১৩
আজ আমাদের কোনো কাজ নেই…
কোনো উদ্দেশ্যও নেই…
উদ্দেশ্য অবশ্য কিছু ছিল না কোনোকালেই…
তারপরও তাড়া ছিল কুয়াকাটা ঘুঁড়ে দেখার…
সেটাও মোটামুটি শেষ… সকাল দশটার মধ্যে মোজাম্মেল আমাদের কুয়াকাটা শহরের মাঝে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে… বলে গেছে এছাড়া আর দেখার কিছু নেই কুয়াকাটায়… অনেক সময় কি করা যায় ভাবতে ভাবতে শরিফ বললো চলেন শহরের মন্দিরটা দেখে আসি… আপত্তি করার কিচ্ছুটি নেই… দুজনে চললাম কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের পূর্ব পাশে বৌদ্ধ বিহারে… তীব্র রোদে চামড়া পুড়ে যাচ্ছিল… তবে বৌদ্ধ বিহারের জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা… গাছপালা আছে বেশ কিছু… মন্দিরের সামনে ১০/১২ বছরের বালক বসে আছে… তার কাছে জানলাম মন্দিরে প্রবেশের জন্য ১০ টাকা করে দিতে হবে… তাই দিয়ে স্যান্ডেল খুলে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম…
বেশ পরিপাটি গোছানো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন নিরিবিরি এই বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্য কলায় যেমন মনোরম তেমনি এর পরিবেশ… আয়তনে বিশাল নয় এর পরিমণ্ডল তবে প্রধান মন্দিরটি বেশ বড়ই তার ভেতরে অষ্ট ধাতুর বুদ্ধ মূর্তিটি ঠায় বসে আছে যেনো ভক্তদের অপেক্ষায়…
সেখানে আমাদের সাথে পরিচয় হলো ১০/১২ বছর বয়সী মং এর সাথে… বছর দেড়েক ধরে সে এখানে আছে… এখানে পড়াশুনা করে আর মন্দিরের কাজ করে নিয়মকরে… তার মতো আরো বেশ কয়েকজন আছে এই মন্দিরে… তারাই দেখাশুনা করে এই মন্দিরের… গেটে যে দশ টাকা করে নেয়া হয় তাতেই হয় তাদের খাওয়া-পড়ার জোগান…

ছবি: লেখক
তারা প্রায় সকলেই এসেছে কক্সবাজার থেকে … এখানেই থাকে… পড়াশুনা করে… কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে কুয়াকাটার সমুদ্রাঞ্চল… প্রিয়জন… বন্ধু-বান্ধব… সব ছেড়ে তারা এখানে থাকে… স্বপ্ন দেখে পড়াশুনা করে একদিন অনেক বড় হবে… যেদিন ইচ্ছে মতো অনেককিছু করতে পারবে… দেখতে যাবে বাবা মাকে… এখন মন তেমন কাঁদে না… তবে প্রথম প্রথম সারাক্ষণ কান্না পেতো বাবা-মায়ের জন্য… কথাগুলো যখন বলছিল মং তখন তার চোখ ছলছল করছিল…
এমন অসম্ভব সরলতা নিয়ে চোখ ছলছল করে কেউ যখন আবেগের কথা বলে তখন নিজের আবেগকে ধরা রাখা বেশ মুশকিল… হঠাৎই মনে পড়লো সেই পুরানো গানটা-
“কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পাড়ে
মন তরে কে বা পার করে
সুসময়ে দিন গুবাইয়া
অসময়ে
আইলাম নদীর পারে
ও মাঝি তর নাম জানি না
আমি ডাইক দিমু কারে
মন তরে কে বা পার করে
নাও আছে রে পানি নাইরে
ওরে মানুষ নাইরে ঘরে
ও মাঝি তর নাম জানি না
আমি ডাক দিমু কারে
মন তরে কে বা পার করে
অধম ইদমে বলে
আমার কি আছে কপালে।।
আরো দর্শনার্থী চলে আসলো মং নিয়মানুযায়ী তাদের কাছে দৌঁড়ে গেলো না… আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো… সবাই তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে… একটু ভালো করে কথাও বলে না… ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গাল এই শিশুগুলো মানুষের কাছাকাছি ঘুঁড়ে বেড়ায়… কিন্তু মানুষরা তাদের দেখতে পায় না… আমরা তো সকলেই জানি ভালোবাসা দিলে ফুরায় না… তাও আমরা ভালোবাসা না ছড়িয়ে এত্তো ঘৃণা ছড়াই কেনো??? কেনো পৃথিবীব্যাপী এতো যুদ্ধ… মারামারি… হানাহানি…
সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থানের দাবীদার এই শতাব্দীর মানুষরা ভালবাসা নয় বোমা বানাতে ব্যস্ত… মারণাস্ত্র বিক্রির জন্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে বেড়ায়… মানুষ মানুষকে মেরেই চলছে… কখনো ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য… কখনোবা ধর্মের দোহাই দিয়ে… প্রশ্ন জাগে… এতো সভ্য হয়ে আমরা কি করবো… ছোট্ট শিশুদের মুখে যদি হাসি ফুটাতে না পারি… যদি তারা আমাদের জন্য ঘৃণা বুকে চেপে রাখে তাহলে আমরা কাদের জন্য নির্মাণ করছি এই সভ্যতার সার্টিফিকেট??? আমরা ঘুঁড়ে ঘুঁড়ে দেখলাম গোটা মন্দির… অনেক স্থাপত্য… মূর্তি… বোধিবৃক্ষ… কুপ… গাছপালা… কিন্তু মনের ভেতরের খচখচটা গেলো না… আমরা কি সভ্যতার নাম করে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি??? অসভ্য হয়ে উঠছি আমরা… কেবল সভ্য মানুষের খোলস পড়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি???
সাঁঈজি কোথায় তোমার সহজ মানুষ!!!
“মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই।। মূল হারাবি ও তুই মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।।
মানুষে মানুষ গাথা দেখ যেমন আলোক লতা।।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা।। যাতে চড়বি ও তুই যাতে চড়বি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।।
নিড়লে মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জলে।।
মানুষ গুরুর কৃপা হলেই।। সেই ধন পাবি ও তুই সেই ধন পাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।।
মানুষ ছাড়া মনরে আমার দেখবি ভবে সব শুন্যকার।।
ফকির লালন বলে মানুষ আকার।। ভজলে পাবি এই রুপ ভজলে পাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।।
ফকির লালন বলে মানুষ আকার।। ভজলে পাবি ও তুই ভজলে পাবি
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই ।। মূল হারাবি ও তুই মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।। “
.
১৪
দুপুরটা ঘুমিয়েই কাটালাম…
অলসতা কমছেনা কিছুতেই…
ঘুম আর আসছেনা তাও শুয়ে আছি…
সাউন্ডবক্সে গান বেজেই চলছে…
“দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।”
আর্টসেল ব্যান্ড ভালোই গেয়েছে… নজরুল লেখনিতে যা শক্তি…
তা গাঁয়ের জোরে না গাইলে ঠিক জমে না… শুনতে শুনতে তাই মনে হচ্ছিল…
ঠিক তখনি রুমে ঢুকলো হোটেল বয় সোলায়মান…
প্রতিবেলাতেই তার সাথে দেখা হচ্ছে কথাও হচ্ছে টুকটাক…
সে সব সময়ই ব্যস্ত… এটা করছে… ওটা করছে…
সেভাবে আলাপ হয়নি…
আজ আমাদেরও অখণ্ড অবসর…
সোলায়মানেরও আলাপের মুড জেগেছে…
তাই অল্প সময়ই জমে গেলো আমাদের আড্ডা…
আমি আর শরীফ আশ্চর্য হয়ে শুনছিলাম তার জীবনের ইতিহাস…
এইটুকু বয়সে সে জীবন থেকে যা শিখেছে… জীবন তাকে যা শিখিয়েছে…
তা এতো বছরে কি আমরা শিখতে পরেছি… নাকি পারবো…
“কে বোঝে মাওলার আলেকবাজি
করছে রে কোরানের মানে যা আসে যার মনের বুঝি।।
একই কোরান পড়াশোনা
কেউ মৌলভি কেউ মাওলানা
দাহেরা হয় কতজনা
সে মানেনা শরার কাজি।।”
প্রায় মাস তিনেক ধরে কিংস হোটেলে কাজ করছে সোলায়মান…
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে… ভালো স্টুডেন্ট ছিল তা নয়…
তবে স্কুলের সব খেলায় সে ফার্স্ট হতো… স্কুলে নাটকও করেছিল কয়েকবার…
সেই নাটক মোবাইলে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছিল কে জানি…
