আজকের আমেরিকা (৭) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

33986_290774347684527_1888007642_n

লণ্ডন

লণ্ডন নগরের নাম কে না জানে? সকলেই লণ্ডন দেখতে চায়, কিন্তু পেরে উঠে না। তাই অনেকেই ভ্রমণ কাহিনী পড়ে মনের পিপাসা মেটায়। যারা লণ্ডনে যায়, তারা সব সময় নগরের সত্য বর্ণনা দিতে পারে না। সেখানে ভালও আছে মন্দও আছে। মন্দের দিকটা সাধারণত চাপা থাকে কারণ অধীন জাতির পক্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীর কুৎসা করা অকর্তব্য। যেখানে কথা বলবার ক্ষমতা রয়েছে, লেখবার ক্ষমতা রয়েছে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বর্তমান, সেখানে গিয়ে ভারতবাসী সামান্য দুঃখকষ্টের কথা ভুলে যায়।

দেখবার এবং জানবার প্রবল বাসনা আমার মনকে নাচিয়ে তুলেছিল। লাফালাফি করতে হলে পেট ভরে খেতে হয়, শুতে হয় উত্তম শয্যায়, তবেই চিন্তাধারা ঠিক পথে চলে। এবার আমার খাবারের চিন্তা মোটেই ছিল না, কারণ ল-নের রেঁস্তোরাতে প্রবেশ করতে আমাকে কেউ মানা করছিল না। কিন্তু কোথায় থাকব এই হয়েছিল ভাবনা।

ওয়াটারলু ষ্টেশন পৌঁছেছিলাম বোধ হয় বারটার সময়। তারপর হতেই ঘরের খোঁজে বাহির হই। যার হাতে টাকা আছে তার ঘর খোঁজার দরকার নাই, যে কোনও হোটেলে গেলেই হয়। কিন্তু অনেক দিনের দরিদ্রতার ফলে একটু বেশী রকম বিতব্যয়িতার জ্ঞান অর্জন করেছিলাম এবং সে জ্ঞান সহজে বর্জন করা আমাদের দ্বারা হয়ে উঠছিল না। ঘরের খোঁজে বার হয়েছি সস্তায় থাকব বলে। ইউস্টন্ স্কোয়ার হতে এলগেট পর্যন্ত ঘর খুঁজেছি কিন্তু কোথাও ঘর পাইনি। এই পথটার মাঝে অন্তত দুই শত জায়গায় ঝুলছিল ঘর ভাড়ার বিজ্ঞাপন। কিন্তু ঘরগুলি আমার মত কালো আদমির জন্য নয়, সাদা চামড়ার জন্য। এক স্থানে একজন লোক বেরিয়ে এসে অতি নম্রভাবে বললেন, “এই মাত্র সব ঘরই ভাড়া হয়ে গেছ কি করি বলুন তো?’ আমি বললাম, ‘বিজ্ঞাপনটি উঠিয়ে যদি নিতেন তবে আর আমাকে কষ্ট করতে হত না।” ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ ভদ্রতা করে বিজ্ঞাপনটি উঠিয়ে ঘরে নিয়ে রেখে দিয়ে ফের বাইরে এসে আমাকে বললেন, “এমন করে আপনার ঘর খোঁজা অনর্থক হবে। যে সব পাড়ায় ভারতীয় ছাত্ররা অথবা মজুররা থাকে সেখানে যান সুবিথে হবে–আপনার জন্য কেউ ব্যবসার ক্ষতি করবে না।” ব্যাপারটা বুঝলাম; আমার কালো মুখই ঘর পাবার প্রতিবন্ধক ছিল। বিলাত-ফেরত সুধীজন কি এসব কথা দেশে এসে কখনও কারো কাছে বলেছেন? তারা এসব কথা বলতে পারেন না কারণ এসব কথা বললে যে তাদেরই বাহাদুরী চলে যাবে।

