ছোট্টবেলায় ঈদের আনন্দ ছিলো অন্যরকম। ঈদের সাতদিন আগে থেকেই শুরু হতো আনন্দ। কে কোন রঙ্গের জামা কিনবে, কে কোন জুতা কিনবে তা নিয়ে চলতো বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা। ঈদের জামা কেনার পর সেই জামা আলমারিতে লুকিয়ে রাখতে হবে। কারণ কেউ দেখলেই সেই জামা পুরানো হয়ে যাবে। আর পুরনো জামা দিয়ে ঈদ করার প্রশ্নই আসে না।

বয়স যখন চার/পাঁচ ছিল তখন জামা পেতাম তিন/চার সেট করে। সকালে আব্বার সঙ্গে ঈদের নামায পড়ে শুরু হতো বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া। সেমাই খাওয়ার চাইতে ঈদের সালামী নেয়াটাই ছিল মূল লক্ষ্য। সালামীর টাকা দিয়ে চটপটি, ফুচকা, কোক খাওয়াটা ছিল সাধারণ বিষয়। সালামীর টাকা বেশি হলে সেই টাকা দিয়ে পানির পিস্তল কেনাটা ছিল ফরজ। কখনও কখনও ঈদের সালামীর টাকা আম্মার কাছে জমা রাখতাম সেই টাকা আর কখনই উদ্ধার করা যেত না।
চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় কোন এক সমস্যার কারণে রোজার ঈদে বাসা থেকে নতুন জামা দিতে পারল না। এত মন খারাপ হয়ে ছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। নামায পড়ে বাসায় ফিরে আর বের হই নাই। সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। বন্ধুরা কয়েকবার খোঁজ নিয়ে গেছে বের হওয়ার জন্য অনেক ডাকাডাকি করেছিল। কিন্তু লজ্জায় বের হতে পারি নাই। ঈদের দিন গায়ে নতুন জামা না থাকাটা ঐ বয়সে অনেক বড় লজ্জার। আর বাবা-মা যে নতুন জামা দিতে পারেন নাই, সেটা ছিল তাঁদের জন্য অনেক কষ্টের। এখনও মনে আছে সন্ধ্যার পরে বের হয়েছিলাম। বের হওয়ার পর অনেকেই বলেছিল তোর নতুন জামা কই? পুরানা জামা পরে বের হইছিস কেন? উত্তরে বলেছিলাম সারাদিন পরছি আর কত?
এই রকম সমস্যায় আর কখনও পরতে হয় নাই। এর পরে অনেক বড় বড় সমস্যার মধ্যেও আমরা দুই ভাই নতুন জামা পেতাম। বিশেষ করে ছোট ভাইয়ের কান্নাকাটিতে আমিও জামা পেয়ে যেতাম। বেশিরভাগ সময়ই ঈদের আগের রাতে, কখন রাত এগারটা কখনও বারটা কখনও আরো রাতে আব্বার সঙ্গে ফার্মগেট থেকে জামা কিনতে যেতাম। ফুতপাতের সেই জামাগুলো ছিল অনেক বড় বড়। শার্টগুলো পড়তাম ইং করে। কারণ শার্ট একদম হাটুতে চলে আসতো। তবুও অনেক আনন্দ ঈদে তো নতুন জামা পেয়েছি!
তখন সম্ভবত নবম শ্রেণীতে পড়ি। থাকি নাখালপাড়ার ২৫৫ নাম্বার বাসায়। আমাদের বাসাটা ছিল টিন সেট, অনেকগুলো রুম ছিল সেই ২৫৫ বাড়িতে। প্রায় সাতটা পরিবার একসঙ্গে থাকত। সবাই একটা টয়লেট ব্যবহার করত, একটা গোসলখানা ব্যবহার করত, আর দুইটা চুলা ব্যবহার করত। পানির জন্য কল ছিল একটা। আমাদের বাসাতেই একমাত্র আলাদা বাথরুম, আলাদা রান্না ঘর ছিল। কিন্তু পানির ঐ একটা কলেই সবার ভাগ বসাতো হত। সেই সাত পরিবারের চার রকম পেশা ছিল। এক পরিবারের লোকজন গার্মেন্টসে কাজ করত, এক পরিবার বাজারে কাচামালের ব্যবসা করত আবার এক পরিবার শুধু রিক্সা চালিয়ে খরচ চালাত। ঐ পরিবারে একটি ছেলে ছিল নাম আহাম্মদ। আমরা সবাই আহাম্মক বলে ডাকতাম। ছেলেটি সম্ভবত প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