স্কুলের স্যার তাকে মোবাইলে তা দেখিয়েছিল… তা দেখে সে ভিষন লজ্জা পেয়েছিল…
তারপর থেকে অভিনয় আর করেনি… অবশ্য পড়াশুনাও আর এগুয়নি…
পরিবারে বড় ছেয়ে বলে সংসারের হাল ধরতে বাবার সাথে মাছ ধরার কারবারিতে নামতে হয়েছিল…
জাল পেতে মাছ ধরা খুবই কষ্টের কাজ… তার জন্য বাবা হাজার বিশেক টাকা খরচ করে জাল কিনেছিল… কিন্তু কয়েকদিন করেই সোলায়মান বুঝেছে… এ কাজ তার জন্য নয়… তাই সোজা পালিয়ে লঞ্চে চরে ঢাকায় পালিয়ে বাঁচে… এ কথা বলতে বলতে সোলায়মান ফিচ করে হেসে উঠলো… তার চোখগুলো চকচক করছিল কথা বলার সময়… কারো সাথে হয়তো বহুদিন পর নিজের কথাগুলো বলছে সে… কি সে উচ্ছাস… সে প্রায় অভিনয় করে বলছিল কথাগুলো…
এত্তোক্ষণে শরীফ বন্ধ করে দিয়েছে সাউন্ড বক্স… আমরাও শোয়া থেকে উঠে বসেছি… হোটেল ম্যানেজার মালেক ভাই ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ডেকেছে সোলায়মানকে… সোলায়মান অবশ্য সে ডাকে সাড়া দেয়নি… মালেক ভাই উঁকি দিয়ে দেখে গেছে আমাদের সাথে আলাপ করছে… তাই সে আর গা করেনি… চলে গেছে…
সোলায়মান তার ঢাকায় সব বিচিত্র কাজের কথা বলে চলছে… এহেন কাজ নেই সে করেনি সেসময় ঢাকায়… ঢাকায় তার এক দূরসম্পর্কের ভাই থাকে… তার কাছে সে ছিল বেশ কিছুদিন… তবে সেখানেও ভালো লাগেনি… তাবে ভয়ে বাড়ি ফিরেনি… বাবা যদি কিছু বলে… তবে বাবা তেমন কিছু বলেনি… শুধু বলেছিল জালের টাকা তো উঠাইতে পারলি না… যা ভালো মনে হয় কর… তয় একটাই পোলা আমার… তোর ঢাকায় থাকইকা কাম নাই… দেশেই থাক… তিনিই এই হোটেলে তাকে চাকরি দিয়েছেন… কুয়াকাটারই আরেক প্রান্তে তার বাড়ি… সে বাড়ি ভাই-বোন… বাবা-মা.. বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে এখানে চলে এসেছে সে…
তারপর থেকে এখানেই আছে সোলায়মান… বেতন খুবই সামান্য… সবাই ভালো আচরণও করে না… বোডার বেশি হলে ঘুমানোর জায়গাও পায় না… তখন ছাদে থাকতে হয়… সারাদিন হোটেলে কাজ করে… সকালে বিকালে ঢাকার বাস আসলে সেখানে যায় হোটেলের বোডার ধরে আনতে… একফাঁকে রান্না করতে হয়… আরেকজন আছে তার নাম ইসমাইল… পালা করে তারা রান্না করে… তবে এখানে রান্নায় সপ্তাহে একদিনও মাছ থাকে না… গ্রামে থাকতে প্রতিদিনই মাছ খেতো… এখন তা হয় না… তবে রান্না ভালো তাই খেতে খারাপ লাগে না তার…
কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম… সোলায়মান ঈদে গ্রামে যাওনি? প্রশ্নটা শুনে দীর্ঘসময় সোলায়মান কিছু বললো না… মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো… পা ঘঁষে ঘঁষে সময় কাটাতে লাগলো… আমরাও তাকে সামলে নিতে সময় দিলাম… ঘরের ভেতর আবহাওয়া গুমোট হয়ে উঠলো… ভারী নি:শ্বাস পড়ছিল সোলায়মানের…

সে সময় আমার বা আমাদের অনুভুতি কেমন হয়েছিল এখন আর মনে পরছে না… তবে এখন বুকের ভেতর হু হু করছে… আচ্ছা আমরা চাইলে কি সোলায়মানের গ্রামের বাড়ির যাওয়ার ভাড়াটা দিতে পারতাম না??? কয়েকটা টাকা ভাড়ার জন্য সে মা-বাবার কাছে যেতে পরেনি ঈদের দিন দেখা করতে… আর লেখা যাচ্ছে না… কেমন যেনো ঝাপসা হয়ে উঠছে সব…
মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না…
মেঘের বেশে আকাশ দেশে ওড়ে সারাক্ষন
দু:খের সুরে বৃষ্টি ঝড়ে নুপুরের মতন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না…
কোন ডালে সেই পাখিটার বসে নাকো মন
কারো প্রেমে ডুব দিল না এমন নিঠুর মন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না..
