কস্তুরী ভিডিও

এলাকায় বেশ কয়েকটা ভিডিওর দোকান ছিল। ভিডিওর দোকান বলতে সিডি-ডিভিডি ভাড়া দিত। প্রথমে ভিসিয়ারের ক্যাসেট পরে পর্যায়ক্রমে সিডি ভিসিডিতে রূপান্তর হয়। এমন একটা দোকানের নাম কস্তুরী।

কস্তুরীতে প্রায়ই যেতাম টুকটাক কাজ করতাম। দোকানের মালিক ছিল মফিজ ভাই। নামের মতো উনার বাড়িও ছিল উত্তরবঙ্গ। তখন তেমন কেউ উত্তরবঙ্গ বলত না, বেশিরভাগ মানুষই নর্থ বেঙ্গল বলতো। আমার বাবা এখনও নর্থ বেঙ্গলই বলে।

কন্তুরিতে বেশি যাওয়ার দুইটা কারণ ছিল। এক, মফিজ ভাইয়ের বয়স কম ছিল। দুই, এক বন্ধু ছিল নাছিম। নাছিম আমার চাইতে বছর দুয়েক বড় হবে। কিন্তু এক সঙ্গে খেলতাম তাই সম্পর্ক ছিল তুই তুমির। আমরা নাছিমকে কেউ নাছিম ডাকতাম না। ডাকতাম কাছিম। এই নামটা বন্ধু রিয়াদ দিয়েছিল সম্ভবত। আমরা এই রকম অনেক নাম দিতাম একজন আরেকজনকে। যেমন নূরুল আমিনের নাম দেয়া হয়েছিল নুরুল থেকে নুনু। 😛

তো আমার কাজ ছিল নাছিমের সঙ্গে দোকানে বসে থাকা আর বাড়ি বাড়ি যেয়ে সিডি-ভিডিডি সংগ্রহ করা। একটা বিল্ডিংয়ে ঢুকতাম দুই জনের ভাগ করে বিভিন্ন ফ্লাটে যেতাম। নাছিমের সঙ্গে চুক্তি ছিল যে ফ্ল্যাট আমার পরিচিত সে ফ্ল্যাটে নাছিম যাবে আর নাছিমের পরিচিত হলে আমি যাব। কারণ মান সম্মানের বিষয় ছিল, বিশেষ করে আমার। বাড়ি বাড়ি যেয়ে সিডি সংগ্রহ করছি এটা খুবই খারাপ দিক।

তখনও বাংলা সিনেমা বেশ চলতো। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত উভয়েই দেখতো। আর হিন্দি সিনেমাও চলতো পাল্লা দিয়ে। যদিও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন খুব একটা হিন্দি ছবি দেখতো না। মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বেশি হিন্দি ছবি দেখতো।

প্রথম প্রথম দোকানে বসার পর ছোটখাট থাক্কার মতো খেয়েছিলাম। দোকানের মূল ব্যবসা ছিল নিষিদ্ধ ছবি। নিষিদ্ধ ছবির গ্রাহকও ছিল চোখে পড়ার মত। বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন পেশার। আমরা যখন বাইরে থাকতাম মফিজ ভাই তখন দোকানে বসতো আর এলাকার মামা, চাচা, খালুরা উনার কাছ থেকে নিষিদ্ধ সিডি নিত। উনি যখন বসতেন তখন অল্প বয়সী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা সিডি-ডিভিডি ভাড়া নিত না। অল্প বয়সী ছেলেরা আমাদের কাছেই আসত।

তখন আবিষ্কার করলাম যে ছেলেটা স্কুলের সবচাইতে ভাল ছাত্র হিসেবে নামকরা। স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম পাঁচ জনের একজন ছিল, ৪.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাশ করলো (বর্তমানে ডাক্তারী করছে) সেই ছেলেটাও দোকানে এসে সিডি ভাড়া করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। আবার যে লোকটাকে মামা বলে ডাকছি, খালু বলে ডাকছি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছেন, জামাতে সবার আগে দাঁড়িয়ে থাকে সেই লোকগুলাই মফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে খয়েরি রঙ্গের কাগজে মুড়িয়ে সিডি নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ফিরে এসে বলছেন, ‘মফিজ ভাই এইটা তো দেখা নতুন আরেটা দেন।’ মফিজ ভাই বলছেন, ‘ভাই আগামী সপ্তাহে নতুন সিডি আনবো তখন নিয়েন। আপনাদের তো সবই দেখা।’

তখন আমরা দোকানে উচ্চ স্বরে গান শুনতাম ‘কাঁটা লাগা’। হিন্দি রিমিক্স মাত্র নতুন আমদানী হয়েছে, বম্বে ভাইকিংস বেশ উচ্চ আসনে বসে আছে। আর আইটেম গার্লরা তো আবেদনময়ী শরীর দেখিয়ে মাত করে ফেলেছে পুরা ঢাকার এক শ্রেণির দর্শকদের।

রমজান মাসের আগে মফিজ ভা্ই এসে ঘোষণা করলেন রমজান মাসে কোন ধরনের অসামাজিক ছবি ভাড়া দিবেন না। আর জোরে গানও শোনা যাবে না।

সবাই তখন আমরা ধার্মিক হয়ে গেলাম। পাঞ্জাবী পরে ঘুরি, নামাযের সময় নামায পড়ি। মফিজ ভাইয়ের ব্যবসা খুবই খারাপ। কিন্তু তিনি হাসিমুখে সবাইকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ব্যবসা ভালই।’

মফিজ ভাই ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদ রাতে তালা মারা নিষিদ্ধ ছবি আবার বের করেন। ঈদের দিন থেকে আবার ‘কাঁটা লাগা’ গান চলতে থাকে।

ততদিনে আমি কস্তুরী ভিডিও ছেড়ে নতুন দোকান বন্ধু ইব্রাহিমের সঙ্গে ওর কাকার দোকানে বসি। দোকানের নামটা অনেক মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। 🙁

২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.