আজকের আমেরিকা (৫) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

33986_290774347684527_1888007642_n

মেডিরা

মেডিরা দ্বীপ আমাদের পথে আসবে তাই এখন থেকে সকল যাত্রীই মেডিরার কথা বলতে শুরু করেছে। দুঃখের বিষয় আমাদের জাহাজ সেণ্ট হেলেনা হয়ে আসেনি। সেজন্যই মেডিরা দেখবে বলে সকলের প্রাণে এত আনন্দ। আমার মনে হল মেডিরা বোধহয় তার ঠিক উচ্চারণ নয়, মদিরা হবে এবং মেডিরায় পৌঁছে বুঝতে পেরেছিলাম আমার অনুমান সত্য। জাহাজী সংবাদে একদিন বের হয়েছিল, জেনারেল ফ্রাংকো মেডিরা দ্বীপে সকল জাহাজের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে যে হের হিটলারের ইংগিত আছে, কিংবা মুসোলিনীর কোনও চালবাজী আছে, তা নিয়ে আলোচনা সর্বত্রই চলছিল। পরে ঐ জাহাজী সংবাদেই প্রকাশিত হয় চেম্বারলেন কি একটা অঘটন ঘটিয়েছেন যাতে করে সকল তর্কের অবসান হয়ে গেছে। নতুনকে সম্বর্ধনা করার আনন্দের চিন্তাধারা পুনরায় সকলের মাঝেই জেগে উঠল।

আমাদের জাহাজ মেডিরা গিয়ে ভিড়বে এই সংবাদ পাওয়া মাত্র সকলেই খেলার দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার ভারতীয় সংগীকে বললাম, “ভায়া, এই বেলা হাতের মুঠা খুলে রেখ, দেখা যাক এরা আমাদের কাছে আসে কিনা।” উত্তর তিনি বললেন, “ওরা টাকা নিবে কিন্তু খেলতে দিবে না।” আমি বললাম, “তার ভার আমার উপর রইল, আমি ওদের বেশ ভাল করে দেখে নিব।” আমার অনুমান ঠিক হয়েছিল। চাঁদার খাতা হাতে করে এক মিশনারী আমাদের কাছে এসেছিল। আমি চাঁদার খাতা হাতে নিয়ে বললাম, “আফ্রিকায় বাইবেল হাতে নিযে নিগ্রোদের যেমন ঠকাচ্ছেন, আমাদের কিন্তু সে রকম ঠকাতে পারবেন না, আমরা টাকা দিব কিন্তু প্রত্যেক খেলাতে আমাদের নাম দিতে হবে। যদি আমাদের সংগে দয়া করে কেউ না খেলেন, তবে আমরা মোটেই দুঃখিত হব না আমরা দুজনাতেই খেলব। আমরা খেলতে চাই এবং আমরা খেলবই এটুকু মনে রাখবেন।” ক্ষণিকের জন্য লোকটার মুখ লাল হয়ে উঠল, পরক্ষণেই তার মুখে অবস্থা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। আমি তাকে বললাম, “আপনি বেশ আত্মগোপন করতে পারেন, সেদিকে আপনি বাহাদুরী পেতে পারেন, নতুবা কি করে আফ্রিকায় নিগ্রোদের সর্বনাশ করতে পেরেছেন? এখন বলুন আমাদের কথায় রাজি আছেন কি?” অতি মিষ্ট স্বরে অতি মধুর কথায বিনয় নম্রভাবে আমাদের বাবাজী বললেন, “নিশ্চয়ই খেলবেন।” আমরা প্রত্যেকে পন শিলিং করে চাঁদার খাতায় সই করে দিলাম।

দুতিন দিনের পরই হয়তো আমরা সাউথ হামটনে পৌঁছব। আজ প্রভাতী খানা খেয়েই সবাই খেলায় লেগেছে। আমরা উপরে গিয়ে একটা বেনচে বসে নানারূপ খেলা দেখছিলাম। মাঝে মাঝে আমরাও খেলায় যোগ দিয়েছি। আমাদের খেলার সাথী হত সাধারণ ইহুদীই।

