আমার পুরনো বা স্কুল জীবনের বন্ধুদের মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করি। একটা খুব ভদ্র আর সুবোধ টাইপের ছেলেপেলে। পড়াশুনা ছাড়া কিছুই বুঝে না। বলা যায় এই গ্রুপটাই আমাকে নীতিনৈতিকতার দিক দিয়ে আকৃষ্ট করেছে।
আরেকটা গ্রুপ ছিল পুরাপুরি উল্টা। পথেঘাটে আড্ডা দিত, মারামারি করতো এক কথায় উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। ঐ গ্রুপটার কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। বিশেষ করে সাহস অথবা দুঃসাহস যাই বলি না কেন ঐ উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেগুলাই আমার পাথেয়। এঁদের সঙ্গে মিশলে নীতি-নৈতিকতা কখনো বিসর্জন দেই নাই। উচ্ছন্নে যাওয়া বন্ধুদের কথা আমার অনেক লেখাতেই উঠে এসেছে। কিন্তু প্রথম অর্থাৎ ভাল গ্রুপটার কথা ঐভাবে বলাই হয় নাই। হয়তো দুয়েকজনের কথা মাঝে মাঝে আলোচনা করেছিলাম। আর এখানকার বন্ধুরাই সেইসব বন্ধু যাঁদেরকে আমি তুই বলে সম্বোধন করি।
তবে আমার আমি হওয়ার পিছনে এই দুইটা গ্রুপের কাছেই ঋণ সমান।
গত পরশুদিন বাসা থেকে বের হয়ে রাজা-বাজার যাচ্ছিলাম। জাকির হোসেন রোড থেকে বের হয়ে লালমাটিয়ার রাস্তা ধরে আগাচ্ছি। এমন সময় পিছন থেকে আমার নাম ধরে কেউ একজন ডাক দিল। প্রথম দেখাতে চিনতে একদমই ভুল হলো না। আল-আমিন। দেখা হইল অনেকদিন পর। অন্তত ১৫ বছরের কম হবে না।
এতদিনের পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হইলে প্রথমে হাত বাড়ানো হয় না কোনদিন। সবার আগে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। এখানেও ব্যতিক্রম হইল না। এবং দুইজনের মাইন্ডই দেখা গেল একই। দুইজনেই দুইজনকে বুকে জড়িয়ে নিতে চাইলাম। আর সবচাইতে বড় বিষয় হইল আল-আমিন পেছন থেকে কিভাবে বুঝতে পারল এইটাই আমি। আমার জন্য অবশ্যই বিস্ময়ের বিষয়। এতদিন পরেও শুধু পিছন থেকে দেখেই পুরানো বন্ধুদের চেনা যায়। এটা মনে হয় শুধুমাত্র স্কুলের বন্ধুদের ক্ষেত্রেই সম্ভব।
অবশ্য আমার এই বন্ধুগুলার মধ্যে এইসব বিষয় মনে রাখা কোন সমস্যাই না। স্কুল জীবনে এই মানুষগুলা অবলীলায় সবকিছু মনে রাখতে পারতো। ক্লাশের প্রথম ১৫/২০ তম স্থান এরাই দখল করে রাখতো। অন্য কাউকেই জায়গা দিত না। এখনো নিশ্চয়ই সেই গুণ বয়ে বেড়াচ্ছে। দুইজনে মিলে অল্প সময়ে পুরানো দিনের অনেক বিষয় নিয়াই কথাবার্তা বললাম। ঈদের আগেই আমাদের ফাস্ট বয় রুবেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যে কিনা স্কুলে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছিল স্কুল ছাড়ার আগ পর্যন্ত।
আমাদের আড্ডার বিষয়ও ছিল সেই পুরানো বন্ধুদের নিয়েই স্মৃতিচারণ। রুবেল, সাদি, তারেক, রাজিব, খায়রুল, হিমেল, সুজন। আরো অনেক বন্ধুরা যে কোথায় আছে কে জানে! দুয়েকজন পৃথিবীতেও নাই। তবে সবাই যদি একসঙ্গে হতে পারতাম খুব ভাল হইত। বিশেষ যে কারণে আমরা একসঙ্গে হয়েছিলাম। সেই ক্রিকেট টিমের সবাই যদি একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয়া যেত তাহলে দুর্দান্ত হইত।
