একশত টাকা

একটা সময় প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বাজারে যাওয়াটা ছিল প্রধান দায়িত্ব। বাজার করতাম আনন্দের সাথে। আনন্দ পাওয়ার আরেকটা কারণ অর্থ। পঞ্চাশ টাকার বাজার করলে দুই-চার টাকা মারিং করা যায়। একদিন বাজারে গেলাম, বাজার বেশি না শুধু চিংড়ি মাছ আর আলু। আলু কিনতে অনেক দামাদামি করেও কোন টাকা বাঁচানো গেল না। কিন্তু দশ টাকার চিংড়ি কিনতে অনেক দামাদামি করে আট টাকায় কিনা সম্ভব হল। অর্থাৎ দুই টাকা!

বাজারে যাওয়ার সময় প্ল্যান ছিল আলু থেকে এক টাকা বাঁচাতে পারব আর চিংড়ি মাছ থেকে দুই টাকা। কিন্তু ফেরার সময় পুরাই মন খারাপ। ইচ্ছা ছিল তিন টাকা বাঁচাতে পারলে তিন টাকা দিয়া ডিম ছাড়া চটপটি খাব কারণ ডিম দিয়া চটপটি খেতে হলে পাঁচ টাকা লাগে। মন খারাপ করে রেললাইন দিয়ে বাসায় ফিরতেছি। হঠাৎ করে মনে হল পায়ের নিচে কি যেন একটা দেখলাম! পিছনে ফিরলাম, ফিরে এসে দেখার পর চোখ চক চক করে উঠল। একশ টাকার একটা নোট। অনেক কৌশল করে টাকা হাতে নিলাম। আহা! মনে হচ্ছিল আমি পৃথিবীর সবচাইতে ধনী মানুষ।

আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাজেট ছিল দুই টাকা করে। এই দুই টাকা দিয়ে একদিনের ইচ্ছা নিবারণ করতে হত। স্কুলে গেলে দেখা যেত আইসক্রিম খেলে আচার খেতে পারতাম না আবার আচার খেলে তেঁতুলের টক দেয়া আলু খেতে পারতাম না। দুই টাকার জায়গায় যখন হাতে একশ টাকা আসে তখন নিজেকে ধনী ছাড়া আর কিই-বা ভাবতে পারি!

টাকা নিয়ে সবার আগে গেলাম অলি ভাইয়ের দোকানে। ডিম ছাড়া চটপটি খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। পর পর দুই প্লেট চটপটি খেয়ে নিলাম। তারপর ঢুকলাম ভিডিও গেমসের দোকানে, এক কয়েনে চতুর্থ বস মানে ব্লেড বসের কাছে যেয়ে শেষ। আরেকটা কয়েন নিতে যাব তখন মনে হল আরে আমি তো বাজারে আসছি! অনেক সময় পার হয়ে গেছে। দ্রুত বাসায় দিকে রওনা দিলাম। মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা আজ খবরই আছে। আজ মনে হয় মাইর থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বাসায় যাওয়ার পর অবাক হতে হল কেউই কিছু বলল না।

একদিনে মোটামুটি ১৫ টাকা শেষ। পরদিন স্কুলে যাওয়ার পর আমাকে আর কে পায়। আমি তো মোটামুটি স্কুলে সবার চাইতে বড় লোক মানে ধনী, পকেটে অনেকগুলা টাকা। টিফিনে বের হয়েই অলি ভাইয়ের দোকানে ঢুকলাম আলু খাওয়ার জন্য। প্রতিদিন যেখানে আলু খেতে গেলে তিনবার ঝোল নিতাম আজ কোন ঝোল ছাড়াই আলু খেলাম তাও পর পর তিন বাটি। ঝোল দিতে অলি ভাই কখনও কার্পন্য করত না আমাকে, কারণ অলি ভাই বয়সে অনেক বড় হলেও তিনি প্রায়ই আমাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন।

দ্বিতীয় দিনেও আরো দশ টাকার মত শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ মনের মধ্যে অনুসূচনা জাগল, কার না কার টাকা হারাইছে আর আমি এভাবে খরচ করে যাচ্ছি। বড়দের কাছ থেকে শুনতাম রাস্তায় টাকা পেলে ফকিরদের যেন দিয়ে দেয়া হয় অথবা মসজিদে দেয়া হয়। নিজে নিজে যুক্তি দাঁড়া করলাম, টাকা তো নিশ্চয়ই আমার মন খারাপ ছিল বলে আল্লাহ দিয়েছে। আমি অর্ধেক টাকা মসজিদে দিব বাকি টাকা নিজে খরচ করব। কিন্তু মসজিদে দিব শুক্রবারে। কারণ শুক্রবারেই সাধারণত মসজিদে যাওয়া হয়।

শুক্রবার আসতে আসতে পকেটে টাকা কমে ৪৫ টাকায় দাঁড়ায়। প্রতিদিন ভাবতাম যত টাকাই খরচ করি না কেন পঞ্চাশ টাকা খরচ করব না। কিন্তু দোকানে কিছু দেখলেই খরচ করতাম, আর ভিডিও গেমসের দোকানে ঢুকলে তো কথাই নাই। শেষ পর্যন্ত মসজিদে মাত্র দশ টাকা দেয়া হয়েছিল। বাকি নব্বই টাকা আরাম করে খরচ করেছি দুই সপ্তাহে।

ঈমানের বড়ই অভাব…

[বাসা থেকে প্রতিদিন যখন হেঁটে হেঁটে অফিসে আসি বা অফিস থেকে বাসায় ফিরি তখন নানা রকম ঘটনা নতুন করে ফিরে ফিরে আসে। এই রকমই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টানা চারবার রাস্তায় টাকা পড়ে থাকতে দেখলাম। তা দেখেই এই ছোট্ট স্মৃতিকথা।]

২ চৈত্র ১৪২১

Comments

comments

Comments

  1. Rupa

    লেখা পড়ে ছোট বেলায় বাবার হাতে মার খাবার কথা মনে পড়লো। বাবার হাতে মার খেয়েছি সাকুল্যে ৩ বার। প্রথমবার ক্লাস টু তে পড়ি। মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে টাকা নিয়ে ইস্কুলের সঙ্গীদের নিয়ে খেয়েছি আরাম করে যা যা খেতে ইচ্ছে করে। আর বাসায় এসে খেয়েছি বাবার মার…আহ ছোট বেলা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.