ইহুদীরা আমাদের সংগে খেলার সময় বেশ হাসত, আমোদ করত, আর দেখাত তারা আমাদের বন্ধু। আমার সাথী দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসী, সে বুঝতে পারত না কে ইহুদী এবং কে ইউরোপীয়ান, তাই সে সকলকে সমানভাবেই ঘৃণা করত। অনেক দিন তাকে বলতে বাধ্য হয়েছি, একটি ব্যক্তিবিশেষকে ঘৃণা করা যায় তা বলে একটা জাতের উপর এতটা বিদ্বেষ অন্যায়। অর্থ-পিশাচরূপে ইহুদীদের যে বর্ণনা সেক্সপীয়ার দিয়ে গিয়েছেন তাঁর শাইলক চরিত্রে তা সত্য হতে পারে কিন্তু ইহুদীদের মধ্যেও অনেক মহাপুরুষ আছেন, যাঁরা পৃথিবীর কল্যাণের জন্য অনেক মহৎ কাজ করে গেছেন।

মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। সূর্য ডান দিক হতে উঠেছে এবং বা দিকে অস্ত যাচ্ছে। নীচে সমুদ্র শান্ত তাতে কোনওরূপ ঢেউ নাই–আমাদের দেশের বড় পুষ্করিণীর জলের মত ধীর এবং স্থির। আমরা সেই দৃশ্যই দেখছিলাম। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ো মাছ জাহাজের কাছে জল থেকে উঠে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিল এবং আমাদের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করছিল। বাস্তবিক দিনটা কাটছিল আনন্দেই। কিন্তু গত রাত্রে একটা বই পড়েছিলাম তাতে লেখক সমুদ্রের ভীষণ তার কথা লিখেছিলেন। সমুদ্রের সংগে যাতের সাক্ষাৎ পরিচয় নাই এরূপ লেখক সমুদ্রের কত কাল্পনিক কাহিনীই না লিখেছেন। তাদের কল্পনার চোখের সামনে সমুদ্র সর্বদাই ভয়সংকুল হয়ে আছে, কল্পিত দৈত্যদানবের মত কত অতিকায় প্রাণী সমুদ্র তোলপাড় করছে। আমি বাস্তব সমুদ্রের আর কল্পিত কাহিনীর তুলনা করছিলাম এবং ভাবছিলাম, উচ্ছ্বাস ভাবপ্রবণতা কবিত্ব–এ আমার ভাবনার অন্ত ছিল না, কখন যে আমাদের পাদরী আমার কাছে এসে বসেছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি। পাদরী তাঁর ডান হাতটা আমার কাঁদের উপর রাখতেই আমার দৃষ্টি তাঁর দিকে গেল।

পাদরী বললেন, “ভাববেন না, আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই সাউথ-হামটনে যাব, ভগবান আমাদের সাহায্য করবেন।” পাদরীকে বললাম, “মহাশয় দয়া করে ভগবান এবং তাঁর পুত্রদের কথা আমাকে শুনাবেন না। আমার মংগলামংগল আমার হাতে। ভগবান এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষগণ আমাকে কোন সাহায্য করতে পারবেন না। এ সকল কথার উৎপত্তি হল ভয় হতে এবং এ সকল কথা শুধু ভয়েরই সৃষ্টি করে। সাময়িক উত্তেজনাও আনে বটে মদের নেশার মত, কিন্তু এর পর যখন মন দমে যায় তখন তার বুঝতে পারা যায় না কোথায় চলেছি। অতএব ক্ষমা করুন। কয়েকটি রচত মুদ্রার বিনিময়ে চোখে যে ঠুলি বেঁধেছেন তা অপসারণ করতে চেষ্টা করুন, দেখবেন বান্তু, কার্লাড হিন্দু এরাও মানুষ। এদের জন্য পৃথক করে চাচং তৈরী করতে হবে না।”

জাহাজের যাত্রীরা সবাই খেলার আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছে। আমি ও আমার ভারতীয় বন্ধুটিও চুপ করে বসে ছিলাম না, যখনই ফাঁক পাচ্ছিলাম তখনই খেলায় যোগ দিয়ে সেই আনন্দের অংশ গ্রহণ করছিলাম। জাহাজের একটানা জীবনের মধ্যে সমস্ত দিনের অলস একঘেঁয়েমীর পর প্রাণে চনচল সজীবতা ও বৈচিত্র্য লাভ করা যায় এই খেলার সময়টিতে।

