যখন আমার ঘুম ভাংল তখন পরের দিনের বিকাল বেলার তিনটা বেজেছিল। হোটেলের কেউ আমার ঘুম ভাঙ্গায়নি নিজেই জেগেছিলাম। বিকাল বেলা ফের স্নান এবং খাওয়া সমাপ্ত করে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
সারাটা বিকাল বেড়িয়ে এসে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন যে ভদ্রলোক আমাকে মোটরে করে পথ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, হঠাৎ তিনি এসে উপস্থিত হলেন। ভদ্রলোকের নাম জন হার্টস এবং তাঁকে তাঁর নাম ধরে ডাকতে আমাকে অনুমতি দিলেন। আমিও আমার নাম ধরে ডাকতে তাঁকে অনুমতি দিলাম। অবশ্য নামটাকে ছোট করে বললাম আমার নাম ‘রাম’। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্ব পেকে উঠল এবং মিস্টার হার্টস আমাকে নিয়ে ডিট্রয় যাবেন বলে স্বীকার করলেন। হার্টস একজন বেকার যুবক। তাঁর সঙ্গে চুক্তি হল, আমি মোটরের পেট্রল খরচ বহন করব এবং তিনি মোটর চালাবেন। পথে অন্য যা কিছু খরচ হবে তা দুজনে সমান ভাগে বহন করব।
আমার নিউইয়র্ক-এর বন্ধুগণের সঙ্গে তখনও দেখা হয় নি। হার্টসকে বলেছিলাম, হয় তিনি আমার হোটেলে চলে আসুন, নয় ত আজ থেকে ছয়দিন বাদ দিয়ে সপ্তম দিনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করুন। এর মাঝে আমার নায়গ্রা প্রপাতও দেখা হয়ে যাবে।
আমেরিকায় ওয়াইএমসিকে ওয়াই বলা হয়। হার্টস সেখানে গেলেন। সেখানে আমার মত ভারতবাসীর প্রবেশ নিষেধ। চিকাগো, সল্টলেক্ সিটি, স্যানফ্রানসিসকো এবং লস-এ্যনজেলসএর ওয়াই দেখবার সুযোগ হয়েছিল। ওয়াই এক জাতীয় হোটেল বিশেষ। তাতে পুরুষ মাত্রেই থাকতে পারে। ওয়াই দু রকমের। একটা হল শ্বেতকায়দের জন্য, অন্যটা হল কালোদের জন্য। ব্যবসায়ের হিসাবে ওয়াই এর ব্যবসা বেশ লাভজনক। ওয়াই সম্বন্ধে এর বেশী যদি কিছু বলতে হয়, তবে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরুবার সম্ভবনা। অতএব এ সম্বন্ধে নীরব থাকাই ভাল।
আমার নিউইয়র্কের সঙ্গীরাও ওয়াইতেই থাকতেন। আমাকে নিগ্রো হোটেলগুলিতে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় সাদা হোটেলে খুঁজতে আরম্ভ করে আমার সাক্ষাৎ পেলেন। আমাকে পেয়ে তাদের কি আনন্দ। সাদায় কালোয় যে কত অন্তরংগতা হতে পারে তা তখনই মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিলাম। ওদের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্টতা থাকায়, অনেক দিন পর দেখা হল বলে তারা হেসে এবং চীৎকার করে রুমটাকে মাথায় তুলতে লাগল। কিন্তু তারা যখন আনন্দ করছিল তখন আমি মনের দুঃখে হাসতেও পারছিলাম না। অবশ্য সেজন্য তাদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল।
আমি তাদের বলেছিলাম, “বন্ধুগণ, আমার ভাবান্তরে আপনাদের চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি আজ অন্য কথা ভাবছি। আপনাদের দেশে যেমন নিগ্রোদের প্রতি সামাজিক অত্যাচার হয়, ঠিক সেইরূপই আমাদের দেশেও অনেকেরই প্রতি সেরূপ সামাজিক অত্যাচার হয়। তার প্রতিকার করবার জন্য মহাত্মা গান্ধী অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেন নি। কেন জানেন? যাকে আপনারা ডিমোক্রেসি বলেন, আর আমরা যাকে গণতন্ত্রবলি, আসলে তা কিছুই