আমি তখন ইউল্যাবে কাজ করি। ধানমন্ডির ৪/এ তে আমাদের ক্যাম্পাস। দুপুরের পরে বা আগে বাইরে থেকে এসে অফিসে বসছি। অন্যপাশে সলিমুল্লাহ স্যার কথা বলতেছিলেন একজনের সাথে। স্যার হুট করে আমাকে ডেকে বললেন, ‘শরীফ আপনার বইটার একটা কপি দেন তো।’ বইটি নিয়ে সামনে বসা ভদ্রলোকের কাছে বইটি স্যার উপহার হিসেবে দিলেন।
আমার বইটা বের হওয়ার পরে স্যার ৮/১০ কপি বই বিভিন্ন মানুষদের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। তাই আমি খুব একটা গুরুত্ব দেই নাই। কারণ আমার কাছে মনে হইছে, উপহার পাওয়া বই কেউ গুরুত্ব দিয়ে পড়ে না।
কিন্তু তার কিছুদিন পরেই একটা ফোন আসলো, রাতের দিকে। ওপাশ থেকে পরিচয় দিলে ইফতেখার মাহমুদ নাম বলে। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। তারপর কথায় কথায় বললেন আমার বইটার কথা। মাত্রই পড়ে শেষ করেছেন, আমার সাথে একবার দেখা করতে চান আলাদা করে।
আমার বই পড়ে একজন শিক্ষক এভাবে দেখা করতে চেয়েছেন। বিষয়টা আমার জন্য সত্যি সত্যি অন্য রকম অনুভূতির।
তার কয়েকদিন পরেই ইফতেখার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি প্রথমেই বললেন, আমি যেন উনাকে ভাই বলে সম্বোধন করি। তাঁর রুমে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো ছিলাম। পুরা কথার সারমর্ম এই রকম। সলিমুল্লাহ খান স্যারের কাছ থেকে বইটা নিয়া উনি অনেকদিন বইটা ফেলে রাখছিলেন। তারপর একদিন কি মনে করে পড়া শুরু করেন। এবং মোটামুটি এক বসায় বইটা পড়ে শেষ করে ফেলেছেন।
আমি তাঁর কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কেউ সামনে বসে এভাবে প্রশংসা করে। বই পড়া শেষ করে তিনি আমার ব্লগ খুঁজে বের করেছেন সেখানেও অনেক লেখা পড়েছেন। তারপর ফেসবুকের আইডি খুঁজে বের করেছেন। তারপর মিচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে সম্ভবত সোহাগ ভাইয়ের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কথা বলেছেন। এত কিছু করেছেন। এসবই বুঝিয়েছেন তিনি সত্যি সত্যি আমার লেখা পছন্দ করেছেন। পরের কথাটা ছিল আরো একটা ধাক্কার মতো। ইফতেখার ভাইয়ের ধারণা এই বইটা অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। তিনি বইটার অনুবাদ করতে চান। সেটার জন্য অনুমতি নেয়ার জন্যই আমাকে ডাকা। এ ছাড়াও পরে কোন এক অনলাইনের পডকাস্ট বা আড্ডাতেও আমার এই বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন।
সবচাইতে বেশি আমার পছন্দ হয়েছিল তাঁর কথা বলা। আমি যখন প্রথম এলিফ্যান্ট রোডের কাকে কাজ করতে আসি, তখন কচি ভাইয়ের কথা শুনে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল জীবনে আর কিছু না হোক, কচি ভাইয়ের মতো যদি কথা বলতে পারতাম তাহলে হয়তো আর কিছু লাগবে না জীবনে। অনেকদিন পরে এসে ইফতেখার ভাইয়ের কথার প্রেমে পড়েছিলাম। এত ভালোবেসে কেউ কথা বলতে পারে! আমার ধারণার অতীত ছিল। আমিও চাইতাম তাঁর মতো কথা বলার আর আফসোস করতাম। তাঁর সাথে এর পরেও ফোনে অনেকবার কথা হয়েছে। রাস্তায় দেখা হয়েছে ১ বার। মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছি।
তাঁর রুমে ৪০ মিনিটের মধ্যে ২/৩ জন ছাত্র-ছাত্রী আসছিল। ঐ অল্প সময়েই বুঝতে পেরেছিলাম, উনি শিক্ষক হিসাবে অসাধারণ ছিলেন। আমি কখনো তাঁর ক্লাশ করি নাই। কিন্তু ক্লাশ না করেও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি তিনি শিক্ষক হিসাবে খুব ভালো ছিলেন।
আজ অফিসে এসেই দুঃসংবাদটা পেলাম। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি একটা মানুষ হারালাম যিনি মুগ্ধ হয়ে আমার বইটা পড়েছিল। ডেকে নিয়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন, অনুবাদ করতে চেয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে কথা শোনার একটা মানুষ হারালাম।
তারচাইতে বড় বিষয় দেশ একজন শিক্ষক হারালো। এমন শিক্ষক খুব অল্পই পাওয়া যায়।
১৪ কার্ত্তিক ১৪৩২