এক ঈদে নামায পড়ে বাসায় ফিরেছি। পাঞ্জাবী খুলে নতুন জামা পরে বের হয়েছি। গেটের সামনে আহাম্মদ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহাম্মদকে দেখে প্রচণ্ড মন খারাপ করে এমন করুনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কেন জানি আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগলো। আমার মনে হচ্ছিল আমি ওর চোখের ভাষা পড়তে পরছি। যেন সে বলছে, ‘তোমরা ঈদে নতুন জামা ঘুরতে পার, আমি পারি না কেন?’
আমি আর ওর সামনে দাঁড়াতে পারি নাই। আবার বাসায় ফিরে এসেছিলাম। সেই ঈদে নতুন জামা খুলে পুরনো জামা পরেই ঈদ কাটিয়ে ছিলাম। এর পরে আমি আর কখনও ঈদের নতুন জামা পরি নাই। এমন না যে ঈদে জামা পাই নাই। প্রতি ঈদে বাসা থেকে জামা দেয়ার চেষ্টা করত আমি নিতাম না। ঈদে অনেকে অনেক দামি দামি জামাও উপহারও দিয়েছে। এমন একটা ঈদ গেছে আমি মোট পাঁচটা টি-শার্ট উপহার পেয়েছি, কিন্তু আমি ঈদে নতুন জামা পরতে পারি নাই। পরলেই আহাম্মদ সেই চোখ ভেসে উঠে…
এর পর থেকে আমি প্রতি ঈদেই চেষ্টা করতাম বাচ্চাদের ঈদে জামা দেয়ার জন্য। বিশেষ করে যাদের নতুন জামা কেনার সামর্থ নেই। কিন্তু আনন্দ করার অধিকার আছে। ঘুরাঘুরি করতে করতে পরিচয় হল ‘ট্র্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশে’র সঙ্গে। আব্দুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে, মৃদুল ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁদের মাধ্যমে পরিচয় ‘কালারিং লিটল স্মাইল’ প্রোগ্রাম। অন্য এক নতুন দুয়ার খুলে গেল। বাচ্চাদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গী হওয়ার। মৃদুল ভাই যখন ফেসবুকে বলে, ‘তোর বিকাশ নাম্বারটা দিয়ে দিলাম, তোকে জিজ্ঞেস না করেই’ ভাবতে ভাল লাগে আমার মাধ্যমে যদি সামান্য হাসিও আসে বাচ্চাদের মুখে তাতেই সার্থকতা।

কিছুদিন আগে শাহীন ভাই ও ‘ফেস বাংলাদেশ’ সংঘঠনের মাধ্যমে ঘুরতে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থানার অর্জুনা ইউনিয়নের এক চরে। চরের মানুষ অনেক দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে থাকে। বিশেষ করে বর্ষাকালে তাঁদের হাতে কোন টাকা-পয়সা থাকে না। কারণ চারিদিকে পানি থৈ থৈ করে। চরে একদল বাচ্চাকাচ্চার ছবি তুলেছিলেন শাহনাজ আপা। তাঁর প্রথম ছবিগুলোতে বাচ্চাদের গায়ে জামা ছিল না, কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওরা ছবি তোলার জন্য বাড়ি থেকে জামা পরে এসেছিল। দেখতে অসাধারণ লাগছিল, মনে হচ্ছিল ওদের সুন্দর হাসি দেখার জন্যই হয়ত বেঁচে আছি…

একটা স্বপ্ন দেখি প্রায়ই। স্বপ্ন দেখি পৃথিবীর সকল শিশু হাসিখুশি আছে। তাঁদের কোন দুঃখ নেই…