ছোটবেলা থেকেই সাধারণত আমরা বাড়িতে যেতাম ট্রেনে। ফেরার সময় বাসে ফিরতাম। তখন ট্রেনে উঠে সবার আগে জায়গা দখল করতে হতো। এই কাজ করতে হতো বাবা অথবা বড় ভাইয়ের। বাবা না গেলে স্টেশনে পরিচিত কাউকে না কাউকে বলে দিত। তারা ট্রেনে উঠে জায়গা দখল করে রাখত। আমাদের ছোটদের আম্মা জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতেন তারপর আম্মা উঠতেন। জায়গা দখল করতে হতো কারণ আমাদের যেতে হতো লোকাল ট্রেনে, লোকাল মানে সুপার লোকাল। প্রতিটা স্টেশনে থামত, পারলে স্টেশন ছাড়াও থামতো।
এখন আর কারো সঙ্গে যেতে হয় না। একা একাই যেতে হয়। এখন আর জায়গা দখল করা লাগে না। আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটতে হয়। আগে সময় লাগতো পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা এখন লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। কিছুটা উন্নতি তো হয়েছেই। আমার প্রতি মাসেই একবার বাড়ি যেতে হয়। সকালে যাই আবার বিকালে ফিরে আসি। ট্রেনের ঘটনাগুলা খুবই মজার হয়। আমি আগ্রহ নিয়ে সেই স্বল্প সময়ের ঘটনাগুলি দেখি।
১
গতকাল সকাল সকাল স্টেশনে চলে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আমি অন্তত ৫০ জনের পেছনে। তবুও টিকেট পেয়ে গেলাম। এমনকি সময়মতো ট্রেনও চলে আসলো। উঠে দেখি আমার সিটে অন্য একজন বসে আছে তাঁকে উঠিয়ে দিয়ে নিজের সিটে বসলাম। আমি যেখানে বসেছি তার উল্টা পাশে এক চাচার সিট তিনি উঠে দেখেন উনার সিটে আরেক চাচী বসে আছেন। চাচা ঐ চাচীর সঙ্গে পাঁচ মিনিট ঝগড়া করে নিজের সিট দখল নিতে সক্ষম হলেন। চাচীরও সিট ছিল কিন্তু দুই জনের ঝামেলা বেঁধেছে মূলত জানালার পাশের সিট নিয়া। মজার বিষয় হল দুইজনেরই জানালার পাশে সিট কিন্তু মুখোমুখি। সমস্যা হইল জানালার পাশে দুইজনে বসলেও ট্রেন যখন চলে তখন একজনের মনে হয় তা উল্টা দিকে চলছে। আর যাঁরা ট্রেনে চলাফেরা করেন তাঁরা জানেন উল্টা দিকে চললে মাঝে মাঝে কেমন যেন অস্বস্থি লাগে।
যাই হোক জয়ী চাচা অনেকটা আয়েশ করে বসলেন। কিছুক্ষণ পরে চাচা আর চাচীর সঙ্গে কথাবার্তা চলা শুরু করে দিল। যেন কিছুক্ষণ আগে কিছুই হয় নাই। দুইজন দুইজনের ছেলেমেয়ে সম্বন্ধে জেনে নিলেন। কে কি করে মোটামুটি সকল কিছু জেনে গেলেন। এর মধ্যে ছাদ থেকে পানির ছিটা এসে লাগলো। চাচার তো মেজাজ খারাপ, চাচী জানালা দিয়ে মাথা বের করে গালাগালি দিলেন এবং আবিষ্কার করলেন ঐটা আসলে সাধারণ পানি না। হিসুর পানি। এই বিষয় আবিষ্কার করে চাচীর আরো মেজাজ খারাপ চাচা আর চাচী দুইজনে একসঙ্গে ছাদের উপরের মানুষটার গুষ্ঠী উদ্ধার করে তারপর শান্ত হলেন।
ট্রেন বনানী স্টেশন পার হয়ে বিমান বন্দর স্টেশনে আসার পর অনেক লোকজন উঠলো। আমাদের সিটের পাশে একজন মহিলা দাঁড়ালেন সঙ্গে একটা মেয়ে আর একটা পিচ্চি ছেলে বয়স পাঁচ বা ছয় হবে। ছেলেটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো। মনে হচ্ছিল ঠিক যেন আমি দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু ঘটনা এখনকার না নব্বই একানব্বই সালের। কিছুক্ষণ পরে টিটি মানে টিকেট চেকার এসে সবার টিকেট দেখে গেলেন। দেখা গেল দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা টিকেট কাটেন নাই। ট্রেনেও দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকেট কাটার ব্যবস্থা আছে। মহিলা বললেন একটা টিকেট দেন। টিটি সাহেব তো অবাক, ‘এই মেয়ের টিকেট কাটবেন না?’ মহিলার উত্তর, ‘ওর বয়স তের বছর, ওর কেন টিকেট কাটবো?’ টিটি আর খুব একটা ঘটালো না চলে গেল কিন্তু সন্দেহের চোখে মেয়েটাকে দেখছিল।