ইস্ট ইণ্ডিয়া ডকে যাবার ইচ্ছা ছিল না কারণ এখন আমি ধনী আর যেসকল ভারতবাসী সেখানে থাকে তারা দরিদ্র। কিন্তু এ অভিমান আমার বেশীক্ষণ রইল না। চললাম ডকের দিকে সর্বহারাদের কাছে। তাদের কিছু নাই, তাই অভিমান তাদের কাছে ঘেঁষে না। ভরসা এই তারা আামকে প্রত্যাখ্যান করবে না। ৯০ হাই ষ্ট্রীটে একটি হিন্দুস্থানী এসোসিয়েসন আছে। ভাবলাম, সেখানে গিয়ে মুসলমানদের সংগেই রাত্রিটা কাটিয়ে আসি। গিয়ে দেখি দরজায় খড়ি দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘চাবি উপরে আছে’। আমি উপরে উঠে চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলে তিনটা বেনচ একত্র করে হাতটা বালিশ করে মহানন্দে শুয়ে পড়লাম। পরিশ্রম করলে আপনা হতে ঘুম আসে। ঘুম এসে আমার সকল ব্যথার অবসান করেছিল।

অনেক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। বোধ হয় রাত্রি তখন এগারটা হবে, একটি মহিলা এসে আমাকে জাাগলেন। মহিলার সম্মান রক্ষা করা পুরুষের কর্তব্য। তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে মহিলাকে সম্মানজানালাম। মহিলা আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। এভাবে পরিচয় জিজ্ঞাসা করার নিয়ম যদিও তাদের মাঝে নাই তবুও আমার পরিচয় চেয়েছিলেন এবং আমার পরিচয় পেয়ে মহিলাটি আমাকে বসতে বলেই কাছের বাড়িতে গিয়ে একটি যুবককে ডেকে এনে আমার সংগে তার পরিচয় করিযে দিয়েছিলেন। যুবক অল্প সময়ের মধ্যেই আমার সংগে আলাপ করে নিয়ে বললেন, “এই তো মোটে সন্ধ্যা হল, চলুন একটু বেড়িয়ে আসি, আজ রাত্রে আর বাসা ভাড়া হবে না।” উভয়ে কাছের ছোট রেঁস্তরাঁ থেকে চা খেয়ে টিউব ষ্টেশন নেমে পড়লাম এবং ট্রেনে হাইড পার্কের কাছে এসে উঠলাম।

হাইড পার্কে অনেক দিন বেড়িয়েছি। হাইড পার্কের যদি তুলনা দিতে হয়, তবে একমাত্র হাইড পার্কই তার তুলনা। লণ্ডনের হাইড পার্ক স্বাধীনতার কেন্দ্রস্থল। ছোট স্টেণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে যা ইচ্ছা বলে যায়, কেউ কিছু বলবে না। সেখানে যীশু, মোহম্মদ, বুদ্ধ, শঙ্করের যেমন শ্রাদ্ধ হয়, তেমনি হয় চেম্বারলেন, দালাদিয়ের, মুসোলিনী, হিটলার ও স্টালিন প্রভৃতির। শুনতে ভাল লাগে শোন, নতুবা পথ দেখ, কারণ এটা হাইড পার্ক, মাক-স্বাধীনতার পীঠস্থান। ভারতের সংবাদপত্র ধর্ম নিয়ে কথা বলতেও ভয় পায়। ভয় এই যে, হয়তো গ্রাহক কমে যাবে নয়তো ছোরার আঘাতে সম্পাদকের প্রাণহানি হবে। কিন্তু হাইড পার্কে সে ভয় নাই। যারা স্বাধীনচেতা তারা ছোরা মারে না, তারা নীরবে সবই সহ্য করে যায়।

হাইড পার্কের বিজলি বাতিগুলি যেন সভ্যজগতের কলংকের অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে অন্তত একটুখানি জায়গাকে স্বর্গীয় ছটায় আলোকিত করে রেখেছে, যেখানে মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। হাইড বার্কের স্নিগ্ধ মৃদু মন্দ বাতাস নরনারীর মনকে উদার ও নির্ভীক করে। হাইড পার্ক আনন্দময়। যুবক যুবতী জোড়া বেঁধে একে অন্যের কাছে আপন আপন সুখ-দুঃখের কথা প্রকাশ করে। একে অন্যের সুবিধার দিকে দৃষ্টি রেখে এবং যতদূর সম্ভব নিজের কাজের জন্য অপরের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখে। যেখানে সহিষ্ণুতা বিদ্যমান সেখানেই স্বাধীনতার অংকুর গজায়, সেখানে সুখ এবং শান্তি আপনা হতে এসে দেখা দেয়।

