নিউইয়র্ক রওনা হবার পূর্বে লণ্ডনে প্রায় আট সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম প্রত্যেক দিন নানারূপ চমকপ্রদ বিষয়ের আলোচনাতেই কাটত। যেখানে কথা বলবার অধিকার আছে অর্থাৎ স্বাধীনভাবে কথা বললে পুলিশ এসে দরজায় ধাক্কা দেয় না, সেখানে আলোচনায় সুখ পাওয়া যায় প্রায়ই নানারূপ লেকচার শুনতাম, আলোচনাতে যোগ দিতাম, এতে মনে বেশ আনন্দ হত। এখানকার লোক মুখ লুকিয়ে মোটোই কোন কথা বলে না। মাঝে মাঝে ভাবতাম আইরিশরা এত গ-গোল করছে, সেজন্য তাদের পক্ষেই সভা হচ্ছে, বিপক্ষের ত কোন কথাই কেউ শুনছে না? যা হোক আমার রুমের কাছে একজন আইরিশ থাকত এবং সে এসে নানা কথা বলে বিরক্ত করত। সেজন্য স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ১৬ নম্বর মরনিংটন ক্রিসেণ্ট হতে ১৮ নম্বর বাড়িতে এই কারণেই সরতে বাধ্য হলাম। এ বাড়িটার সামনেই এক বিরাট কারখানা। সেই কারখানাতে “ক্রাভান এ” নামক সিগাটের তৈরী হয় আইরিশরা এই কারখানাকে আতংকগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। যে বাড়িতে এসেছি তার মালিক হলেন একজন স্ত্রীলোক। তাঁর জন্মস্থান বার্মিংহামে, মিঃ চেম্বারলেনের বাড়ির কাছে। এই মহিলার স্বামী একজন চীনা ভদ্রলোক, তাই তাঁর গৃহে আমার স্থান হয়েছিল।
পুলিশ কারখানা বাড়িটা বেশ পাহারায় রাখার বন্দোবস্ত করেছিল কিন্তু সেই পুলিশ-পাহারার দিকে লক্ষ্য করত না। লোকে কোনরূপ ভয়ও করত না। লোক চলছে নির্বিকার চিত্তে। আইরিশদের কথা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করত না। সে ভুল ইচ্ছাকৃত নয়, কারণ সে বিষয়টা তেমন গ্রাহ্যের মধ্যেই নয়। বোমা ফাটছে, লোক মরছে, ঘর ধ্বসে পড়ছে তবুও বিষয়টা গ্রাহ্যের নয়। এই অগ্রাহ্যের ভাব কাদের দ্বারা সম্ভব? লক্ষ লক্ষ আইরিস লণ্ডনে বাস করছে, তাদের মাঝে এমন কেউ সংবাদপত্র মারফতে দুঃখও প্রকাশ করছে না। তার কারণ কি? কারণ আর কিছুই নয়, শুধু বিষয়টা অগ্রাহ্য। যারা বিপদে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে, তাদের কাছে বিষয়টার গুরুত্ব আছে। ১২ নম্বর গাওয়ার স্ট্রীটে এবং ভারতীয় সংবাদপত্রে তার প্রচার আছে, কিন্তু ল-নের কোনও ক্লাব তার কথা মোটেই ভাবছে না, সংবাদপত্রগুলিও তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। যারা বীর তার সামান্য বিষয় নিয়ে হৈচৈ করে না, তারা তৎপর হস্তে বিক্ষোভ দমন করে।
এ অঞ্চলে অনেক সাইপ্রাসবাসী থাকে। তাদের নাক মুখ এবং শরীরের গঠন দেখবার মতই। একজন সাইপ্রাসবাসীর সংগে ভাব করে তাকে নিজের ঘরে এনে নানারূপ কথা বলেছিলাম। লোকটি রুটি বিক্রি করত। তার চেহারা দেখলে মনে হয় না সে ফরসা। তার ব্যবসা বেশ ভাল, কিন্তু যদি তার চেয়ে ভাল রংএর কোনো কাশ্মীরী ঐ ব্যবসা করতে আরম্ভ করে, তবে তার ব্যবসা চলে না। অনেক কাশ্মীরী যতক্ষণ নিজেকে ই-িয়ান বলে পরিচয় না দেয়, ততক্ষণ তাদের সকল ব্যবসাই চলে। সেই তার পরিচয় বের হয় অমনি তার কারবার বন্ধ হয়ে যায়।
