চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় হিমেল প্রথম আমার সঙ্গে স্কুল পালায়। যদিও আমি প্রথম স্কুল পালিয়েছিলাম তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়। আমরা প্রথম স্কুল পালিয়ে গুলিস্তান স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ আর ওয়েস্টইন্ডিস এ দলের তিন দিনের টেস্ট খেলা দেখতে। প্রথম যেদিন ওর সঙ্গে স্কুল পালাই তখন আমরা এক সঙ্গে বাসা থেকে বের হই। আমি স্কুলের রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিলাম হিমেল জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই স্কুলে যাবি না?’ আমি উত্তর দিয়ে বলেছিলাম, ‘নাহ, তুমি যাও।’
এই কথা শুনে হিমেল প্রায় ১০/১৫ মিনিট ধরে আমাকে ছাত্রজীবনের সুফল আর কুফল পুরা রচনা শুনাইয়া দিল। হিমেল বরারবই ভাল ছাত্র ছিল, একশ ষাট/সত্তুর ছাত্রের মধ্যে প্রথম পনের জনের মধ্যে থাকত সবসময়। সে বাংলা দ্বিতীয়পত্রে ‘ছাত্রজীবন’ নিয়ে যা পড়েছিল সকল বুলি আমাকে গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল। ছাত্রজীবন খুবই ভাল, এভাবে ছাত্রজীবনটা নষ্ট করা উচিত না। এইসব বইপুস্তকের কথা শুনতে শুনতে আমরা নাবিস্কো পৌঁছে গেলাম। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুমি স্কুলে যাও, আমি এখন বাসে উঠবো।’ কি মনে করে হিমেল আমার সঙ্গে বলাকা বাসে উঠে গেল। উঠেই আরেক ঝামেলা শুরু করে দিল যদি কেউ দেখে ফেলে, এখন কি হবে। এই টাইপের কথাবার্তা। আমি পড়ছি মহাঝামেলায়। এরকম ভাল ছাত্র নিয়ে সমস্যা। এঁরা প্রচণ্ড ভীতু টাইপের হয়।
আমরা যথারীতি স্টেডিয়াম পৌঁছালাম। স্কুলড্রেস থাকার কারণে স্টেডিয়ামে ঢুকা ফ্রি। বিকাল পর্যন্ত তিন দিনের ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের খেলা দেখলাম। তৃতীয় দিনের খেলা দেখতে আমরা আর যাই নাই। কারণ খেলা ড্র হবে আমরা নিশ্চিত। তবে খেলা দেখে খুব একটা শান্তি পাই নাই। কারণ হিমেল সারাক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল। একে তো গুলিস্তান গিয়েছি আর তার পাশেই ওর বাবার অফিস। সিভিল এভিয়েশনে চাকরী করতো ওর বাবা। মোটামুটি সাড়ে তিনটা থেকেই শুরু করে দিল এখন আব্বা বের হবে যদি দেখে ফেলে! শেষ পর্যন্ত কোন ঝামেলা ছাড়াই আমরা বাসায় ফিরলাম। আমি হিমেল কেউই ধরা খেলাম না বাসায়।
পরের দিন আবার স্কুল পালাবো। আমার ইচ্ছা এয়ারপোর্ট যাওয়া। কোনদিন বিমান দেখি নাই। বিমান দেখা আর স্কুল পালানো দুইটাই এক সঙ্গে হবে। রথ দেখা আর কেলা বেঁচার মত। যথারীতি নাবিস্কো থেকে বাসে উঠলাম। দুইজনের কাছেই ভাড়া কম আছে। আসা-যাওয়া ভাড়া লাগবে বারো টাকা কিন্তু আমাদের কাছে আছে দশ টাকা। হিমেল খুব ভয়ে আছে, এই টা কিভাবে করবো। আমি নির্বিকার, ব্যবস্থা একটা হবেই আমি নিশ্চিত।