সেই শান্তিময় স্থানে গিয়ে আমি এবং আমার বেকার সাথী একটি গাছের তলে বিম্রামার্থ শুয়ে পরলাম। চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করল। আমার কাছে অর্থ আছে তবুও ঘর পাচ্ছিলাম না, সাথীর শরীরে প্রচুর শক্তি, মুখে যৌবনশ্রী ছিল তবুও তার চাকরি জুটছিল না। এটা কি চিন্তার বিষয় নয়? আমি হাইড পার্ককে কেন স্বর্গ বলতে চেয়েছি তাও জানা উচিত। সেই কারণটি হল হাইড পার্কে বসে বা দাঁড়িয়ে, কলে কৌশলে নয়, সরল এবং স্পষ্ট ভাষায় আপন মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। এটা কি কম কথা?

ভারতের বেকারে এবং ইউরোপের বেকারে আকাশ পাতাল প্রভেদ। ভারতের বেকার আপনার কপাল ঠুকে আর বলে, “ভাগ্য মন্দ, তাই খেতে পাচ্ছি না, কাজ পাচ্ছি না।” সেই ভাবকে পোষণ করার জন্য হলিউড থেকে নূতন ধরনের ছায়াচিত্র ভারতে চালান দেওয়া হয়। হলিউডে ঐ ছবি বিনামূল্যেও কেউ দেখে না। দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ও প্রসিদ্ধ নট তাতে সাহায্য করে না। ব্রিটেনেও এসব ছায়াচিত্রের স্থান নাই। সময়ের পরিবর্তনের সংগে মজুরদের মনোবৃত্তির পরিবর্তন হচ্ছে। ব্রিটেনের মজুর এখন ভাবে, কাজ করার অধিকার তার আছে, কাজ পাবে না কেন? কে তার অন্তরায়? গাথী নেটিভ আমাকে এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলল। আমি মন দিয়ে তা শুনলাম। তারপর মন্তব্য করতে বাধ্য হলাম। আমি তাকে বললাম, “মজুর-জগতে যেরূপ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, আমার মনেও ঠিক সেইরূপ পরিবর্তনের অংকুর অনেক দিন পূর্বে গজিয়ে ছিল; এখন পত্রপুষ্পে শোভিত হয়েছে। পূর্বে আমি ভাবতাম, জীব আপন কর্মফলে কষ্ট পায়, এখন দেখেছি, তা সত্য নয়। এখন দেখছি, কতকগুলি বিশেষ লোকের কথায় নরসমাজ অন্ধ হয়ে তাদের উপদেশ মত চলে। আত্মবিস্মৃত হয়ে যারা অপরের চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে, তারা নিজেদের সর্বনাশ ত করেই, উপরন্তু তারা নিজের সমাজকেও অপরের পদানত করে।” গভীর রাত্রে আমরা হাইড পার্ক পরিত্যাগ করে ইস্টল-নের এলগেটের কাছে একটি সেলভেশন আর্মির বাড়িতে শোবার ব্যবস্থা করলাম।