ভবের দেশে নেই এখন আর এমন একটা মন
যে আমারে বাসবে ভাল করিবে আপন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না..
.
১৫
লঞ্চের ফেরার রিক্সটা নিতে পারিনি…
জায়গা পাবো কিনা ভেবে ভেবে বাসে ফেরার টিকেটই কেটে নিয়েছিলাম…
এখন আমরা লেবুখালি ঘাটের এপারে বাসের সীটে এক জায়গায় ঠায় বসে আছি…
ইতিমধ্যে চারঘণ্টা পার হয়ে গেছে… এখন ভাটার সময়… তাই ফেরী চরে আটকে গেছে… অন্য ফেরীটি তাকে টানতে গিয়ে সেটিও আটকে গেছে… অবশ্য জোয়ার শুরু হয়েছে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে যান চলাচল শুরু হবে… ভোর ছয়টায় ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল… এখন আর বলা যাচ্ছে না কখন যেয়ে পৌঁছাবো… সে যাক… সেটা ঘটনা নয়… আসলে ঘটনা যে কি সেটাই বা কে জানে… আশপাশের দোকানগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে… শুধু যে গভীর রাতের জন্য তা নয়… আসলে অপেক্ষমান মানুষজন খেয়ে দোকানপাট ফাঁকা করে দিয়েছে…
আমরাও হাঁটাহাঁটি করে বাসে ফিরে এসেছি… তিন দিন কুয়াকাটার সময়টা বেশ ভালোই কেটেছে… কোনা তাড়াহুড়ো ছিল না… অস্থিরতা ছিল না… বিকাল ছয়টায় বাসে উঠার আগে হোটেল থেকে বিদায় নিয়ে আমরা শেষ সময়টা সমুদ্রের সূর্যাস্থ দেখেই কাটাবার সিদ্ধান্ত নেই… সে অনুযায়ী ব্যাগপত্র নিয়ে সৈকতে হাঁটছিলাম… সূর্য দিন শেষর সানাই বাজিয়ে চলছে… আমরা হাঁটছি… বিকেলের বাসে যারা কুয়াকাটায় এসেছে তারা উচ্ছাসিতভাবে সমুদ্রের দিকে দৌঁড়াচ্ছে…
গান গাইতে পারলে গেয়ে উঠতাম-
“তোমার হল শুরু, আমার হল সারা
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।।
তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথী
আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা।।
তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল
তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।
তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়
তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা।।”
টুপ করে যে কোনো সময় ডুবে যাবে সূর্য… কিন্তু সে সময় নিচ্ছে… সৈকতের এক পাশে ফুটবল খেলা হবে তার মহরা চলছে… আর একটু এগুতে হঠাৎ উচ্চস্বরে মাইকে গান শুনতে পেলাম… একটি বিশেষ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের গান বাজাছে… আমরা একটু অবাক হলাম… খুঁজতে লাগলাম কোথা থেকে আসছে গান…
কিছুসময় পর আবিস্কার করলাম… বিশাল এক নৌকা আসছে তীরের দিকে… সেটার মাইকেই বাজছে গান… তীরের কাছাকাছি আসতেই গান থেমে গেলো… মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো… “আমরা এখানে আসছি শিক্ষা সফরে… তাই তুমরা কারো সাথে মিসবা না… একসাথে সবাই দাঁড়াবা না… বিদেশীদের সাথে কথা বলতে যাবা না… কেউ কিছু জিজ্ঞাস করলে আমাদের না জানায়া কিছু বলবা না…” এরকম নানা বাণী দেয়া হচ্ছিল আগত বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের…
