গ্রামের মামুলী একটা আভাষ পেয়েই মনে হল এমন করে যদি গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াই, তবে আমার সমূহ ক্ষতি হবে। তাই সাইকেলখানা ট্রেনযোগে ডিট্রয় পাঠিয়ে দিয়ে হিচ হাইক করার জন্য প্রস্তুত হলাম। প্রথম দিন হিচ হাইকএর স্বাদ মোটেই অনুভব করতে পারিনি, কারণ গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিলেন আমি একজন পর্যটক, আমি তাদের দেশের হবো নই। পর্যটকের সম্মান সভ্যদেশে সর্বত্র বিরাজমান। তাই গ্রামবাসী মোটরকারে করে আমাকে ব্যাফেল পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
গাড়িতে বসে ভাবতে লাগলাম এরূপ করে ভ্রমণ করা কি আমার পক্ষে উচিত? পৃথিবীর প্রত্যেক ধূলিকণা আমার ভ্রমণের সাক্ষী থাকবে কিন্তু আমেরিকার ধুলিকণা ত দূরের কথা একটি লোকও আমার ভ্রমণের সাক্ষী থাকবে না। যেইমাত্র এই কথা মনে আসা অমনি স্থির করলাম আমার পক্ষে মোটরে আরাম করে বসে থাকা উচিত নয়, নেমে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। আমি মোটর হতে নেমে পড়লাম।
মোটর গাড়ি হতে নেমে আমি দাঁড়ালাম পথের পাশে। আমার সামনে দিয়ে অনেক গাড়ি চলে যাচ্ছিল। অনেকে ভদ্রতা করে আমাকে তাদের সংগে যেতে ডাকছিল কিন্তু আমার মন কিছুতেই কারো সংগে যেতে চাচ্ছিল না। যখন নিউইয়র্ক-এ ছিলাম তখন যারা আমার সংগে অধ্যাত্মতত্বের কথা বলতে আসত তাদের দস্তুর মত গাল দিয়ে বিদায় করে দিতাম, কিন্তু আজ আমারই মনে সেই ভূয়া অধ্যাত্মতত্ব জেগে উঠল কি? যে কোন প্রকারেই হউক আজ আমি পথে দাঁড়িয়ে পথের সৌন্দর্যই দেখব।
সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার আসল। আকাশে তারকারাজি ফুটে উঠল। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ বাতাস বইতে লাগল। দু একটা মোটরকার ফুসফাস করে চলে যেতে লাগল। সত্তর আশি মাইল যে মোটরকার ঘণ্টায় চলে তাদের ফুস করে চলে যাওয়া ছাড়া আর কি বলা চলে?
আমাদের দেশের লোকের আমেরিকার ‘হবো’দের সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই। আমেরিকাতে হবোরা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। আমাকেও অনেকে অনেক সময় ভুল করে হবো ভাবত। আবার যখনই বুঝেছে আমি হবো নই তখনই সম্মান এবং ভালবাসা দেখাতেও কসুর করে নি। আমেরিকাতে অনেক ভাবপ্রবণ যুবক পথের ডাক শুনে হঠাৎ বাড়িঘর আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে পথে বেরিয়ে যায়। ভাবপ্রবণতা অনেক সময়ই ভুল পথে পরিচালনা করে। আমেরিকার যুবকগণ খামখেয়ালী করে যখন পথে বেড়িয়ে পড়ে তখন তাদের কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। তবে পথে বেড়িয়ে কি লাভ হবে? কোন উদ্দেশ্য না দিয়ে যদি খামখেয়ালী করেও পথে বেরিয়ে পড়া যায় এবং কয়েকদিন পর দেশ পর্যটনের একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে লোক সমক্ষে তা ধরা যায় তবুও কোনমতে অনেকদিন বেড়িয়ে আসা যায়। আমেরিকাতে যে সকল যুবক পথে বের হয় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে অ্যাডভেঞ্চার করা এবং সেই প্রত্যক্ষ অ্যাডভেঞ্চার থেকে বই লেখা। দুঃখের বিষয় আমেরিকাতে সেরূপ বন জংগল নাই, আফ্রিকাতেও বন জংগল শেষ হতে বসেছে, অতএব কল্পিত অ্যাডভেঞ্চাররের বই পাঠ করে যারা হবো হয় তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
১৯৩১ সালের জুন মাস হতে ক্রমাগত ভ্রমণ করে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আমি ভ্রমণ করেছি। এই সময়ের মাঝে অনেক আপদ এবং বিপদ এসেছিল। আপদ বিপদের কথা বেশি লেখা হলে আসল কথায় ফাঁকি দিতে হয় সেজন্যই নিজের সুখ দুঃখের কথা মোটেই লেখতে প্রয়াসী হইনি।
আজকের আমেরিকায়, আমেরিকার কথা বলাই ভাল। আমেরিকাতেও আমার আপদ বিপদ ঘটেছে। সংক্ষেপে একটি ঘটনা বলব। একদিন একটি সভাতে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এবং সেই সভায যাওয়া ও ঠিক হয়েছিল। মি. ওডাইয়া নামক একজন পারসী ভদ্রলোকের রেঁস্তোরা হতে বের হয়ে পথে এসে সভাতে কি বলব তারই কথা ভাবছিলাম।