আমার ইচ্ছা হয়েছিল, একদিন মিঃ চেম্বারলেনের বাড়িটা গিযে দেখি আসি। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটের কথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যেখানে সেখানে শোনা যায়। কলোনিয়্যাল অফিস, ইণ্ডয়া অফিস, এ সবই কাছে কাছে অবস্থিত। তাই সামান্য সময় সেদিকে কাটলে মন্দ হবে না ভেবে ভাইনিং স্ট্রীটে গেলাম। তখন বেলা দশটা। লণ্ডনে কোনদিন আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠিনি। আমার নিয়ম ছিল প্রাতে তিনটায় শোয়া এবং বারটায় শয্যা ত্যাগ করা। কিন্তু সেদিন কি জানি কেন ঘুম ভেংগে গেল, তাই এতসকালে সেখানে যেতে পেরেছিলাম। ভেবেছিলাম ১০ নং বাড়ির সামনে অনেক সেপাই থাকবে, ইনফরমার, গুপ্ত পুলিস এ সব তো নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু গিয়ে দেখি সেই গলিটায় একটা লোকও নাই। সেকেলে ধূসর বর্ণের উঁচু বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে। দেখার মত কিছুই নাই, তাই চলে আসলাম।
বিকালে দশটায় ঘুম থেকে উঠে নেটিভ সাথীটিকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম। সর্বপ্রথমই গেলাম একটি চায়ের দোকানে। চা খাওয়া হয়ে গেলে আমরা চললাম টেমস নদীরে তীরে। রাত তখন গভীর। পথে লোকজনের চলাচল কম। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরকার একটু বেশী জোরে ছুটে চলেছে। সামনেই টেমস নদী যেন কলকাতার গংগা। নদীর চলে আলো পড়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। নদীর জল নীরবে সাগরের দিকে চলেছে। দেখলাম, আমাদের মত আরও অনেকে নদীরে সৌন্দর্য দেখতে এসেছে। তাদের অনেকেরই শরীর শীর্ণ ও জীর্ণ বস্ত্রে আবৃত। শুধু পুরুষ নয় স্ত্রীলোকও আছেন। সবাই নীরবে চলেছে।
পুরুষরা সব সময়েই মেয়েদের সম্মান দেখায় এটা ইউরোপীয় সমাজের একটা সুন্দর রীতি। আমি তার অনুকরণ করতে ভুলিনি। যখনই অসাবধানে কোনও স্ত্রীলোক আমার উপর এসে পড়ছিলেন তখনই আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম কিন্তু ফল তাতে সুবিধাজনক হয় নি। রমণীরা ভেবেছিলেন আমার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমি পরাধীন ভারতবাসী কিনা, তাই দু-একবার আমার নেটিভ সাথীটিকে পথচারী মহিলাগণ সাবধান করে বলেছিলেন “এমন লোকের সংগে চল কেন?” তা ওদের দোষ নয়; আমাদের দেশের নাবিক, ছাত্র এবং ভদ্রলোক অনেক সময় লণ্ডনে গিয়ে ভুলে যান যে তারা লণ্ডনে কি কলকাতায়। অশিষ্টতায় তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেন। টটেনহামকোর্ট রোডে যদি কোনও ই-িয়ান নাবিক এসে বিকালে দাঁড়ায়, তবে পুলিশ অমনি গলাধাক্কা দেয়, কখনও বা ধরেও নিয়ে যায়। সেরূপ নালিশ আমার কাছে অনেকবার অনেকে করেছিলেন। এর প্রতিবাদ করবার জন্য টটেনহামকোর্ট রোডেডে একদিন গিয়ে দাঁড়াতে সাহস করেছিলাম, কারণ ভাল করেই জানতাম এখানকার পুলিশ অমানুষ নয় মানুষ, আমাদের দেশের পুলিশের মতন তারা নয়। টটেনহামকোর্ট রোডে পুলিশ আমাকে পথে দাঁড়াবার জন্য ঘরেছিল। যখন আমি এ বিষয়ে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলাম তখন পুলিশ আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। পুলিশ বুঝতে পেরেছিল আমি অসৎ লোক নই।