নয়। আপনাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, কিন্তু আপনারা যে পর্যন্ত না আমাকে হিন্দু বলে আপনাদের সমাজে পরিচয় করিয়ে দেবেন সে পর্যন্ত আপনাদের সমাজে আমার স্থান নেই। কি করে এই পাপ পৃথিবী থেকে দূর হয় তাই আমি মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ভাবি। আমার দেশে আমার সামাজিক স্থান তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর লোকের মাঝেই। যদি আফ্রিকা ও আপনাদের দেশ পর্যটন না করতাম, তবে এরূপ চিন্তা আমার মাথায় আসত না। মোগল সম্রাট, পাঠান সম্রাট আমাদের দেশ শাসন করেছেন, কিন্তু এখনও তাঁদের বংশধররা সর্বত্র স্পৃশ্য নন। এই বর্বরতায় তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করেন নি, চুটিয়ে রাজত্ব করতেই ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু সে ছিল এক যুগ, এখন নবযুগ এসেছে। এই নবযুগেও, বলতে গেলে নবযুগের অগ্রদূত সভ্য আমেরিকাবাসীদের মধ্যেও, ভারতের প্রাচীন এবং আধুনিক বর্বরতা বর্তমান দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।”
তাদের সঙ্গে কথা হল আমি একা যাব ‘নায়গ্রা ফলস’ দেখতে। নায়গ্রার মত এত বড় একটা পরিব্রাজকের তীর্থেও বর্ণ বৈষম্য মানা হয় কি না দেখব। পরদিন প্রাতে বাসে গিয়ে বসলাম। যে সকল বাস নায়গ্রায় যায় তাদের ‘স্ট্যাণ্ড’ শহরের বাইরে। বাস প্রত্যেক পাঁচ মিনিট অন্তর ছাড়ে। সেখান হতে বাসের ভাড়া কুড়ি সেণ্ট। আমাকে বাসে বসতে দেখে অনেকেই পরের বাসের অপেক্ষায় রইল। আমি একা। এদিকে বাস ছাড়বার সময় হয়ে গেছে কিন্তু আমি ছাড়া অন্য কোনও প্যাসেনজার বাসে উঠেনি। অগত্যা আমাকে নিয়েই বাস ছাড়তে বাধ্য হল। কনডাক্টরকে জিগ্যাসা করলাম, “আমি একা চলেছি, অন্যান্য যাত্রীরা আমার জন্যেই বাসে উঠেনি, সেজন্যে কি আমাকে বেশী কিছু দিতে হবে।” কনডাকটার বলল, “আজকে আপনাদের লোক (মানে নিগ্রো) এদিকে বড় বেশী আসে নি, তাই এমন হয়েছে, নতুবা আমাদের ক্ষতি বড় একটা হয় না। অবশ্য পথে অন্য যাত্রী পাব, তারা আপনার বসার জন্যে কিছুই মনে করবে না।” কথাটা শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম, কারণ আমার কাছে সামান্য অর্থ-ই ছিল।
পথে অন্যান্য যাত্রী উঠল। কেউ আমার গা ঘেঁসে বসল না। মনে মনে ভাবলাম, বর্বরদের মত বর্বর হয়ে লাভ নাই, আমিও উঠে দাঁড়াই। উঠে দাঁড়ালাম। দুটা বর্বর আমার পরিত্যক্ত স্থান দখল করল। অমনি তাদের গিয়ে বললাম, এখানে একটা সিট আমার, আপনাদের একজনকে দাঁড়াতে হবে। নীরবে দুজনেই উঠে দাঁড়াল। আমি ফের গিয়ে সিটএ বসলাম। এই দৃশ্যটি অনেকেরই চোখে পড়ল কিন্তু কেউই গ্রাহ্য করল না। আমিও চিন্তিত মনে আকাশ ভরা মেঘমালার দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম।
নায়গ্রা প্রপাত
বাস একটা প্রকা- সাগর তুল্য হ্রদের তীর দিয়ে চলছিল। হ্রদের মাঝে কবি-বর্ণিত নির্মল জলের অভাব। জল ধূসর বর্ণের। হ্রদের তীরে নানা রকমের এলোমেলো বাড়ি ঘর। দেখলেই মনে হয় এদিকে আমেরিকার ইনজিনিয়ারদের দৃষ্টি পড়ে নি। এককালে রেড ইণ্ডিয়ানদের অত্যাচার এদিকে বেশই হয়েছিল। রেড ইণ্ডিয়ানদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এককালে যেমন করে গৃহসজ্জা করতে হয়েছিল, তার চিহ্ন এখনও বর্তমান রয়েছে। কেন যে আমেরিকার ইনজিনিয়ারগণ এদিকে হাত বাড়াতে পারেন নি, তা নিয়ে মনে মনে অনেক ভাবলাম, কিন্তু উপসংহারে আসতে পারলাম না।
