কাক ১

‘শহিদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতি পাঠাগার’ রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারটা হবে, আমি আর কাজী ঘুমানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা দুইজনই এখানে থাকি। একজন নিরিবিলি আর শান্তিতে পড়ালেখা করার জন্য আরজন কোথাও থাকার জায়গা নাই তাই এখানে থাকতে হয়। হঠাৎ চিশতী ভাইয়ের ফোন, শরীফ একটু বাসায় আসতে পারবা একটু জরুরী দরকার ছিল। পাঠাগার থেকে চিশতী ভাইয়ের বাসা পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ।

চিশতী ভাইয়ের রুমে ঢুকে দেখি উনার সঙ্গে আরেকজন বসে আছে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার। আমাকে শওকত বলেই ডাকতে বললেন। শওকত ভাই-ই শুরু করলেন, ‘আপনে নাকি কাজ খুঁজছেন?’ উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বললাম। শওকত ভাই বললেন, ‘আমাদের অফিসে একজন দরকার, আপনি কি সব রকম কাজ করতে পারবেন?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘অবশ্যই পারব।’ কারণ তখন আমার প্রচণ্ড দুঃসময় যাচ্ছে, যে কোন একটা কাজ পেলেই বাঁচি। শওকত ভাই আবার বললেন, ‘টয়লেট পরিস্কার করতে পারবেন? ঘর ঝাড়– দিতে পারবেন তো?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেই, ‘পারব’। শওকত ভাই একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আগামীকাল বিকালে চলে আসো।’ কার্ডের পাশাপাশি লোকেশনও বুঝিয়ে দিলেন এ্যালিফেন্ট রোডের ক্যাটস আই গলি। যে কাউকে বললেই ক্যাটস আইয়ের শো রুম দেখিয়ে দিবে। ক্যাটস আইয়ের পাস দিয়ে একটা গলি আছে। গলিটা কানা গলি, শেষ বাড়িটাই আমাদের অফিস। তখন কানা গলি কি বুঝতাম না।

পরের দিন বিকালে পৌঁছালাম এ্যালিফেন্ট রোড। ঐ এলাকায় এর আগে কখনই যাই নাই। প্রথমে ফার্মগেট থেকে বাসে শাহবাগ তার হেঁটে হেঁটে এ্যালিফেন্ট রোড। সরাসরি দোতলায় অফিসে চলে গেলাম। শওকত ভাইকে খোঁজ করতে পেয়েও গেলাম। একটা ছেলে শওকত ভাইয়ের রুমে নিয়ে গেলেন। শওকত ভাই দেখেই বললেন বসো চেয়ারে। বসার পর ছেলেটাকে ডেকে বললেন একটা কাগজ আর কলম দিতে। ছেলাটার নাম ছিল আতিক। আতিক আমাকে কাগজ কলম এনে দিল। শওকত ভাই বললেন, ‘একটা দরখাস্ত লিখ।’ শওকত ভাইকে বললাম, ‘আমি তো কখনও দরখাস্ত লিখি নাই।’ শওকত ভাই বললেন কোন সমস্যা নাই আমি বলে দিচ্ছি তুমি লেখ। শওকত ভাই বললেন, আমি লিখলাম। চাকরী হয়ে গেল। প্রথমে বেতন ধরা হল ১২০০ টাকা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কবে থেকে যোগ দিতে পারব। আমি একদিন সময় চাইলাম। তুমি চাইলে এখানেই থাকতে পার। তোমার জন্য সুবিধা হবে আমাদের জন্যও সুবিধা হবে। আমি বললাম, ‘সপ্তাহ খানেক পর থেকে থাকব।’

দুই দিন পর কাজে যোগ দিলাম। সকাল ৯টার দিকে হাজির, অফিস শুনশান নিস্তব্ধ। অনেক্ষণ দরজায় শব্দ করার পর আতিক চোখে ঘুম নিয়ে দরজা খুলে দিল। অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি এত সকালে আসছো?’ অফিস তো শুরু হয় ১১টায়। যাই হোক আসো। ঢুকে দেখি পাসের রুমে শওকত ভাইও ঘুমাচ্ছেন। আমি বসে থাকলাম, শওকত ভাই ঘুম থেকে উঠলেন ১১.৩০ টার দিকে। উঠেই আতিককে দিয়ে নিচে থেকে এক চাচাকে ডাকিয়ে আনলেন, জাফর চাচা। আমার সঙ্গে জাফর চাচার পরিচয় করিয়ে দিলেন। বলে দিলেন জাফর চাচা বলে দিবেন কি কি করতে হবে।

জাফর চাচা ছিলেন, অসাধারণ একজন মানুষ। তিনি আমাকে হাত ধরে ধরে কিছু কাজ শিখিয়েছেন। আমি জীবনে টয়লেট পরিস্কার করি নাই। জাফর চাচা প্রথমদিন দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে পরিস্কার করতে হবে। দেখানো পর্যন্তই, যতদিন চাচা অফিসে ছিলেন আমাকে টয়লেট পরিষ্কার করতে হয়নি। উনি নিজেই করে দিতেন। আমার প্রতিদিন কাজ ছিল সকালে উঠে পুরা অফিস ঝাড়ু দেয়া। তারপর আর কোন কাজ নেই। অফিসে বসে বসে পত্রিকা পড়া ছাড়া। অফিসে পত্রিকা রাখত চারটার মত তিনটা বাংলা একটা ইংরেজি। অফিস পরিস্কার করার পরেই কাজ ছিল পত্রিকা পিন মারা। তারপর পত্রিকার ফ্রেমে ঢুকিয়ে রাখা। তারপর বিকাল পর্যন্ত অলস সময় পার করা। বিকাল থেকে রাত ৯/১০টা পর্যন্ত লোকজনের আনাগোনা থাকত।

প্রথম প্রথম বেশ মন খারাপ হত, এমনিতেই কাউকে চিনি না। নতুন জায়গা, নতুন কাজ, এমন সব কাজ যে কাজ জীবনে করি নাই। তবে একটা জিনিশ ছিল খুব ভাল, সেটা হল প্রতিটা মানুষে ব্যবহার। তাঁদের কাছে নতুন করে শিখলাম, মানুষের সাথে কিভাবে আরো ভাল ব্যবহার করা যায়। শেষের দিকে এলাকায় একই সঙ্গে দুইটা গ্রুপের সঙ্গে মিশতাম। একটা চরম ভাল গ্রুপ আরেকটা চরম খারাপ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতার বিস্তারিত অন্য কোন লেখায় লিখব।

‘কাকে’ এসে আস্তে আস্তে সেই গ্রুপটার কাছ থেকে নিজেকে বের করতে থাকলাম। সন্ত্রাসী গ্রুপে থাকার সময় যেসব দুঃসাহসিক কাজ করতাম (অবশ্যই নেগেটিভ অর্থে) সেই দুঃসাহসিক কাজগুলোকে পরিবর্তন করে ভাল দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলাম। চলতে থাকল নিজেকে আরো শুদ্ধ করার চেষ্টা।

১৯ অগ্রহায়ণ ১৪২১

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.