ইউরোপীয়দের মাঝে চোর লম্পট ডাকাত সবই আছে কিন্তু তাদের মাঝে নারীদর্ষণ কমই হয়। “ওয়ার্ল্ড নিউজ” নামক পত্রিকা ব্রিটিশ জাতির যত দোষ ও নিন্দার বিষয় সর্বদাই প্রকাশ করে। পড়লে দেখা যায় নারীধর্ষণের বিবরণ তাতে অতি অল্পই আছে। আমাদের দেশে নারীদর্ষণ তো সমাজের অংগের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশি রাত্রি পর্যন্ত আর বাইরে থাকলাম না, কারণ আমার নেটিভ সাথীটি কাল পল্টনে ভরতি হবে। পেটে কিছু দিতে হলে, মাথা গোঁজবার স্থান পেতে হলে, এ ছাড়া আর উপায় তার ছিল না।
এই জগতে প্রগতিশীল জাতি একটা মাদকতার মাঝেই থাকতে ভালবাসে। জার্মান, ইতালিয়ান, রুশ, জাপানী এই সব জাতির মধ্যে সেই মাদকতা আছে, তাই তারা কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করে না কিন্তু ব্রিটিশ জাতির সে মাদকতা নাই। সেই একঘেঁয়ে রক্ষণশীল দলের একই ধরনের কথা ‘ঐ যায় ঐ ধরি’; আমার ধারণা, বিদ্রোহের ভাব না থাকলে জাতীয়তার অভিব্যক্তি ব্যাহত হয়। যাদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব আছে পার্লামেণ্টে তাদের দল হালকা। বিদ্রোহের ভাব না থাকলে জাতীয় মানসিকতায় উন্মাদনা আসে না। বিদ্রোহের ভাব জাতীয়তায় ঔদাষও আনে। সেই কারণে মানুষ দেশের জন্য, জাতির জন্য প্রাণ তো দূরের কথা, তার চেয়েও মূল্যবান জিনিষ যদি কিছু তাকে, তাও দান করবার প্রেরণা পেয়ে থাকে।
রুশিয়ার সংগে প্যাক্ট কর, অতি সত্বর তা কাজে পরিণত হউক, এ কথা সকলের মুখে, সকল সংবাদপত্রে প্রত্যেক দিন লেখা হচ্ছে। মিঃ লয়েড জর্জ থেকে আরম্ভ করে পথের পথিক পর্যন্ত এই মতের পোষক। হাইড পার্কে লাল ঝাণ্ডার নীচের দাঁড়িযে কতবক্তা রুশিয়ার সঙ্গে প্যাক্টের উপকারিতার কথা প্রচার করেছেন তার আর ইয়ত্তা নাই। হাইড পার্কের বক্তৃতা শোনাটা আমার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক গণ্যমাণ্য ভারতবাসী বলে থাকেন হাইড পার্কে নাকি কোনও ইউরোপীয় ভদ্রলোক উপস্থিত থাকেন না। এ সব লোকের কথা মোটেই সত্য নয়। তথাকথিত ভারতীয় ভদ্রলোকেরা তথায যান না। অন্তত আমি একজন ইণ্ডিয়ানকেও তথায় যেতে দেখিনি। সেদিন এক পার্লামেণ্ট সদস্য বক্তৃতা দিবেন, সেজন্য হাইড পার্কে অনেক লোক একত্রিত হয়েছিল। আমি ভাবছিলাম এই বুঝি ইংলিশ ভদ্রলোকের প্রথম আগমন। তাঁরই বক্তৃতা শুনতে আগ্রহ করে দাঁড়ালাম গিয়ে। তিনি রুশিয়ার সংগে প্যাকট করার যুক্তি দেখালেন। তিনি বলেছিলেন, যদি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হয় তবে রুশিয়ার সংগে মিতালি অবশ্য কর্তব্য। প্রশ্ন করার সময় আমি বলেছিলাম “এ যে আদায় কাঁচকলায় মিলন, এও কি সম্ভব?” তিনি বলেছিলেন–“Pact is adjustable because it is nothing but a pact.” সংগে সংগে এ কথাও বলেছিলেণ, “আদা আর কাঁচকলার মিলকেই বলে প্যাক্ট।”