অল্পসময় পর যখন তা পারে ভিরলো… তখন দেখা গেলো “ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন”-এর একটা ব্যানার ঝুলছে নৌকাতে… নামতে শুরু করায় দেখা গেলো বেশিভাগই শিশু… ১০-১৫ বছরের বালকের সংখ্যা বেশি… কাছে গিয়ে জানতে পারলাম তারা চর কুররি থেকে এসেছে… ছোটরা আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলেও বড়রা ধমক দিয়ে বা চোকের ইশারায় তাদের দূরে নিয়ে চলে গেলো… ক্যামেরা দেখে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো…
তাদের দেখে সৈকতের ভাড়াটে ক্যামেরাম্যানের দল চলে এলো… সকলে অবশ্য সাহস করে ছবি তোলার কথা বলতে পারলো না… তবে এক হুজুর টাইপ ক্যামেরাম্যান বেশ উৎসাহ নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে জানতে চাইলো তারা ছবি তুলবে কিনা… তুলতে চাইলে পেছনে ভালো সিনারি দিয়া ছবি তুলে দেবে… তবে নৌকার বড়রা যখন তাকে চোখ রাঙানি দিলো… তখন আমরা পারে যারা দাঁড়িয়ে ছিলাম সকলে হেসে উঠলাম…
তবে সৈকতের সবাই তাদের দেখে কেনো যেনো চুপসে গেলো… একটু দূরত্বে চলে গেলো… ছোটবেলায় হুজুরটাইপ লোক দেখলে আমরা বুঝতাম তাদের মর্যাদা দিতে হবে… দিতে হবে বাড়তি সম্মান… এখন আমরা তাদের দেখলে ভয় পাই… মনে হয় কখন যেনে ঝাঁপিয়ে পরবে আমাদের দিকে… একটা নতুন কাপল সৈকতের দিকে যাচ্ছিল তবে নৌকার যাত্রীদের দেখে তারা পাশ কাটিয়ে দূরে চলে গেলো… যেমন চলে গেলো অন্যরা… আমরাও কেটে পড়লাম… কারণ বাচ্চা বাচ্চা হুজুর গুলো কটমট করে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল… যাক সে কথা…
এবার ফেরার পালা… সাঙ্গ হলো সমুদ্র দর্শন… শেষ বেলায় যতটা দেখে নেয়া যায়… একবার শেষ বেলায় পা ডুবিয়ে ফিরে চলে… আর কখনো এখানে ফেরা হবে কিনা জানি না… তবে বর্ষায় একবার আসতে চাই… ঝুম বৃষ্টিতে সমুদ্র দর্শন করবো… দেখা যাক কি হয়… সব কিছু ছেড়ে এখন চলে যেতে হবে… এবারের যাত্রা এখানেই কি শেষ নাকি আরো ঘটনা ঘটবে কে জানে… আরো কত টুকরো টুকরো ঘটনাতো বলাই হলো না… ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাব খাওয়ার অভ্যাসটা ছেড়ে দিতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় আপসোস আপাতত…
শেষ বললেই কি শেষ হয়… চলাচল কি থেমে যায়… জীবন মানেই তো চলে বেড়ানো… চলার নামই তো জীবন… নাকি অন্যকিছু??? থাক কঠিন ভাবনায় আর না যাই… এই ভ্রমণে অনেক প্রাপ্তি যোগ হলো কিন্তু তারপরও…
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কি’বা মৃদু বায় ।।
তটিণী-র হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায় ।
পিক কি’বা কুঞ্জে কুঞ্জে ।।
কুউহু কুউহু কুউহু গায়,
কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায় ।
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কি’বা মৃদু বায় ।।
তটিণী-র হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায় ।
পিক কি’বা কুঞ্জে কুঞ্জে ।।
কুউহু কুউহু কুউহু গায়,
কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।
