আজকের আমেরিকা (৯) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

নেটিভ সাথীটি যাবার বেলায় আমার অন্য এক সাথী জুটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ইনিও বেকার। এর পল্টনে ভরতি হবার উপায় ছিল না। জাতিতে ইনি গ্রীক। এখনও তিনি বৃটিশ নাগরীক হতে সক্ষম হননি তাই আমার সংগে বন্ধুত্ব করতে একরকম বাধ্যই হয়েছিলেন। এর মতবাদটাও অন্য রকমের। এঁর পিতা বাধ্য হয়ে এথেন্স পরিত্যাগ করেছিলেন। এঁদের মত হল, গৃসে রিপাবলিক গভর্ণমেণ্ট হওয়া চাই। যেদিন রাজা জর্জ এথেন্স পৌঁছেছিলেন, সেই দিনই মিঃ হরেসিও, এঁর পিতা, সপরিবারে ইউরোপের নানা দেশ বেড়িয়ে শেষটায় লণ্ডনে এসে পৌঁছেন। ডিমক্র্যাসি আর হিপক্র্যাসি শব্দ দুটো আজকাল লোকের মুখে মুখে শোনা যায়, যেন একটা ফ্যাশন। আমি কিন্তু এত দুটা কথা ব্যবহার করতাম না কারণ যার দেশ স্বাধীন নয় তার কাছে ডিমক্র্যাসি আর হিপক্র্যাসি একই কথা। আমার নবাগত বন্ধু হিপক্র্যাসি শব্দটাই ব্যবহার করতেন বেশী।

নূতন বন্ধু আসার সংগেই নূতন আতংকের সৃষ্টি হল। তিনি বরাবর বলতে লাগলেন, “আপনি আমেরিকা যাবার টিকিট কিনে রাখুন। যদি যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় তবে মহা বিপদে পড়বেন।” নূতন সাথীটিকে বলেছিলাম, “এ দেশ ছাড়বার আগে একদিন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড দেখতে হবে।” কথাটা তিনি বুঝতে পারেননি, কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড সাধারণের কাছে শুধু ‘ইয়ার্ড’ নামে পরিচিত। অনেক কথার পর যখন বুঝলেন তখন বললেন, “এতে আর কি, গেলেই হল।” এ যেন আমাদের দেশের যাত্রাগানের আসর, কষ্ট করে গেলেই যেখানে হ’ক ঠেসাঠেসি করে বসতে পাওয়া যাবেই। আমি ভাবছিলাম, আবেদন-নিবেদন করব, তারপর পাস আসবে, কত কি হবে, তারপর বলির পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে হয়তো মনের বাসনা পুরাতে হবে। নূতন সাথীটি একদিন ঘুম থেকে উঠেই বললেন, চলুন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড দেখতে যাই।

বাসে যাওয়া ঠিক হল। অটোগ্রাফের বইটা সংগে করে নিলাম, উদ্দেশ্য যদি বড় কর্তার দেখা পাই তবে তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে আসব। আমাকে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই আমার নূতন বন্ধু বললেন, “এখানে আপনি একা যান, তাতে ভাল হবে, নেটিভ সংগে থাকলে ওদের সন্দেহ হবে।” হন্হন্ করে একটা অফিসে গিয়ে টোকা দিলাম। প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ঢুকে অভিপ্রায় জানাতেই শুনলাম, “আরে না মশায়, এটা নয়, পাশের দরজায় গিযে টোকা দিবেন।” একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিদেশী। আসার উদ্দেশ্য?”

“আসার উদ্দেশ্য, দেখা, এর বেশী নয়।”

“এটা যে মিউজিয়ম নয় চিড়িয়াখানাও নয়, তা কি মহাশয় জানেন?”

আজ্ঞে হাঁ, তা বেশ জানা আছে। ইংলিশ উপন্যাস পড়লেই স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড-এর কথা পড়তে হয়। আমার ইচ্ছা হয়েছে, একবার স্থানটাকে দেখে আসি, তাতে উপন্যাসের পাতা উলটাতে সুবিধা হবে।”

ভদ্রলোক আমার কথা শুনে সংগে একজন লোক দিলেন, সেই লোকটি আমাকে অন্য এক রুমে রেখে চলে গেল। একে একে অনেক অফিসার এলেন। যদিও কেউ কিছু বললেন না তবুও তাদের চাহুনি দেখে বুঝলাম সবাই যেন আমাকে প্রশ্ন করতে উৎসুক। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবান না দিতে পেরে একে একে সকলেই চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে একজন লম্বা এবং গম্ভীর লোক এসে আমার কাছে বেশ আরম করে বসে বললেন, “আপনার এখানে আসার উদ্দেশ্য কি?”