কিছুক্ষণ পরে মহিলার খারাপ লাগা শুরু করলো। জানালার কাছে গিয়ে একবার বমি করলেন। চাচীর কাছে পানির বোতল ছিল সেটা দিয়ে কুলি করলেন এবং মাথায় পানি দিলেন। তারপর আমাদের পায়ের কাছে বসে গেলেন। এই দৃশ্য দেখে চাচার মায়া হল তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে মহিলাকে সিটে বসালেন। সঙ্গে তাঁর মেয়েটিও সেখানে বসলেন।
এই বিষয়টা আমাকে একটা ধাক্কা দিল। যেই লোকটা নিজের সিটের জন্য তুমুল ঝগড়া করলেন এখন সে-ই একজন অসুস্থ মহিলার জন্য নিজের সিটটা ছেড়ে দিলেন। আমি কেন এই কাজটা করতে পারলাম না? আমার এই কাজটা তো করার দরকার ছিল আরে আগে। চাচার বয়স হবে ৬০ এর মত। আমার বয়স চাচার বয়সের অর্ধেক। আমি নতুন করে আবার আবিষ্কার করলাম আমার ভেতরে মানবিকতা বোধ নাই।
এই শিক্ষা থেকেই বলা যায় চাচাকে বললাম, ‘চাচা আপনে বসেন আমি দাঁড়াই।’ চাচা বসবেন না অনেকটা জোর করেই আমাকে বসিয়ে রাখলেন। তবে আমরা দুইজনে একটা চুক্তি করলাম। কিছুক্ষণ তিনি বসবেন কিছুক্ষণ আমি বসবো। এভাবেই আমরা নরসিংদী পর্যন্ত গেলাম। এরপর চাচা বিদায় নিয়ে নেমে গেলেন। আমার আরো কিছুদূর যেতে হবে। পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনে কোন ক্লাসে পড়েন?’ উত্তর পেলাম ‘ক্লাস নাইন’।
হিশাব করলাম তের বছরে যদি নবম শ্রেণিতে পড়ে, তাহলে সে পাঁচ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।
২
এবার ফেরার সময়য়ের গল্প ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে আসলো। সিটে বসার পরে আবিষ্কার করলাম আমার আসে পাশে সবাই মহিলা। সামনে তিনজন আর আমার পাসে একজন মাঝখানে একজন চার-পাঁচ বছরের হুজুর। মাথায় টুপি, গায়ে পাঞ্জাবী। কিছুক্ষণ পরে হুজুর কান্নাকাটি শুরু করে দিল গরমে। হুজুরের পাঞ্জাবী খুলে দেয়া হলো। আর মহিলাদের কারোই মুখ দেখা যায় না, একজন ছাড়া। সবাই মোটামুটি পর্দানশীল। এর মধ্যে আবার দুয়েকজনের হাতও দেখার উপায় নেই। কালো দস্তানা পরা। আমার এই বিষয়টা ভালই লাগে। তাঁদের মধ্যে প্যাঁচ কম, তাঁদের যা বুঝানো হয় তাঁরা তাই বুঝে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা এটাই বলে। তাঁদের যুক্তি দিয়ে বুঝালে অনেক কিছুই বুঝানো সম্ভব।
প্রথমে ভেবেছিলাম তাঁরা একসঙ্গে, কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম তাঁরা আলাদা গ্রুপ। দুইজন মেথিকান্দা থেকে উঠেছে আর দুইজন আগে কোন স্টেশন থেকে উঠেছে। দুই গ্রুপই তুমুল কথাবার্তা আড্ডা দিতে থাকলেন। এর মধ্যে দুই গ্রুপ দুই পক্ষের চৌদ্দগুষ্ঠির খবর নিয়ে নিলেন। ফোন নাম্বাও আদান-প্রদান হয়ে গেল।
এর মধ্যে বংশপরিচয় জানাশুনার সময় আবিষ্কার করা হল দুই পক্ষেরই একজন করে বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ে আছে। ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে পরবর্তীতে দেখা সাক্ষাতের পাশাপাশি বিয়ের বিষয়ে ছেলেমেয়ে দেখার জন্যও কথাবার্তা চলবে। বিয়াইন ডাকা ছাড়া সবকিছু মোটামুটি ফাইনাল। দুইপক্ষই একমত কোন রকমের যৌতুক নেয়া হবে না, এটা পাপ। কিন্তু মেয়েপক্ষ থেকে কিছু দিতে চাইলে সেই বিষয়ে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু কোন কিছু ঠিক করা থাকবে না কি দিবে, অনেকটা যা ইচ্ছা তাই। একগ্রুপ টংগী স্টেশন নেমে গেল। আরেক গ্রুপ নামলো বিমানবন্দর স্টেশনে।
তাঁরা সবকিছুই আদানপ্রদান করেছেন। নিজেরা খাবার-দাবারও ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। শুধু মাত্র কেউ কাউকে দেখেন নাই। নিশ্চয়ই বিয়ের বর-কনে দেখার পাশাপাশি নিজেদের মুখ দেখাদেখিটাও সেরে নিবেন…
৩০ বৈশাখ ১৪২৫