বাস ক্রমাগত চলছে। বাসের গতি ঘণ্টায় মাত্র পনের মাইল। এত আস্তে যাবার কারণ, পর্যটকদের হ্রদের সৌন্দর্য দেখবার সুযোগ দেওয়া। বাস কোম্পানি সাধারণের সুবিধার দিকে বেশ দৃষ্টি রাখেন। তাঁরা যেমন অর্থ উপার্জ্জন করেন, তেমনি যাত্রীদের সুখ সুবিধার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখেন দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল। বাস নায়গ্রা শহরের গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানীর স্টেশনে এসে হাজির হল। নিগ্রো কুলীরা প্রত্যেকের লাগেজ বার করে নিয়ে লাগেজরুমে রাখল। প্রত্যেকেই লাগেজের রসিদ নিয়ে নিজের নিজের লাগেজ মুক্ত করে যে যার পথ ধরল। আমার কোনও লাগেজ ছিল না তাই আমি পথে এসে দাঁড়ালাম। ইচ্ছা রাত্রি কাটাবার জন্যে সর্বপ্রথম একটা হোটেল ঠিক করে একটু আরাম করি, তারপর নায়গ্রা প্রপাত দেখতে যাই।
নায়গ্রা শহরটাই হল কতকগুলি হোটেল নিয়ে গঠিত। অনেক হোটেলে গেলাম। সব হোটেলেরই ম্যানেজার স্থান নেই বলে আমাকে বিদায় করে দিল। তারপর আমি হিন্দু বলে পরিচয় দিয়ে অনেক হোটেলের ম্যানেজারের কাছে ঘর পাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাতেও কেউ আমাকে স্থান দিল না। অর্থাৎ টাকা দেখিয়েও ঘর পাওয়া সম্ভব হল না। অনেক কষ্ট করে অবশেষে একটি নিগ্রো হোটেল খুঁজে বার করলাম। হোটেলের মালিক আমাকে পেয়ে বেশ আনন্দিত হল এবং আমার থাকার জন্য একটি রুম দেখিয়ে দিল।
রুমের ভাড়া প্রত্যেক রাত্রির জন্য দেড় ডলার করে (প্রায় সাড়ে চার টাকা) দিতে হয়েছিল। ঘরের ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে একটু আশ্বস্ত হলাম। হোটেলের মালিক আমার পরিচয় পেয়ে বড়ই দুঃখিত হল। সে আমাকে রাত্রে তার রেস্তোঁরায় খাব কিনা জিজ্ঞাসা করল। আমি রাজি হলাম না, কারণ সাদা হোটেলের খাবার ভাল এবং সস্তা। উপরন্তু তারা আমাকে রেস্তঁরায় ঢুকতে নিশেষ করে না। আমাকে রেস্তঁরায় প্রবেশ করতে নিষেধ করে না শুনে হোটেলের মালিক একটু আশ্চর্য বোধ করল। আমি তাকে বললাম, “তোমরাও যদি আমার মত সাহস করে রেস্তঁরায় গিয়ে খাবার দিতে আদেশ কর তবে হয়ত তোমরাও খাবার পেতে পার। দাবি করবার শক্তির তোমাদের অভাব।” হোটেলের মালিক এ কথারও কোনও জবাব দিল না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভগবানের উপর দোষারোপ করল। আমি আর কোনও কথা না বলে নায়গ্রা প্রপাত দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
নায়গ্রা প্রপাত দেখতে বেরিয়ে একেবারে প্রপাতের কাছে এসে পড়লাম। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিন্তু বিজলী বাতি চারিদিকে এমন তীক্ষè আলো বিতরণ করছে যে একদম যেন দিনের আলোর মত মনে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রপাতের শোভা দেখলাম। এতক্ষণ দেখেওে তৃপ্তি হল না, অনেকক্ষণ পায়চারি করলাম। যতই দেখতে লাগলাম ততই দেখবার ইচ্ছা হতে লাগল। আরও খানিকক্ষণ পায়চারি করে একটা পরিষ্কারস্থানে বসলাম এবং প্রপাতের দিকে চেয়ে রইলাম।