১
ছোটবেলায় ঘড়ির অনেক সখ ছিল। বিশেষ করে বয়স যখন ছয়-সাত হবে তখন। বাসা থেকে সব সময় বলত এইবার পাশ করলেই নতুন ক্লাসে উঠার সময় ঘড়ি দেয়া হবে। কিন্তু কখনই নতুন ক্লাসে ঘড়ি দেয়া হত না। কারণ নতুন ক্লাস মানেই নতুন করে ভর্তি, নতুন করে ভর্তি মানে নানা রকম সমস্যা।
ঘড়ি না পাওয়ার দুঃখ বেশিদিন থাকল না। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকার সময় একদিন বাবা ফার্মগেট থেকে ঘড়ি নিয়ে আসল দুই ভাইয়ের জন্য দুইটা। ঘড়িতে ইংরেজিতে লেখা ছিল Casio। আমরা সেই কেসিও ঘড়ি পরে রাস্তায় বের হই। স্কুলে যাই। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর ঘড়ি দেখি। বন্ধুদের সামনে ইচ্ছা করে ঘড়ির দিকে তাকাই। এক ঘণ্টা পর পর এলার্ম দিয়ে রাখি। বন্ধুদের সামনে ঘড়িতে শব্দ হলেই নিজেদের ভাব অনেক বেড়ে যেত। ঘড়িটা কম দামি ছিল, তাই কিছু সমস্যাও ছিল। যেমন ওয়াটার প্রুফ ছিল না। তাই হাত ঘামলেই ঘড়ির মনিটর কালো হয়ে যেত। প্রথম দিন যখন কালো হয়ে গেল তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম ঘড়িটা বুঝি গেছে। কিন্তু খুলে রাখার পর ঘাম শুকিয়ে গেলে আবার ঠিক চলতে শুরু করত। এই ঘড়িটা অনেক দিন ছিল। পঞ্চম শ্রেণির পর যখন স্কুল ছেড়ে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটাও নষ্ট হয়ে গেল। এর পর দীর্ঘদিন আর ঘড়ি পরা হয় নাই।
২
মোটামুটি তিন বছর স্কুল জীবন ছাড়া চলার পর আবার ঠিক হল নতুন করে স্কুলে ভর্তি হব। ততদিনে পরিবারের বেশ স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এক স্যার খুঁজে বের করলাম, লুলু স্যার (স্যারের নাম লুলু কেন জানিনা, আসল নাম এনামুল হক)। তিন বছর না পড়ে সরাসরি ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়াটা একটা চ্যালেঞ্জ। স্যারের বাসায় নিয়মিত যেতাম। আমরা সকালের ব্যাচে পড়তাম এবং সবাই ছেলে। কিছুদিন পর হঠাৎ এক নতুন মেয়ের আবির্ভাব হল, নাম মৌ। এর আগে কখনও মেয়েদের সঙ্গে এভাবে পড়া হয় নাই অথবা মেশাও হয় নাই। কারণ আমি যে স্কুলে পড়তাম সে স্কুলে সকালে মেয়েদের ক্লাস ছিল। এগারটার পর মেয়েদের ছুটি হলে তারপর ছেলেদের ক্লাস শুরু হত। আমরা যখন স্কুলে যেতাম তখন মেয়েরা ফিরত। ঐ আসা-যাওয়ার সময় দেখা পর্যন্তই। যেটা বলছিলাম, মৌ আসার পর আমরা কয়েকদিন প্রথম প্রথম একটু অপ্রস্তুত থাকতাম। সহজ ভাবে কথা-বার্তা বলতে পারতাম না। মৌ-ও চুপচাপ বসে থাকত।
একদিন আমরা স্যারের বাসায় পড়তে গিয়েছি। সবাই আসছে, অংক করি গল্প করি। হঠাৎ মৌ ওর ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করে আমাকে দিয়ে বলল, তোমার জন্য। এখানে খুলবা না, বাসায় গিয়ে খুলবা। জীবনে প্রথম কোন মেয়ের কাছ থেকে একটা গিফট পাওয়ার পর আর পড়ায় মন থাকে না। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল এটার ভিতরে কি আছে? আর আমাকেই বা কেন? অনেক উৎকন্ঠার পর বাসায় যেয়ে বাক্সটা খুলে দেখি, অনেক সুন্দর একটা ঘড়ি। হাত ঘড়ি না টেবিল ঘড়ি। পরের দিন সকাল সকাল স্যারের বাসায় চলে গেলাম। মৌ আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, শুধু শুধু আমাকে এটা দেয়ার কারণ কি? উত্তরে বলল, ‘আসলে কোন কারণ নাই, বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল ছুটির পর সেজান্ট পয়েন্ট গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ তোমার কথা মনে হল, আর ঘড়িটা দেখে তোমাকে দিতে ইচ্ছে করল। তখন মনে হয়েছে আমার যদি তোমার মত একটা ভাই থাকত তাহলে কেমন হত? তুমি কি আমার ভাই হবা?’ এই ধরনের প্রস্তাব উপেক্ষা করা খুবই কঠিন।
৩
