটা কষ্টকর কাজ। এদের মাঝে আমোদ-প্রমোদের কথাই বেশি। খেলার কথা নিয়ে তর্কাতর্কির সময় এদের মধ্যে ছুরি আর পিস্তলও চলে। সিনেমার কথাটা বড় উঠে না, কারণ যতগুলি অভিনেতা অভিনেত্রী নিগ্রোদের মাঝে হয়েছে তাদের কখনও নায়ক নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেওয়া হয় না। জো লইকে নিয়েই যা তাদের বাহাদুরি। রাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে তারা আলোচনা করতে মোটেই পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে ধর্ম নিয়ে বেশ আলোচনা করে। যখনই অবতারদের নিয়ে কথা হয় এবং তাদের আদিপুরুষ কে তা খুঁজে পাওয়া যায় তখনই তারা ভগবানের তত্ত্বকথায় ফিরে আসে। ক্লাবে বসে যখন তারা এসব কথা আমার সামনে বলত, আমি নীরব থাকতাম। আমি যে একজন পর্যটক এবং পর্যটকদের কাছে যে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় থাকে, সে ধারণা তাদের মোটেই ছিল না। এদিকে আমি এমন কোনও উপলক্ষ খুঁজে পেলাম না, যাতে করে এদের সংগে কোনও কথা বলতে পারি।
এমন করে একটি দিন কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন ক্লাবে বসে একটা বই পড়ছি, এমন সময় বাইরে-রাখা সাইকেলটা একটি শ্বেতকায়ের চোখে পড়ায় তিনি ভিতরে এসে আমার সন্ধান করতে লাগলেন। আমার পোষাক দেখে কেউ ধারণা করতে পারত না যে আমি পর্যটক; কারণ আমি মামুলী পোষাক পরতেই ভালবাসতাম এবং এখনও তাই ভালবাসি। সাদা লোকটি অনেক জিজ্ঞাসা করে আমার খোঁজ পেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে আমার সংগে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁর সংগে কথোপকথনের পর মিনিট দশেকের মধ্যে ক্লাবের হলে যারা উপস্থিত ছিল তাদের নিয়ে একটা শ্রোতৃম-লী তৈরি করা হল। আমি তাদেরই কথা তাদেরকাছে বলতে আরম্ভ করলাম। আমেরিকান লোকটি কাগজে ঢাকা সাইকেলের লেখা না ছিঁড়েও আমার সন্ধান করেছিলেন আর যাদের মাঝে আমি বসে রয়েছিলাম তারা আমারদিকে চেয়েও দেখেনি, আমার সম্বন্ধে কোন কৌতূহলই তাদের মনে জাগে নি। নিগ্রো এবং আমেরিকানে এখানেই প্রভেদ।
মাসের শেষ। আমাদের দেশেও মাসের শেষ হয়, মাসের আরম্ভ হয়। আমাদের দেশে এ দুটা সময় শুধু শহরেই অনুভূত হয়, গ্রামের লোক অনেক স্থলে কোন মাস এল আর কোন মাস গেল তার বড় একটা সন্ধান রাখে না। আমেরিকার গ্রামে মাসের শেষ হওয়ার সংবাদ সকলকেই রাখতে হয়। ঘরের ভাড়া দেওয়াটা অবশ্যকর্তব্য। গ্রামে ভাড়া ইত্যাদি দেবার সপ্তাহিক প্রথা নাই, গ্রামে আছে মাসিক ভাড়া দেবার প্রথা। মাসের শেষে ভাড়া দিতে না পারলে মালিক এসে পুলিশের সাহায্যে ভাড়াটেকে ঘর থেকে বার করে দেয়। ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মা পথে এসে দাঁড়িয়েছে, বাবা নূতন ঘরের অন্বেষণে বার হয়েছে, পুলিশ আইন বজায় রাখতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, এরূপ দৃশ্য গ্রামে মাসের শেষে বিরল নয়। গ্রামের বাসিন্দারা গ্রামের মালিক নয়। Real Estate Owner বলে এক রকমের কোম্পানি আছে, তারাই হল গ্রামের মালিক। তবে দু-এক জনের বাড়ি যে নাই তা নয়, রিঅ্যাল এস্টেট ওনার কোম্পানিই বর্তমানে আমেরিকার গ্রামে গ্রামে প্রাধান্য লাভ করছে। আমার মনে হয়, এরূপভাবে আর কিছুদিন গেলে আমেরিকার গ্রামগুলি রিঅ্যাল এস্টেট কোম্পানিরই হাতে চলে যাবে। গ্রামের লোক হবে প্রলিটারিয়েট। ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রলিটারিয়েট-এর সংখ্যাবৃদ্ধি মনে হয় সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার নয়তো নাৎসীবাদের দমননীতির আওতায় সমাজকে নিয়ে আসে। আমেরিকার গ্রাম দেখে আমার ভয় হল, মনে হল দেশটা এক অন্তর্বিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলেছে।
