চান্দের গাড়ি

সম্ভবত আট নয় বছর আগের কথা, ২০০৮/২০০৯ সালের দিকে হবে। আমরা চারুকলার সামনে বসে আড্ডা দেই। চারুকলার সামনের ফুটপাথই ছিল ভ্রমণ বাংলাদেশের অঘোষিত অফিস। সবাই যার যার অফিস অথবা কাজকর্ম শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় চারুকলার গেটের সামনে হাজির হয়ে যেত। অবস্থাটা এমন ছিল রাতে ভাত না খেলেও চলে কিন্তু অফিস শেষে চারুকলার আড্ডা না দিলে মনে হইত কি যেন নাই নাই।

আড্ডার ৮০% বিষয়ই ছিল ভ্রমণ। ভ্রমণে কি কি মজা হয়েছে, সামনে নতুন করে কই যাওয়া যায়, কি কি করা যায় নানা রকম পরিকল্পনা। টুটুল (আমরা সবাই টুটু ভাই ডাকি) ভাই  খোকন ভাই পুরান ঢাকার টানে বলেন বান্দারবানের পাহাড়ে কাচ্চি খাওয়ার গল্প। দুইদিন পর পর পুরান গল্প কিন্তু শুনতে একদম নতুনই লাগত।

রাহাত ভাই প্রায়ই নতুন নতুন পরিকল্পনা করার চেষ্টা করতেন। আর সেইসব পরিকল্পনায় ঘি ঢালার জন্য প্রস্তুত থাকতেন অন্যরা। সেই নতুন নতুন পরিকল্পনায় কয়েকটা ট্রিপ হয়েছিল যেগুলার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। এর মধ্যে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ হাঁটা, বর্ষায় সেন্ট মার্টিন, বর্ষায় কেওক্রাডংসহ (এই ট্রিপে আমার যাওয়া হয় নাই) নানা রকম ট্রিপ।

আমাদের আড্ডার মধ্যে একটু হা-হুতাশও ছিল। বিশেষ করে ভ্রমণে গিয়ার নিয়ে। আমাদের দেশে তখন তাঁবু স্লিপিং ব্যাগ এইসব কিছুই পাওয়া যেত না। স্লিপিং ব্যাগ পাওয়া যেত কাকড়াইলের মোড়ে, তাবলিকের সেই স্লিপিং ব্যাগগুলো ব্যাগের মধ্যে ঢুকালে আর জায়গা থাকে না। কেউ যদি দেশের বাইরে যায় তখন তাঁকে অনুরোধ করলে তারপর নিয়ে আসতো। আরো সমস্যা ছিল যাঁরাই বাইরে যায়, তাঁরা আবার তাঁবু অথবা স্লিপিং ব্যাগ কি জিনিস তাই বুঝে না।

একদিন এই ধরনের কথা বলতেই বলতেই কেউ একজন বলে উঠলো এটা তো আমরাই বানানোর চেষ্টা করতে পারি। যেই কথা সেই কাজ। রাব্বি ভাই, টুটু ভাই আর রাহাত ভাই মিলে নেমে পড়লেন সেই কাজে। টুটু ভাইয়ের কোন এক বন্ধুর গার্মেন্টস থেকে বানানোর ব্যবস্থা হল। প্রথমে ৩০ পিস বানানো হলো। সেই প্রথম ত্রিশ পিসের মধ্যে আমি একটা নিলাম।

সবাই ভ্রমণের জন্য স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করলেও আমি আর ইশতিয়াক ভাই দুইটা কাজে ব্যবহার করতাম। আমি যেহেতু অফিসে থাকতাম তাই স্লিপিং ব্যাগের কারণে আলাদা বিছানা লাগতো না। গরমে নিচে বিছিয়ে ঘুমাতাম আর শীতে ভিতরে ঢুকে যেতাম। ইশতিয়াক ভাইও মেসে তাই করতেন, শীতে আলাদা কম্বল অথবা কাঁথার দরকার পড়তো না। আর আমাকে কাঁথা বানিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিলও না।

স্লিপিং ব্যাগ বানানোর পরে সবার মাথাতে আসলো এটার তো একটা নাম দেয়া দরকার। সম্ভবত রাব্বি ভাই এই স্লিপিং ব্যাগের নাম দিলেন চান্দের গাড়ি। এখন হয়তো অনেক কিছুই চাইলে কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু প্রথম দিকের এই প্রোডাক্টের আবেদন ছিল অন্য রকম।

আজ ঘুম থেকে উঠে স্লিপিং ব্যাগ মুখের উপর থেকে সরাতেই ব্যাগের চান্দের গাড়ির ট্যাগটা চোখে পড়লো। আহা চান্দের গাড়ি!

আরেকটা মজার বিষয় এই স্লিপিং ব্যাগের টাকাটা আজও টুটু ভাইকে শোধ করা হয় নাই। এই রকম অনেক ভ্রমণ গিয়ারের টাকাই রাব্বি ভাই অথবা অনেক বড় ভাইদের শোধ করা হয় নাই। এই ঋণ হয়তো আজীবন থাকবে। এখন হয়তো চাইলেই টাকা দিয়ে শোধ করে ফেলা যাবে। কিন্তু সেই প্রয়োজনের সময় এবং পাশাপাশি অর্থ কষ্টের সময় জিনিসগুলো পাওয়া আর স্বপ্ন পূরণের ঋণ কি কোনদিন শোধ করা যাবে?

অবশ্যই না, কখনই না!

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.