অনেক বছর ঈদে নতুন জামা-কাপড় বিহীন কাটানোর পর নতুন জামা-কাপড় পাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু ততদিনে আমার মন পাল্টে গেছে, আমি আর নতুন জামাতে আনন্দ পাই না। বাসায় সরাসরি বলে দিলাম, আমি ঈদে জামা নিব না। বাসায়ও তখন আর আমাকে তেমন একটা ঘাটায় না। বাসায় গেলে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকি, গান শুনি অথবা বই পড়ি। আর আম্মা স্কুলের পড়ার জন্য প্রতিদিন খ্যাচ-খ্যাচানি করতে থাকে। আমিও ঐসব কথায় কান দেই না। আমি আমার মত থাকি। ঈদে ছোট ভাইকে জামা-কাপড়ের জন্য টাকা দেয়া হল সঙ্গে আমার জন্যও। আমি ছোট ভাইকে সরাসরি বলে দিলাম সে যেন এই কাজ না করে। ছোট ভাই নিজের জন্য জামা-কাপড় কেনার পর, আমার জন্য এ্যালিফেন্ট রোড থেকে একটা ঘড়ি কিনে আনলো। ঘড়িটাতে নাম ছিল এডিডাস, আরেক পাসে স্পোর্টস। খুব পছন্দ হল ঘড়িটা।
ঘড়িটায় সব চাইতে বড় সমস্যা ছিল আমার হাতে লাগত না। আমার হাত অনেক চিকন। ফার্মগেট থেকে নতুন করে ফুটা করে নিয়ে আসলাম। বাসায় আসার পর দেখি তারপরেও হাতে লাগে না। তখন সারাদিন মাথার মধ্যে ক্রিকেট ঘুরাফেরা করত। বল করার সময় হাতে ব্যান্ড থাকত। ঘড়ি পরাতে সেই হাতের ব্যান্ডটাই ছিল আমার ভরসা। ব্যান্ড থাকলে আরাম করে পরতে পারতাম।
কোন এক বইয়ে পড়লাম কিভাবে হাতের পাল্স দেখতে হয়। টিভিতেও দেখতাম ডাক্তাররা রুগীকে দেখার সময় হাত ধরে পাল্স দেখত। আমার মধ্যেও ঘড়ি হাতে পাওয়ার পর সেই বাসনা জাগল। প্রথমে নিজের হাতের পাল্স দেখি, তারপর বন্ধুদের হাতের পাল্স দেখি আর রায় দেই। রাতে ঘুমানোর সময় ঘড়িটা বালিসের কাছে রাখি। অন্ধকার হয়ে গেলে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে ভাল লাগে। শুয়ে থাকলেও রাতে ঘুম আসত অনেক দেরিতে। মৌয়ের দেয়া ঘড়ি আর ছোট ভাইয়ের দেয়ার ঘড়ির শব্দ শুনতাম।
এক রাতে হঠাৎ বোন ডেকে তুলল, তাড়াতাড়ি উঠো আম্মা কেমন জানি করতেছে। সবাইকে কাছে ডাকছে। প্রথমে টয়লেটে গেল, তারপর বের হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমও কেটে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি একটা আঠারর মত বাজে। আম্মা এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন, আমরা তিন ভাইবোন আর বাবা চারপাশে বসে আছি। আম্মার এর আগেও এইরকম খারাপ লেগেছে আবার কিছুক্ষণ পর ঠিকও হয়ে গেছে। বোন মাথার কাছে, আমি মার ডান দিকে বসে আছি, বাবা বাম দিকে। কিছুক্ষণ পর বাম হাত দিয়ে বাবার হাত ধরে রাখলেন, আর ডান হাত দিয়ে আমার হাত ধরে রাখলেন। আমার হাতে তখন এডিডাসের ঘড়ি। ঘড়িতে তাকিয়ে আছি, আর মার ডান হাত ধরে বসে আছি, আমার মনে হয় তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। তা না হলে এই কাজ করার কথা না। ঘড়ির কাটা ঘুরতেছে, আর মার রক্তের স্পন্দন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। বাড়ার পর আবার কমতে শুরু করল, আস্তে আস্তে আরো কমতে শুরু করল, আরো কমল, একটা সময় মনে হল অনেকক্ষণ পর পর একটা একটা রক্তের ফোঁটা অনেক আস্তে আস্তে আমার বুড়ো আঙ্গুল স্পর্শ করে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে…
ঈশ্বর আমার সঙ্গে কেন যে এই রসিকতাটা করল…
আমি আর কখনও হাতে ঘড়ি পরি নাই।
কি লিখতে গিয়ে যে কি লিখে ফেলছি বুঝলাম না। ছোট বোন নবনীতার সঙ্গে দেখা, কথায় কথায় ঘড়ি দেখিয়ে বলল, ‘দাদা এই ঘড়িটা আমার হাতে ভালমত লাগে না, নতুন একটা ফুটা করেছি তারপরেও লাগতেছে না। কি করি বলত?’ ওর হাত আমার হাতের চাইতেও বেশি চিকন, ওর এই কথাতেই হঠাৎ এই লেখাটা মাথায় আসছে।
🙁 সময়ের ঘড়িগুলো এমন অসময়ে কেনো যে থেমে যায়…:( সেদিনের সেই মৌ আজকের আপনাকে দেখলে কী বলতো, জানি না..। নিশ্চয়ই ওর খুব গর্ব হতো ভাইকে দেখে…:)