গ্রামের লোক পরিবর্তনের পথ চেয়ে বসে আছে। যে কোনও রকমের যে কোনও পরিবর্তন আসুক না কেন, মনে হয় গ্রামের লোক সাদরে তা গ্রহণ করবে। আমেরিকার মেরুদণ্ড গ্রামের কথা ওয়াল্স্ স্ট্রীটের কর্তারা যে সংবাদ রাখেন না, তা নয় তবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখবার চেষ্টা করেন।
নিগ্রো বাসিন্দাদের মাঝে ঘর ছেড়ে দেওয়া বা নূতন করে ঘর নেওয়ার কোনও চিন্তা নাই। তারা দৈনন্দিন দাস্যবৃত্তি করে কায়ক্লেশে যা পায় তাই দিয়ে ঘরের মালিকের মুখ বন্ধ রাখে, খাবার এবং পোষাকের প্রতি দৃষ্টি না রেখেই দিনগুনে যায়। একে জীবন বলা যেতে পারে না, একে বলা যেতে পারে নামরা পর্যন্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রটাকে চালু রাখা। এই অবস্থায় থেকেও এরা নিজেদের সুখী মনে করে, দিনটা কাটলেই যেন সকল বালাই চুকে গেল।
নিগ্রোপল্লী থেকে শ্বেতকায় পল্লীতে যাবার নিমন্ত্রণ হল। নিমন্ত্রণ মানে কথা বলবার এবং কথা শোনবার নিমন্ত্রণ। যখন ওদের পাড়ায় গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলাম, ওরা দেখল আমি আমি নিগ্রোদের মত কোন ভাবভংগী দেখাচ্ছি না, ওদের অন্যান্য মানুষের মতই গণ্য করে কথা বলতে আরম্ভ করেছি, তখন ওদের মাঝে সান্ত¡না এল, বুঝল হিন্দুস্থানের হিন্দু তাদের সমকক্ষ। মানুষের মন দুর্বলতায় ভরতি। একটু সমবেদনা পেলেই দুর্বল আপন হৃদয়ের দরজা খুলে দেয়; যেখানে তার যত ক্ষত তা দেখিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে প্রতিকারের কথা। সাদা পল্লীর লোক ভবিষ্যৎ যুদ্ধ এবং সে সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। পরিবর্তন আসবে কিনা–এই প্রশ্নের উপরেই তারা জোর দিল বেশি। কিন্তু আমি একজন পর্যটক মাত্র। লোকের দুঃখ কষ্টের কথা শুনতে পারি, হয়ত সমবেদনাও জানাতে পারি কিন্তু প্রতিকার করতে পারি না। হয়ত আমি বর্তমান জানি, বর্তমানের ঘটনাবলীর উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের কথা বলতেও পারি, কিন্তু সেটা হবে আমার একটা অভিমত মাত্র।
দেখলাম গ্রামে নগরে সর্বত্র সমানভাবে অভাবের আক্রমণ শুরু হয়েছে। যারা পারছে তারা নানামতে তার প্রতিবিধান করছে, যারা পারে না তারা অসহায় ক্লান্ত বৃদ্ধের মত পথের পাশে দাঁড়িয়ে পথের দৈর্ঘ্যরে সংবাদ লোকেরও এরূপ অবস্থা দেখে বাস্তবিক আমার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল।
এরূপ কষ্টের মধ্যে থেকেও গ্রামের লোক চপ করে কেন থাকে সে কথাটা তলিয়ে দেখা সমূহ দরকার। আমেরিকার ধনীরা বেশ ভাল করেই জানে, যদি গ্রামের লোকের প্রতি অত্যাচার করা হয় তবে বিদ্রোহ অনিবার্য। কিন্তু বিদ্রোহ হয় না। ধনীরাই বিদ্রোহ করতে দেয় না। সি, আই, ও গিয়ে গ্রামের লোকের সাহায্য করে। ফেডারেসন অব লেবার প্রতিবন্ধক জন্মায়। কেউ দিতে যায় আর কেউ অপহরণ করতে যায়। যারা দিতে যায় তারা দিয়ে আসে, আর যারা অপহরণ করতে যায় তারাও অপহরণ করতে সক্ষম হয়।
সি, আই, ও সর্বসাধারণের অভাবের কথা অবগত হয়ে তাদের অভাব মিটাবার চেষ্টা করে। ফেডারেসন অব লেবার সর্বসাধারণের সংগে সম্পর্ক না রেখে, সর্দার মজুরদের ঘুষ দিয়ে মজুরে মজুরে যাতে বিবাদ হয় তারই চেষ্টা করে। সর্দার মজুরের যখন পেট মোটা থাকে তখন সে সাধারণ মজুরের দাবী ভুলে গিয়ে আরাম করে। ফেডারেসন অব লেবারও একটি মজুর প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি মজুরের হিত না করে অহিতই তরে বেশি। মজুর হয়ে মজুরের কেন অনিষ্ট করে সেকথাটা জানতে হলে আরও একটু গভীর জলে ডুব দিতে হবে। আমি এত গভীর জলে পাঠক শ্রেণীকে টেনে নিব না।