যথারীতি এয়ারপোর্ট গেলাম। কিন্তু আমি পুরাপুরি হতাশ বিশাল বিল্ডিং ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। পথে আসার সময় হিমেল বলেছিল বিমান দেখা যাবে সমস্যা নাই। হিমেল নিজেও দেখেছে, ওর বাবা যেহেতু বিমানে চাকরী করে আমিও নিশ্চিত ছিলাম হিমেল সঠিক বলতেছে। আর হিমেল তেমন মিথ্যাও বলতো না। এখানে এসে হিমেল আবিষ্কার করলো নতুন একটা বিল্ডিং তোলা হইছে তাই বিমান দেখা যাচ্ছেনা।
আমরা এয়ারপোর্টের এক কোণায় চলে গেলাম। তাও বিমান দেখতে পারলাম না। তবে বিমানের লেজ দেখতে পারছি। সেই আনন্দ নিয়াই আমার সন্তুষ্ট থাকতে হইল। তবে হিমেলের তেমন মন খারাপ হইল না। কারণ হিমেল বহুবার বিমান দেখেছে।
ফেরার জন্য আমরা বাসে উঠলাম। কন্টেকদারের সঙ্গে শুরু হইল কেচাল। আমাদের কাছে আছে চার টাকা কিন্তু ভাড়া ছয় টাকা। কন্টেকদার চার টাকা নিল ঠিকই কিন্তু অনেকগুলা কথা শুনানো শুরু করল। পিছন থেকে এক লোক কন্টেকদারকে ঝাড়ি দিয়া আমাদের বাকি দুই টাকা দিয়া দিল।
আমরা দুইজনেই অবাক। আমরা তাঁর কাছ থেকে টাকা নিতে চাই না। কিন্তু উনি আমাদের বুঝিয়ে বললেন। তোমরা তো ছাত্র আর আমি একটা স্কুলের শিক্ষক। তোমাদের এই অপমান আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
আমরা দুইজনেই প্রচণ্ডরকম লজ্জিত। আমরা তো স্কুল পালিয়ে আসছি স্যার যদি এই বিষয়টা জানতে পারেন তাহলে আমাদের কি পরিমাণ ঘৃণা করবেন সেই চিন্তা করে। স্যার অবশ্য আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন এখানে কেন? আমরা উত্তরে বলেছিলাম বিমান দেখতে আসছি। স্যার মুচকি হেসেছিলেন। আর কোন প্রশ্ন করেননি।
হিমেলের সঙ্গে দুইদিন স্কুল পালিয়েছিলাম। প্রতিবারই সে স্কুল পালাতে নিষেধ করতো। স্কুল পালানো খারাপ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করত। তখন খুব অবাক হতাম হিমেল এত নাম্বার কিভাবে পেত। ওর স্কুল এত ভাল লাগে কেন? আমার তো একদম ভাল লাগে না। ভাবতাম হিমেল অনেক বড় হবে হয়তো ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার কিছু একটা হবে। আমার ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ। আমার হয়তো কোথাও জায়গা হবে না…
অনেকদিন পর পুরাতন বন্ধুদের মধ্যে রাজিবের সঙ্গে কথা হইল। রাজিব আমার ওয়েবের মোটামুটি সব লেখাই পড়ে ফেলছে। একদিন রাতে ম্যাসেজ দিয়ে বলল, ‘তুই যে হিমেলকে নিয়ে লিখছিস। তুই জানিস ওর কি অবস্থা?’
জানতে পারলাম হিমেল এখন আর আগের হিমেল নাই। পুরাপুরি বদলে গেছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তো দূরের কথা। কিছুই হইতে পারে নাই। জীবনটা একদম নষ্ট করে ফেলছে নেশা করে। বছরের ছয় মাস নাকি রিহ্যাবে থাকে।
তখনকার দিনে জীবনের অঙ্কের খাতায় যোগবিয়োগ করে মেলানোর চেষ্টা করতাম বন্ধুদের ভবিষ্যত নিয়ে। বেশিরভাগ হিসাবই এখন আর মেলে না। যেই মানুষটার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ বেশি দেখেছিলাম সেই মানুষটাই এখন উল্টা হয়ে গেছে। যে মানুষটা সবচাইতে নিষ্ঠুর ছিল সেই মানুষটার মধ্যে কোত্থেকে মনুষত্ব বোধ অনেক বেশি দেখি। যেই বন্ধুটার শিল্পী হওয়ার কথা ছিল সে এখন পুরাপুরি কর্পোরেট। ছোট্ট একটা কাজ দিলে তিনদিন পরে বলে ভুলে গেছি। আশ্চর্য সব কিছু…
.
১২ বৈশাখ ১৪২৩