অভ্যাস মত পথ চলছিলাম। লাল রংগের বাতিগুলি এখন প্রজ্বলিত হয়ে উঠে তখন পথ অতিক্রম করতে হয়। নীল বাতি প্রজ্বলিত হলে দাঁড়াতে হয়। একটা পথের সামনে এসে (বোধহয় মেডিশন এ্যভিনিউই হবে) দেখতে পেলাম অন্যদিক দিয়ে লাল বাতি প্রজ্বলিত হয়েছে। এবং আমি যে দিকে যাব সেই পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। কি ভেবে একটু দাঁড়াল এবং সামনের উইনডো সো দেখে যে মুহূর্তে পথে আসলাম অমনি পথ বন্ধ হইয়া গেল। বাঁ দিক থেকে একখানা মোটরকার হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি যদি কসে ব্রেক না টানত তবে সেদিনই আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। অবশ্য আমার অসাবধানতার জন্য বেশ গাল শুনতে হয়েছিল। বেঁচে গেছি বলেই আমি সুখী হয়েছিলাম। কখনও ভাবিনি এই ছোট বিষয়টিকে ফেনিযে বড় করে লেখে সর্বসাধারণের কাছে উপস্থিত করতে হবে।
হবোরা কিন্তু এ ধরণের খাঁটি অ্যাডভেঞ্চারই লোকের কাছে বলার জন্য পিপাসু হত কিন্তু এরূপ অ্যাডভেঞ্চার কি সকল সময় ঘটে? এরূপ অ্যাডভেঞ্চার খুঁজতে গেলে মরণেরও সম্ভাবনা থাকে। আমেরিকার দুষ্ট লেখকগণ সরল সচ্চরিত্র যুবকদের বিপথগামী করে খাঁটি থিলিং গল্প পাবার জন্য ফরমাইস দিয়ে অনেক যুবককে পথে টেনে নিয়ে আসত। অবশ্য এখন সেরূপ বিপথগামী হবো খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
হবোরা প্রথম যখন পথে বের হয় তখন তাদের থাকে একটা সৎ উদ্দেশ্য, কিন্তু কয়েকমাস পর যখন কোন উদ্দেশ্যই সফলতার দিকে অগ্রসর হয় না তখন তারা বিগড়ে যায় এবং অন্যায় পথ অবলম্বন করে। কোনমতে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই হয়ে যায় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমেরিকাতে কোনমতে জীবন কাটান বড়ই কষ্টকর বিষয় সেজন্যই হবোদের কেউ পছন্দ করে না, পারলে বেকার বলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। সেরূপ হবো আমাদের দেশে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায় অবশ্য আমাদের দেশের হবোদের জেলেও যেতে হয় না, খাদ্যের অভাবেও কষ্টও পেতে হয় না। তারা হল সাধু। সাধুদের আমরা প্রতিপালণ করি পাপ হতে মুক্ত হবে বলে। অনেক বিদ্বান লোক সাধুসেবা করে ধন্য হন কিন্তু এই অশিক্ষিত বিদ্বানের দল জানেন না এরাও পথে বের হয় ভগবানের ডাকে, আর আমেরিকার হবোরা পথে বের হয় পথের ডাকে। উভয় দেশের হবোদের মাঝেই পথে বের হবার বেলা চিত্তের বিকার হয় এবং উভয় দেশের হবোদেরই যখন চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে, তখন বিপথগামী হয়। তবে দুঃখের বিষয় আমেরিকার হবোদের সর্বসাধারণ ঘৃণা করে এবং তাদের জেলে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে। আর ভারতের হবোরা ভারতের সর্বসাধারণের মাথায় নারিকেল ভেংগে তাই ভক্ষণ করে আনন্দে জীবন কাটায়। আজ আমার জীবনেও যে আমেরিকার হবোদের ভাবই ফুটে উঠল। গভীর রাতের ঠাণ্ডাকে অবহেলা করে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। নিদ্রা বেশ হল। ঘুম থেকে উঠে মনে হল দুর্বলের একমাত্র অস্ত্র হল হুকুম তামিল না করা, কিন্তু আমি দেখছি দুর্বল হতেও অধম। প্রকৃতির আদেশের তাবেদারী করছি। কেন আমার শরীরে ঠাণ্ডা লাগবে? উত্তম ঘরে উত্তম বিছানায় শোয়াই হল প্রকৃতির আদেশ অমান্য করা, মানুষ বলে পরিচয় দেওয়া। তা যদি না হত তবে আমাতে আর বন্য পশুতে অথবা অসভ্যদের মাঝে পার্থক্য কি?
মলিন মুখে উঠে দাঁড়ালাম। পথে এসে দাঁড়ালাম এবং একটি মোটরের চালককে ইংগিত করা মাত্র সে আমাকে তার মোটরে উঠিয়ে নিল। কোন হবোকে কেউ মোটরে উঠিয়ে নেয় না কিন্তু যারা হিচ হাইক করে তাদের অনেকেই সাহায্য করে। কারণ সাহায্যকারী অবগত আছে এই লোকটি দায়ে পড়েই সাহায্য নিচ্ছে, অন্যথায় কখনও সাহায্য নিত না। আমার সাহায্যকারী আমাকে ব্যাফেল পৌঁছে একটি হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। আমি আমার সাহায্যকারীকে সেদিন ধন্যবাদও দেইনি কারণ আমার মন হোটেল সম্বন্ধীয় চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিল। চিন্তাস্রোতে ভাসতে ভাসতে হোটেলে গেলাম। হোটেলে স্থান পেলাম। স্নান করে খেয়ে যখন রুমে শুতে যাচ্ছি তখন একজন বলল, ‘এ লোকটা কে হে, স্পেনিস হবো নয়ত?’ অন্য জন জবাব দিল লোকটাকে স্পেনিস বলে মনে হয় না, তবে নিগ্রো নয় এটা নিশ্চয়, আর হোব ত নয়ই।