আমাদের সংগে খেলায় যোগ দিলেন দুজন ইহুদী। খেলার মধ্য দিয়েই তাদের পরিচয় পেলাম নিবিড়ভাবে এবং বুঝলাম আমাদের প্রতি এদের একটা প্রীতির বন্ধন হয়ে গেছে এরই মাঝে। খেলা শেষ হতেই ইহুদী দুজন আমাদের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে গল্প আরম্ভ করে দিলেন এবং বললেন, “আমাদের ইচ্ছা ছিল আপনাদের সংগে আলাপ করি কিন্তু পাছে কথা বলার জন্যে জাত যায়, সে ভয়ে কথা বলতে এতদিন সাহস করিনি।” আমাদের দেশে কথা বললে জাত যায় না, ছায়া মাড়ালে স্নান করতে হয়। ইহুদীরা বললেন, “পৃথিবীর যদি উন্নতি করতে হয়, তবে কথায় নয়, শক্তির সাহায্যে আইন প্রনয়ণ করে। যে পাপ করে, তাকে শাস্তি না দিয়ে পাপের উৎপত্তির কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই পাপের কারণকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। দেখছেন তো আমরা আপনাদের স্বেচ্ছায় হিংসা করছি না, আমাদের সমাজ বাধ্য করেছে আপনাদের হিংসা করতে। আমরা সমাজের কুনিয়ম মেনে নিচ্ছি। আমাদের এরূপ ক্ষমতা নাই যে এই সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হই, কারণ আমরা ইহুদী। মানুষের সমাজে আমাদের স্থান অতি হালকা, তারপর যদি অত্যাচারীদের সংগে যোগ দেই তবে আমরাও যে অত্যাচারিত হব।” এরূপ খাঁটী কথা খুবই কম শুনতে পাওয়া যায়। আমরা ইহুদীদের কাছ থেকে বিদায় নিযে কেবিনে চলে এলাম।

আমাদের ষ্টুয়ার্ট-ওয়েটারদের তখন অবসর সময় ছিল। তাই তারা সবাই মিলে এই সময়টাতে নানা রকমের বই পড়ছিল। আমাদের কেবিনের কাছেই চিফ ষ্টুয়ার্ট-এর কেবিন। কার কোন্ বই পড়া উচিত তিনিই সে সব ঠিক করে দেন। সেই বই দেওয়ার ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে দেখলাম একটু। লাইব্রেরীতে ছোট ছোট প্যামফ্লেট ছিল, বড় বড় বইও অনেক ছিল। তার দু-একটির নামও চোখে পড়ল। বইগুলি দেখে মনে হল এই জাহাজ বৃটিশের নয়, রুশ সোভিয়েটের। যত বই সবই সোভিয়েট সংক্রান্ত। অবশ্য এসব বই পাঠ করা আমার মত ইংরেজী জানা লোকের শোভা পায় না। সুন্দর সরল ভাষা। কিন্তু মাঝেমাঝে যে-দুএকটা শব্দ রয়েছে তার অর্থ যদি না বোঝা যায়, তবে সমগ্র বইটা পাঠ করেও কোন গ্যান হয় না। আমি কখনও কাউকে বলি না যে আমার ইংরেজী ভাষায় দখল আছে। তাই যে বইখানা চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম তা ফিরিয়ে দেবার বেলা বললাম, “মশায় কিছুই বুঝলাম না।” রুম-ষ্টুয়ার্ট বললেন, “বেশ এতে এমন কি আছে যে বুঝতে পারেন নি?” “ঐ যে দেখছেন একটা শব্দ এর অর্থের সংগে সমুদয় বইটর সম্বন্ধ।” রুম-ষ্টুয়ার্ট হেসে বললেন, “যদি সময় পাই, তবে মেডিরাতে গিয়ে আপনাকে কথাটার অর্থ বুঝিয়ে দিব।” কিন্তু সে কথাটির অর্থ তিনি আর বলেননি।

আমাদের জাহাজ ক্রমশই মেডিরার কাছে এসে পড়ছিল। এই দ্বীপপুনজ পর্তুগীজ-এর অধীনে। দূর থেকে এর মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দ্বীপপুনজের অবস্থান অনেকটা ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার মাঝে, তবুপ গাছপালা দেখে মনে হয়েছিল এতে পুরা ট্রপিক্যাল আবহাওয়া লাগে নি। জাহাজ ধীরে ধীরে জেটিতে লাগল। অগণিত লোক জাহাজের যাত্রীদের দর্শনের জন্য তীরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। জাহাজ থেকে নেমে একাই পথে বেড়িয়ে পড়লাম মেডিরা শহরটিকে ঘুরে দেখবার জন্য। আমার ভারতীয় বন্ধুটি আর এলেন না কারণ তাঁকে এই অবসরে জাহাজের লণ্ড্ররী দেখতে হবে।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.