৪
শান্ত নদীতে বিরামহীনভাবে ছুটে চলেছে লঞ্চ…
হুইল এখন ফারুক ভাইয়ের হাতে রাত; ২টা বেজে গেছে অনেকটা সময় আগে…
একটা কথা অবশ্য ভুল হয়ে গেলো…
লঞ্চ এখন আর হুইলে চলে না সব ডিজিটাল হয়ে গেছে…
শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ…
সিগারেট ফুকতে ফুকতে সে গল্পই বলছিল মাস্টার ফারুক ভাই…
চারপাশে শুনশান নিরবতা…
ফারুক ভাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তার পীরের অলৌকিক গল্প বলেই চলছে…
সব কথা কানে ঢুকছে না…
চাঁদের আলোয় মাখামাখি জল মনের অতল থেকে স্মৃতি হাতরে ফিরছে…
মাথার ভেতর জীবনানন্দ… রবী ঠাকুর… শক্তি… জয় গোস্বামী…
সিগারেট না ছেড়ে দিলে… কফির সাথে সুখ টান দিয়ে সুখ নেয়া যেতো…
কেবিনের সে বিশালদেহী ভদ্রলোক পান থেকে চুন খসলেই এসে মাস্টারদের শাসিয়ে যাচ্ছে… কোনো কিছুই মাথার ভেতর জায়গা নিতে পারছে না…
মনটা উদাস উদাস হয়ে উঠেছে…
সব কিছু ছাপিয়ে রবী ঠাকুরের লাইন…
“কি জানি কিসের ও লাগি, প্রান ও করে হায় হায়”
এমনি ভাবোময় সময় হঠাৎই মৃদু স্বরে মোবাইলের এলার্ম বাজতে শুরু করলো চারপাশে… ডেকের ঘুমন্ত মানুষগুলো নড়েচড়ে উঠছে…
নামার সময় হয়ে আসছে… কিছুক্ষণের মধ্যে একের পর এক ঘাটে ভিড়বে আর যাত্রীরা নামতে শুরু করবে…
এই সময় আরেক ঘটনা আবিস্কার করলাম…
ডেকের নারীরা মোবাইলের ক্ষীণ আলোতে মাথা গুজে যেনো কি করতে শুরু করছে…
না অন্য কিছু নয়… ঘুম থেকে উঠে তারা সাজতে শুরু করছে…
সময়ের সাথে সাথে রীতিমতো মেকআপ বক্স বের করে সাজুগুজু আরম্ব হলো পুরোদমে… আস্তে আস্তে তা পুরো ডেক-করিডর সর্বত্র ছড়িয়ে পরলো…
পুরুষরা মুখহাত ধুয়ে জামা কাপড় পরিবর্তন করতে শুরু করলো…
নতুন কচকচে ঈদের পোষাক পরতে শুরু করলো…
অনেকে তো উত্তেজনায় স্টিকার-ট্যাগ সহই পোষাক পরে নিলো…
বডি স্প্রে-ডিউডেরেন্ট-জেল-স্নো-পাউডার-লিপিস্টিকের গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করতে শুরু করলো… ঘুম ঘুম চোখে তারা সেজেই চলছে…
আমরা অন্ধকার রুমে বসে কাচের জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখছি…
বাইরের মানুষগুলোর কেউ কেউ সেই কাঁচকে আয়না বানিয়ে সাজগোজ করছে আমাদের চোখের সামনে…
সাজুগুজুর চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি দেখতে মন্দ লাগছিলো না… শরীফও এই ফাঁকে এক ঘুম দিয়ে উঠে এসে দাড়িয়েছে জানালার সামনে… আমরা অবাক হয়ে হাসি হাসি মুখে মুগ্ধ হয়ে মানুষের আনন্দ মাখা চেহারা দেখছি…
নতুন বৌগুলো অবশ্য তাদের স্বামীদের বেশ ঝাড়ির মধ্যে রেখেছে…
কথায় কথা ঝাড়ি দিচ্ছে… স্বামীগুলো গোবেচারা মুখ করে মাথা কাত করে সব কিছুতেই সায় দিয়ে চলেছে…
তবে বয়স্ক পুরুষগুলো অবশ্য বৌগুলোকে বেশ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে…
ডেকের এক চাচামিঞা বেশ কিছু বাচ্চা নিয়ে উঠেছিল…
সে বাচ্চাগুলো সারারাত পালা করে চাচামিঞার পা টিপেছে…
তারা এখন তাদের পুরানো পোষাক ঠিক ঠাক করে নিচ্ছে…
তবে তাদের সবার মাথায় এখন নতুন চকচকে টুপি…
বাচ্চাগুলো অসহায়ের মতো অন্যদের বিলাশ দেখছে…
ইস্ কয়েকটা নতুন জামা হলে হয়তো শিশুগুলোকে হাসিমুখে দেখতে পেতাম…
একটু্-আকটু সামর্থ তো আমাদের অনেকেরই রয়েছে…
কিন্তু আমদের মধ্যে কতজন অন্যের মুখে হাসি ফুটাতে পারি…
ভেতরে ভেতরে কোথাও বরফ গলে জল নেমে গেলো…
কখনো কখনো এতো অসহায় লাগে নিজেকে… নিজের অবস্থাকে…
আবারো সব ঘোলাটে হয়ে উঠলো…
সব ভুলে মাথার ভেতর জীবনানন্দ বলে উঠলো…
” স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,-পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা – প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয় !”