আজ্ঞে সেরূপ কিছু নয়, তবে বাড়িঘরগুলি দেখলে আনন্দিত হব, হয়তো বই লেখার পক্ষে সুবিধা হবে।”

“তবে আপনি লেখক, তা কি দেখবেন চলুন।” এই বলেই তিনি চললেন আমি তাঁর পেছনে চললাম। অনেক দেখলাম কোথাও বিভীষিকা নাই। সর্বত্রই সহজ ও সরল ভাব। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে থার্ড ডিগ্রি কোথায় দেওয়া হয় সে স্থানধা একটু দেখতে চাই।” ভদ্রলোক বললেন, “থার্ড ডিগ্রির ব্যবস্থা আমাদের শাসিত দেশগুলিতে রয়েছে যেখানে ভয় দেখিযে অসভ্যকে সভ্য করতে হয়।” ভদ্রলোকটির অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে ভুলিনি। পথে আসার সময় কেবলই মনে হতে লাগল, সত্যই তো, অসভ্যকে সভ্য করতে হলে ভয় দেখানো দরকার। আমরা কলোনিয়েল দেশের লোক তবে কি আমরাও অসভ্য?

এবার আমেরিকার টিকিট কেনার পালা। ভেবেছিলাম, টাকা ফেলব আর টিকিট নিব। কিন্তু আমেরিকা কেন, যে কোনও বিশেষ দেশে যেখানে ইকটু অর্থাগমের পথ খোলা আছে, সেখানকার টিকিট কিনতে ভারতীয়দের বিশেষ কষ্ট পেতে হয়। বাংগালী ও পলাতক জার্মান ইহুদী দ্বারা পরিচালিত এক নূতন টুরিস্ট কোম্পানীতে টিকিট কিনতে গেলাম। তারা ত আমাকে পেয়েই খশী। তারা হয়ত জানত না যে ভারতবাসীর পক্ষে আরেমরিকার টিকিট কিনা তত সহজ নয় নতুবা এমন অনুগ্রহ এবং আগ্রহ দেখাত না। আমি চুপ করে বসে ওদের চালচলন দেখতে লাগলাম। এদিকে জাহাজ কোম্পানীতে টিকিট কেনার জন্য লোক পাঠান হল। জাহাজের নাম জর্জিক, আটাশ হাজার টন, অল্প ‘রলিং’ এ নড়বেও না। কিন্তু টিকিট নিয়ে আসছে না কেন? বেলা তিনটা পর্যন্ত বসে বললাম, “মহাশয়রা টিকিট খানা আসলে রেখে দিবেন, আমি কাল এসে নিয়ে যাব।” এই বলেই চলে আসলাম।

নূতন সাথীটি আমাকে বলতে লাগল, টিকিট বিক্রি না করার কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না, যুদ্ধ তো বাধে নি?” ভারতবাসীকে সাম্রাজ্যবাদীরা কত যে হীন করে রেখেছে, তা সামনে দাঁড়িয়েও ঐ গ্রীক যুবক বুঝতে পারছিল না। ভারতবাসীর দরজা চারিদিক থেকে বন্ধ। যারা লণ্ডনে যায়, তারা একথা হাড়ে হাড়ে বোঝে, কিন্তু সেকথা স্বদেশে এসে বলে না। চড় খেয়ে চড় হজম করে। পরদিন অফিসে গিয়ে দেখলাম তখনও টিকেট আসেনি। অফিসের চাপরাসীকে নিযে জর্জিকের অফিসে গেলাম। ম্যানেজার থেকে আরম্ভ করে ছোট কর্মচারী পর্যন্ত বলতে লাগল, ভিসা পেলেই তো হবে না, ফিরে আসার টাকা জমা দেওয়া চাইভ এটি না হলে যেন টিকিট বিক্রিই হতে পারে না। তাদের শুনে ব্যাংকের জমা একশত পাউ–এর একখানা রসিদ দেখালাম জজিক জাজাহে প্রচুর স্থান ছিল। জাহাজের মানচিত্র দেখে জাহাজের মধ্যস্থলে আমার ক্যাবিন ঠিক করলাম বললাম। অনেক চিন্তা করে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করা হল, কারণ তখনও জাহাজে অনেক জায়গা ছিল। স্বর্ণময় চকচকে মুদ্রাকে দক্ষিণ আফ্রিকার জেনারেল ক্রুগার যেমন পদাঘাত করতে পেরেছিলেন, তেমনি আর কেউ পারেননি। লণ্ডনের জাহাজ কোম্পানীও টাকার গোলাম, তারা স্বর্ণ মুদ্রাকে মাথায় করার বদলে কি পদাঘাত করতে পারে? অনেক কষ্ট করার পর যখন আমার টিকিট কেনা হল, আমি তণ শান্তিতে নূতন সংগীকে নিযে রিজেণ্ট পার্কের দিকে অগ্রসর হলাম। রিজেণ্ট পার্কের ঘাসের উপর বসতে আমি বড়ই ভালবাসতাম তাই রিজেণ্ট পার্কে গিযে তথায বৃক্ষতলে বসে পবিত্র বায়ুতে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে লাগলাম। লণ্ডন নগরের অসংখ্য কলকারখানার চিমনি থেকে কয়লার ধূঁয়া বের হয়, তা নিয়তই শ্বাস-প্রশ্বাসের সংগে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেইজন্যে ল-নের অধিবাসীরা দুটি করে রুমাল রাখে। রিজেণ্ট পার্কের বাতাসে সেই কদর্যতা ছিল না, সেখানে বসতে ভাল লাগার সেও একটা মস্ত কারণ।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.