ঘরে তালা


স্কুলে বছরের প্রথম দিকে খেলার কারণে ঠিক মত ক্লাশ হয় না। ঠিক মত ক্লাস না হওয়ার আরেক কারণ সময় মত বই না আসা। আগে সরকার থেকে বই আসতে আসতে ফেব্রুয়ারি মার্চ লেগে যেত। আমাদের নাম ডাকার পরেই ছুটি হয়ে যেত। নিয়ম অনুযায়ী খেলার বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হত। আমরা বারান্দায় বসে বসে খেলা দেখতাম আর তালি দিতাম।

কি মনে করে বিস্কুট দৌড়ে নামও দিয়ে দিলাম। আমার স্থান হল প্রাথমিক শাখার মধ্যম দলে। দল ভাগ করা হইত সব মিলিয়ে ছয়টা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি প্রাথমিক শাখা এর আবার তিনটা ভাগ। আবার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শাখা। ছাত্রদের লম্বা অনুযায়ী ছোট দল, মধ্যম দল, বড় দল। আমাদের মাধ্যে খায়রুল সারাজীবন অর্থাৎ প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছোট দলে ছিল। আর প্রতি খেলায় প্রথম হইত। কিভাবে কিভাবে যেন বিস্কুট দৌড়ে বাছাই পর্বে টিকে গেলাম। চূড়ান্ত খেলায় প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতে পারলেই পুরস্কার নিয়ে বাসায় ফিরতে পারব।

বেশ আনন্দ নিয়া বাসায় ফিরলাম তখন আমরা থাকি নাখাল পাড়া পোস্ট অফিসের পাশেই। আমি, বড় ভাই, বড় বোন আর বাবা থাকি। মা আর ছোট ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকে। বাসায় ফিরে দেখি ঘরে তালা দেয়া। বোন দরজার সামনে বসে আছে মন খারাপ করে। কিছুক্ষণ পরে বড় ভাইও হাজির। জানতে পারলাম বাসা ভাড়া দেরিতে দেয়ার কারণে বাড়িওয়ালা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। রান্না-বান্না বন্ধ সবাই না খাওয়া। বাবা রাতে আসবে তারপর একটা ব্যবস্থা হবে। এর মধ্যে বড় ভাই দুই টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন যাও রুটি কিনে খাও। আমি খুশিতে দৌড়ে ভাণ্ডারীর হোটেল থেকে তন্দুর রুটি আনতে চলে গেলাম। তন্দুর রুটি আমার খুবই পছন্দ আর বিস্কুট দৌড়ের লড়াইয়ের জয়ের খুশিতে ভবের এই জটিল সমিকরণ আমায় স্পর্শ করলো না।

পরবর্তীতে বিস্কুট দৌড়ের ফাইনাল খেলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে একটা পুরস্কার পেয়েছিলাম নাখাল পাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। সেটাই ছিল স্কুলের কোন খেলায় পাওয়া প্রথম অথবা শেষ পুরস্কার।


প্রথম ঘটনার বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। ততদিনে মা ছোট ভাই গ্রাম ফিরে আসছে। আমরা একই বাসাতে থাকি। দুই দিন পরে কোরবানি ঈদ। রাত আটটা নয়টার দিকে নতুন ভাড়াটিয়া হাজির। আমরা কিছুই বুঝতে পারতেছি না। বাড়িওয়ালা এসে বলল আপনাদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে। বেশি ভাড়ায় ভাড়াটিয়া পাইছি তাই ভাড়া দিয়ে দিছি। আপনারা তো ঠিক মত ভাড়া দিতে পারেন না আর নতুন ভাড়াটিয়া ভাড়াও বেশি দিবে।

আমরা তখন অতল সাগরে পড়লাম। নতুন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হইল আমরা সকালে চলে যাব। এত রাতে তো কোথাও যেতে পারব না। আর বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেও আমরা পারব না। এক রুমের ঘরে আমরা ছয়জন নতুন ভাড়াটিয়া পাঁচজন কোন রকমে রাতটা কাটালাম।

এক রাতের মধ্যে সব গোছানোর চেষ্টা হইল। পাশের বাসায় কণা আপাদের বাসায় অনেক জিনিশপত্র রাখা হইল। সকালে বাবা আমাদের জন্য শিয়া মাজার মাঠের কাছে একটা বস্তিতে তিনশ টাকায় একটা ঘর ভাড়া করলেন। সেখানে কোন রকমে সব জিনিশপত্র রাখা হইল। একটা খাট ফিট করা হইল। খাট ফিট করেই আম্মা প্রথমে মশারি টানিয়ে দিলো তারপর সেই মশারির ভিতরে আমাদের দুই ভাইকে ঢুকিয়ে দিলেন। আমরা দুই ভাই রেসলিং খেলাতে ব্যস্ত। আমরা দুইজন ছোট কিছুই তেমন বুঝি না। কিন্তু আমদের আনন্দের সীমা নাই। আমরা জানতে পারছি, গ্রামের বাড়ি চলে যাব। সেখানে খেলার সাথীর অভাব নাই। অনেক আনন্দ করা যায়। আর এক চাচাতো ভাই আমাদের জন্য ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের জন্য নতুন জামা পাঠিয়েছে তাই ডাবল আনন্দ।

আমরা বস্তিতে দুই রাত থাকলাম। ঈদের দিনটা কাকার বাসায় কাটালাম। ঈদের পরের দিন মহা আনন্দে ট্রেনে করে বাড়ি রওনা দিলাম। পরের একটি বছর গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। সেই এক বছর ছিল মহা আনন্দের, পড়ালেখা নাই। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি, পুকুড়ে দাপাদাপি। শুধু খাওয়ার সময় বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোন তাড়া নেই।

প্রায়ই চিন্তা করতে হয় একটা মানুষের জীবনে কত ঘটনা ঘটতে পারে? তারপরেও মানুষ টিকে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু ভেঙ্গেচুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে…
.

.
.
১৮ চৈত্র ১৪২২

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.