.
৫
কোলাহল থেমে গেছে… সাঙ্গ হয়েছে লঞ্চ যাত্রা…
যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে একে একে…
আমাদের মতো অনেকেই অপেক্ষা করছে যাত্রীদের ভিড় কমবার…
এতো মানুষ এতোক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে…
মাস্টারের কাছে জানলাম আজ লঞ্চের যাত্রী ছিল প্রায় ১৮শ…
চাঁন রাত ও ঈদের দিন ২৫শ..র কাছাকাছি যাত্রী হয়েছিল…
রাতের বিভিন্ন সময় ডেকের যাত্রীদের ভাড়া আদায় হয়েছে কয়েক দফায়…
প্রথমে গোবেচারা টাইপের এক যুবক ভাড়া কেটেছে…
তাকে অবশ্য যাত্রীরা খুব একটা পাত্তা দেয়নি…
শেষ রাতে মাস্তান টাইপের একদল যুবক এসে আরেক দফা টিকেট কেটেছে…
এখন লঞ্চের বর্হি পথে টিকেট চেক করে করে যাত্রীদের নামতে দেয়া হচ্ছে…
রাত সাড়ে চার’টার কিছু পরে আমরাও নামতে শুরু করলাম…
গেটের সামনে বিশালদেহী যুবকের দল টিকেট চেক করে করে যাত্রীদের ছাড়ছে…
যারা টিকেট কাটেনি তারা শেষ সময় টিকেট কাটছে আর বের হচ্ছে…
অনেকেই অনুনয় বিনয় করছে…
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দানবের মতো যুবকটির যাকে মায়া লাগছে তার উদ্দেশ্যে অন্যদের বলছে… “গরীব গরীব ছাইড়া দে ছাইড়া দে…”
এসময় অনেকে টিকেট না কাটলে একটা সুযোগ নিতে পারতো বলে আপসোস করছে…
ভিড় ঠৈলে একসময় আমরাও নেমে পরলাম…
যাত্রীরা যে কত প্রকারে কুরবানীর মাংস নিয়ে গ্রামে ফিরছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল… হাঁড়ি-কলস-মিষ্টির প্যাকেট-টুকরি-বাজারের ব্যাগ কত কিছুতেই যে মংশ যাচ্ছে প্রিয়জনের জন্য তা কি কেবলই মাংস নাকি ভালবাসার ভাগাভাগি…
তখনো ভোরের আলো ফোটেনি… ব্যাগপত্র নিয়ে আমরাও চলছি অন্যদের পাশাপাশি… রাস্তায় এসে কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝলাম বাস স্টেশনে যাওয়ার বাহন পাওয়া বেশ মুশকিল… যাত্রীর তুলনায় অটো-ট্যাম্বুর সংখ্যা খুবই কম… ভাড়াও অনেক বেশি চাচ্ছে… চলছে তর্ক-বিতর্ক…
কিছুক্ষণ পর শরীফ প্রস্তাব দিলো বাস স্টেশন বেশি দূরে নয় আমরা হেঁটেই চলে যাই…
হাঁটতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই… তাই হাঁটা দিলাম… পাশাপাশি হাটতে থাকা একজন বললো অনেক দূর হেঁটে যেতে পারবেন না… বেটা অবশ্য আমাদের চেনে না… আমরা হাঁটা দিলাম… কিছু সময় পর পর সাঁই সাঁই করে দু/একটা ট্যাম্পু ছুটে চলছে বাস স্টেপিজের দিকে… সেই যাত্রীরা অদ্ভুত চোখে আমাদের দেখছে…
তাদের চোখে প্রথমে বিশ্বয়… তারপর একটু করুণা… শেষে হাসি… মনে হচ্ছিল লঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির মতো তারাও আমাদের উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলছে… “গরীব গরীব ছাইড়া দে ছাইড়া দে…”