তবে এই টিমের মধ্যে আল-আমিনই সম্ভবত সবার আগে আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। বিশেষ করে নাইনে উঠার পরে আল-আমিন হঠাৎ করে নাখালপাড়া হোসেন আলী স্কুল ছেড়ে সরকারী বিজ্ঞানে চলে যায়। সেখান থেকে স্কুল আর কলেজ দুইটাই শেষ করে। তখন থেকেই মোটামুটি যোগাযোগ কমতে থাকে। মাঝে মাঝে হয়তো এলাকায় দেখা হতো। আমার মা মারা যাওয়ার পরে যখন নাখালপাড়া ছেড়ে দেই। এর পরে আর কারো সঙ্গেই ঐভাবেই দেখা হতো না। শুধু খায়রুল-সুজনদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হতো। ওদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে অন্যান্যদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করতাম। তখন জানতে পেরেছিলাম আল-আমিন পুরনো স্কুল ছেড়ে নতুন স্কুলের যাওয়ার অভ্যাস বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাড়তে পারে নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ইস্ট-ওয়েস্টে ভর্তি হয়েছিল।
আল-আমিনের আরেকটা মজার বিষয় ছিল। খেলায় সে নতুন নতুন ব্যাটসম্যান-বোলারদের অনুকরণ করতো। দেখা গেল একদিন হঠাৎ আল-আমিন সোয়েব আক্তারের স্টাইলে বল করতেছে। একদিন দেখা গেল ক্লুজনারের স্টাইলে বল করতেছে। এভাবে শের্ন ওয়ার্ন থেকে শুরু করে নানা দেশের বোলারদের স্টাইল অনুকরণ করছে।
ব্যাটিংয়ে আল-আমিন ছিল আমাদের টপ-অর্ডারের ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং স্টাইলটা ছিল অনেকটা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো। আমাদের এই ক্রিকেট দলে বেশিরভাগ সময়ই ওপেন করত রুবেল আর রাজিব। রাজিব আবার প্রথমে বোলিংও করতো। বলা যায় রাজিব ছিল আমাদের নিল জনসন। ওপেনিংয়ে বোলিং আর ব্যাটিং দুইটাই। একমাত্র বামহাতে ব্যাটসম্যান ছিল সানি। রুবেলও দেখতাম মাঝে মাঝে স্কুলে বাম হাতে ব্যাট করতো।
স্কুল জীবনের পরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বোধহয় কেউ আর ক্রিকেটটাকে কন্টিনিউ করে নাই। আমি স্কুল ছেড়ে দিলেও চেষ্টা করেছিলাম বেশ কিছুদিন ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে। এক সময় আমারও ক্রিকেট ছাড়তে হয়েছে। ক্রিকেটের পরে যদি আর কোন বিষয়ে সবচাইতে বেশি সময় দিয়েছি সেটা হইল সাইক্লিং।
তবে এখনও খুব মিস করি সেই ক্রিকেট টিমটাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় সেই দিনগুলা ফিরে আসলে খুব ভাল হইত। গ্লাপ্স হাতে উকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো ভালই হইত।
আহা! সেই সোনালী দিনগুলি, স্কুল শেষে শাহীনবাগে ক্রিকেট খেলা। একসঙ্গে বাড়ি ফেরা। কুকুরের দৌড়ানি খাওয়া। নানা-রকম মান-অভিমান। কে কয়টা ছয় মারছে গুনা। শর্টপিচে কে কয়টা ৫০ করলো সেটার হিশাব-নিকাশ। কত সহজ ছিল হিশাব-নিকাশগুলা। ঈদের সালামীর টাকা দিয়ে SG ব্যাট অর্থাৎ সুনীল গাভাস্কারের ব্যাট কেনা। একসেট ব্যাটিং গ্লাপ্স কেনা। সেই এক সেট গ্লাপ্স আবার দুইজন একটা একটা করে পরা। অসাধারণ সব স্মৃতি…
৯ আষাঢ় ১৪২৬
ছবি: আল-আমিনের ফেসবুক ওয়াল থেকে।