সকালে উঠোই নেটিভ সাথীটি আমাকে সেলভেসন আর্মির বাড়ি দেখাতে লাগল। বাড়িটা তিনতলা। সকলের নীচের তলায় রেঁস্তরা, বসবার স্থান এবং সর্বহারাদের সামান্য কাপড় চোপড় রাখবার জন্য ‘সেল’ রয়েছে। অনেক সর্বহারা চা খেতে বসেছে। তাদের শরীরের দুর্গন্ধ উল্লেখযোগ্য। সেই সর্বহারাদের এমন পয়সা নাই যে দু’পেনি খরচ করে সপ্তাহে একবার স্নান করতে পারে। মোজাতে ঘাম লেকে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় তার কথা বলতে আমি অক্ষম। এই সর্বহারাদের মোজা পরিবর্তনের ক্ষমতা নাই। অন্য একটি থাকলে তবে তো বদলাবে? দ্বিতীয় মোজা জোড়া কিনার ছ’পেনি পাবে কোথায়? তাদের সংগে বসেই এক পেয়ালা চা খেলাম। চায়ে চিনি অতি অল্পই ছিল। চিনি কেন এত কম দেওয়া হয় জিজ্ঞাসা করলাম। ওয়েটার বলল, “এই ভদ্রলোকেরা গরম জলের বেশী পক্ষপাতী, তাই গরম জল বেশী করে দেওয়া হয়।” মাখনের পরিবর্তে মারগ্যারিন ব্যবহার হয়। মারগ্যারিন চর্বি হতে প্রস্তুত। খেলেই পিত্ত হয়। কিèতু এই সর্বহারাদের পিত্তের ভয় করতে হয় না, পেটের ক্ষুধায় পিত্ত পর্যন্ত হজম হয়ে যায়। বাড়িটার দুতলা এবং তিনতলা বেড়িয়ে দেখে এলাম। সারি সারি বিছানা সাজান রয়েছে। প্রত্যেক বিছানার নীচে একটি করে পাত্র রয়েছে। সর্বহারাদের ঘুমাবার পোষাক নাই, তাই তারা খালি গায়ে রেস্ট রুমে যেতে পারে না, রাত্রে ঐ পাত্রে মুত্রত্যাগ করে।

ঘরের খোঁজে অনেক সময় কাটালাম। অনেক দরজার সামনে ‘টু লেট’ লেখা রয়েছে। নেটিভ সাথী যখন জিজ্ঞাসা করে ঘর খালি আছে কিনা, তখন ঘরের মালিক বলে, “নিশ্চয়ই খালি আছে।” ঘরের ভাড়া ঠিক হয়, অনেক রকম সুবিধার লোভ দেখান হয় কিন্তু যেই নেটিভ সাথী বলে, ঘর ভাড়া করা হচ্ছে আমার জন্য, তখনই সকল চুক্তির অবসান হয়। এইভাবে অর্ধেক দিন কাটিয়েও যখন ঘর পাওয়া গেল না, তখন আমরা চললাম যথাস্থানে–যেখানে কালো লোকেরা থাকে। মরনিংটন ক্রিসেণ্ট নামক স্থানে যাবার পর ঘরের সুব্যবস্থা হল, রান্নার বন্দোবস্ত হল, জিনিসপত্র আনা হল। দস্তুর মত ছোট একটা সংসার পেতে এবার ল-ন দেখার জন্য প্রস্তুত হলাম।

রিজেণ্ট পার্ক হতে আরম্ভ করে ছোট বড় অনেক পার্ক দেখলাম। প্রায় সকল পার্কেই বোমা পড়া এবং গ্যাস হতে রক্ষা পাবার জন্য ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে মাটির নীচে ঘর প্রস্তুত হয়েছে। নেটিভ সাথী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেণ, আগামী যুদ্ধে এইসব ঘর গ্যাসের হাত থেকে তাদের সত্যিই রক্ষা করতে পারবে কি? আমি তার মুখখানা ভাল করে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কখনও চেকোশ্লোবাকিয়া গিয়েছেন।” “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম” বলে নেটিভ সাথী জবাব দিল। আমি বললাম, “আর আমাকে জবাব দিতে হবে না, নিজেরটা নিজেই বুঝুন।” এ বিষযে আমরা আর আলোচনা না করে অন্যান্য বিষয় নিযে কথা বলতে লাগলাম। উপসংহারে গ্যাস সম্বন্ধে আমি যা বলেছিলাম তাতে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, সভ্যতার বাইরে যারা আছে, তারাই বাঁচবে আগামী যুদ্ধে, আর সকলেরই একরকম দম বন্ধ হবে যদি গ্যাসের ব্যবহার হয়।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.