সকাল সকাল আমরা বেশ মজা পেলাম… হাঁটা চলতে লাগলো… মাঝে মধ্যে দু’একজন পথচারীর দেখা মিলছে… সঠিক পথে চলছি কিনা তাদের কাছে জানতে চাইলে তারাও কেমন অদ্ভুত চোখে দেখছে আমাদেরকে… কেউ যেনো মেনে নিতে পারছে না… আমাদের হেঁটে চলা… সকলের চোখেই করুণা করুণা ভাব… অন্তরের কথা একটাই… “গরীব গরীব ছাইড়া দে ছাইড়া দে…”
যদিও বাস স্টেশন খুব কাছে ছিল না… তারপরও যাত্রাটা খারাপ হলো না… শরীফ একসময় বললো ভাই খেয়াল করছেন সকাল সকাল আমরা ১০০ টেকা বাঁচায়া ফেল্লাম অটোতে না উঠে… দুজনেই হেসে উঠলাম… হাসির শব্দে দূরে কয়েকটা কাক বের বিরক্তি নিয়ে কক করে উঠলো…
সকাল সকাল একশ টাকা লাভের খুশিতে আমরা চলতে হাঁটা চালিয়ে গেলাম…
আমরা কি তখনো জানতাম বাস স্টেশনে আমাদের জন্য কি বিভীশিখা অপেক্ষা করছে??
.
৬
এক জলন্ত বিভীষিকার নাম পটুয়াখালী বাস স্ট্যান্ড…
কারণ এখানে কেউ সঠিক কথা বলে না… বা বলতে চায় না…
যা বলে তার প্রায় সবটাই মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক…
মিনি বাসগুলোর গায়ে বিভিন্ন রুটের নাম লেখা থাকলেও সবার একই ভাষ্য সবাই কুয়াকাটা যাবে…
কুয়াকাটা লেখা বাসের সংখ্যা নেহায়াত কম নয়… একসাথে ৭/৮টা বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে… ৫/৬টা বাসে টুপটুপ ভরা যাত্রী… বাসগুলোর ড্রাইভার বসার বা হেলপার দাড়ানোর জায়গা আছে কিনা সন্দেহ… ছাদও রীতিমতো ভেঙে পরার যোগার… কিন্তু কোটাই ছাড়ার কোন লক্ষণ নেই… প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বাস… যাত্রীই তোলা হচ্ছে তবে ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই…
চারপাশে অসংখ্যা দালাল ঘোঁড়াফেরা করছে… আমরা যারা কুয়াকাটা ভ্রমণে যাচ্ছি তাদের দেখে সহজেই আলাদা করা সম্ভব… আমাদেরকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং প্রতারিত করার চেষ্টা করছে শতভাগ… মূল সড়ক থেকে ঢাকা থেকে আগত কুয়াকাটার বাসে উঠে যাওয়া যায় এমনি সময়ে কিন্তু এখন ক্ষমতাশালী নেতাদের কঠিন বাড়ন রাস্তা থেকে তারা কোনো যাত্রী তুলতে পারবে না… কারণ লোকালবাসগুলোর মালিক তারা… অগত্যা অধিক ভাড়া দিতে মিনিবাসের যাত্রী হতে হবে… সময়ও লাগবে দ্বিগুণ…
তা না হয় মেনে নিলাম কিন্তু কোন্ বাসে উঠবো??? কুয়াকাটাগামী যাত্রীদের সবাই বিভ্রান্ত… কারণ স্থানীয়রা আমাদের ছাগলের তিন নম্বার বাচ্চা হিসেবে ধরে নিয়েছে… আমরাও কম না… আমরাও ধরা দেই না… কিন্তু তারা ভালোই জানে… আমাদের ধরা না দিয়ে উপায় নেই…
এক ফাঁকে পরটা-ডিম-ডাল দিয়ে রাস্তার পাশের ছোট্ট হোটেলে নাস্তা সেরে নিলাম… ভোর পাঁচটা থেকে সাতটা বাজতে চললো কিন্তু কোনো বাসই ছাড়ার নাম গন্ধ নেই… অবশেষে বুঝলাম আমাদেরকেও টিকেট কেনে কোনো একটা খুপরীতে উঠে বসতে হবে… তা না হলে উপায় নেই… প্রায় দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে টিকেট কেটে ফেলল্লাম বহু দালাদের হাত বদলের পর…
একসময় আমরা উঠে বসলাম সীটে… আমাদের বাসে ছাদ ও হেন্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোক ভরপুর হয়েছে কিন্তু সীটের যাত্রী ভরে নি তাই বাস দড়িয়ে আছে ভাবলাম… কিন্তু আদতে তা নয়… আদতে রাজনৈতিক নেতাদের মালিকাধীন বাস আগে ছাড়বে তারপর চুনোপুটিদের… অগত্যা নির্ঘুম রাতের পর অসহ্য গরমে বাসে বসে থাকো…
আমাদের ঠিক পেছনে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে এক কিশোরী তার ছেলে বন্ধুকে ঝাঁড়িটারি দিচ্ছে… সম্ভবত সে কিশোরীর বাসা থেকে অনর্গল ফোন করছে… কিন্তু কিশোরী ফোন ধরছে না… সে এখন প্রেমে মজে আছে… প্রেম বড়ই অদ্ভুদ ব্যাপার মশাই… তার আবেদন অন্যে বুঝবে কেমনে… ছোট্ট ছোট্ট প্রেমের কথায় সেই কিশোরী গলে গলে পরছে…
তাদের খুঁনশুটি… অন্যযাত্রীদের বকাবকি… হেলপারের বাটপারি… ড্রাইভারের ভন্ডামি… আমাদের বিরক্তি… সব মিলিয়ে জগাখিচুরি অবস্থা…
সময় গড়িয়ে চলছে কিন্তু বাস ছাড়ছে না… কখন ছাড়বে কেউ জানে না… তবুও আমরা ক্লান্ত নই… কারণ আমরা চলেছি সমুদ্রে… পৃথিবীর সকল নোংরা ও নোংরামী সে পরিশোধন করে বৃষ্টি বানিয়ে দেয়… আমরা চলেছি আমাদের নোংরা ও নোংরামি ধুয়ে ফেলতে যাতে নতুন করে নোংরামি করতে পারি… নতুন করে ধ্বংসের খেলায় মত্ত্ব হতে পারি… নতুন করে ভালোবাসতে পারি…
সম্রাট শাহজাহানের মমতাজের প্রেমের কাহিনী শুনে আমরা যতটা পুলকিত হই… তার অগুণিত বৌ… সঙ্গীনির কথা কথা আমরা শুনতে বা জানতে চাই না… সেগুলো গোপন… আমরা নিজেরা প্রেমের প্রতীক তৈরির জন্য তা গোপন করি… মতিকণ্ঠের ভাষ্য অনুযায়ী বলতে হয়… “কিছু কতা থাকতা গুপন”…
আমরা চলেছি কুয়াকাটার পথে… অবশেষে বাস ছেড়েছে… এবার আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না… কারণ সামনের তিন ফেরীতেই শেখ পরিবারের পুত্রদের নামে নির্মিত হচ্ছে সেতু… কাগজ কলমে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুটি সেতু উদ্বোধন করলেও জানতে পারলাম শেখ রাসেল সেতুতে যান চলাচল চালু হলেও অন্যটি এখনো উন্মুক্ত হয়নি… তাতে কি… আমরা তো এখন আর কারো বাধা মানবো না… সাতার জানি না তো কি হয়েছে… তাও চলে যাবো সমুদ্রে… এই জ্যোস্নায় সমু্দ্রের পারে বসে মহুয়া খাবো… চাঁদ খাবো… বিশ্ব ভ্রমান্ত গিলে খাবো… কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না… জয় যাত্রা…