আমার প্রথম ছবি কবে তোলা হইছে মনে নাই।
যে ছবিটা তোলার কথা মনে আছে সেই ছবিটা সংগ্রহে নাই। তবে মনে আছে তখনকার সময় ছবি তোলাটা অনেক বড় একটা বিষয় ছিল। স্কুলে ভর্তির জন্য ফর্মের সঙ্গে ছবি দিতে হবে তাই ছবি তোলার একটা বিষয় আসছিল। ছবি তুলতে যাওয়ার আগে বড় বোন গোসল করাইছিল। শুধু গোসল না, নতুন জামা-কাপড় পরানো, মাথায় তেল দিয়ে একপাশে সিঁথিও করে দিছিল। আমরা যে বাসাটায় থাকতাম সেই বাসার নাম্বার ছিল ১৩৫। আলেক মঞ্জিলের সেই দুইতলা বাসাটা এখন আর নাই। সেখানে বড় একটা এপার্টমেন্ট হয়ে গেছে।
আমাকে সাজুগুজু করিয়ে পশ্চিম নাখালপাড়া থেকে পূর্ব নাখালপাড়া হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যেই স্টুডিওতে ছবি তোলা হইছিল সেই স্টুডিওর নাম ছিল ‘অবাক স্টুডিও’। অবাক স্টুডিওতে যে ছবি তুলতো তাঁর নাম ছিল সেলিম। একটা টুলের মধ্যে বসিয়ে মুখে কিছু পাউডারও মাখছিল, কপালের কোনায় কাজলের ফোঁটা দিছিল কিনা মনে নাই। তারপর আদেশ দেয়া হয়েছিল মাথাটা একটু সোজা কর, একটু ডানে, একটু বামে। এভাবেই ঠিকঠাক করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাও সেলিম ভাইয়ের মন মতো হচ্ছিল না। তিনি আবার নিজে এসে মুখটা নেড়েচেড়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন।
কয়েকটা লাইটের কারণে জোর করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলাম ক্যামেরার দিকে। যখন ছবি তোলা হলো তখন একটা ফ্ল্যাশ দিয়েছিল, কয়েক সেকেন্ড চোখে কিছুই দেখি নাই। এভাবেই স্কুলের জন্য পাসপোর্ট সাইজের ছবিটা তোলা হয়েছিল।
তখন মনে হয় এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া ছবি তোলা হতো না। টুকটাক বিয়েতে হয়তো ছবি তোলা হইতো। আরেকটা সময় দেখতাম সবাই ছবি তুলতো। সেটা হইল ঈদের সময়। ঈদে অনেক দোকান বন্ধ থাকলেও স্টুডিওগুলা বন্ধ থাকতো না। ঈদে সবারই এমনিতেই নতুন জামাকাপড় থাকত, সেটা ধরে রাখতে অনেকেই ছবি তুলতে যেত। আর এলাকার বড় আপুদের সাজুগুজুর কথা নাইবা বললাম। আরেকটা বিষয় ছিল স্টুডিওগুলাতে কোর্ট-প্যান্ট, ক্যাপ, সানগ্লাস সহ অনেক জিনিশপত্র পাওয়া যেত। আর পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডের সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য তো ছিলই। এখনো হয়তো খুঁজলে মফস্বলে এই ধরনের সেটাপ পাওয়া যাবে।
আস্তে আস্তে ডিজিটাল হতে হতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। পূর্ব নাখালপাড়ার সেই সেলিম ভাইয়ের অবাক স্টুডিও এখন আর নাই। তবে কিছু কিছু উন্নতমানের স্টুডিও চলে আসছে। এখন আর স্টুডিওর নামগুলাও বাংলায় নাই। ডিজিটালের সঙ্গে সঙ্গে নাখালপাড়ার পূর্ব আর পশ্চিমে দুই জায়গাতেই ইংরেজি নামে দুইটা স্টুডিও বিখ্যাত হয়েছিল। জানিনা এখনো তাঁরা তাঁদের নাম ধরে রাখতে পারছে কিনা। পূর্ব নাখালপাড়ায় ছিল টুডে স্টুডিও আর পশ্চিম নাখালপাড়ায় টুমোরো স্টুডিও। আমি যেহেতু পশ্চিম নাখালপাড়ায় থাকতাম তাই টুমোরো স্টুডিওতেই বেশি যাওয়া হতো। টুমোরো স্টুডিওতে যে ভাইটার সঙ্গে সবচাইতে বেশি খাতির ছিল তাঁর নামটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি নাই। জুয়েল বা এই টাইপের কিছু একটা হবে।
আমাদের পরিবারে সবাই মিলে কোন ছবি তোলা হয় নাই। পাসপোর্ট সাইজের ছবির বাইরেও খুব বেশি ছবি তোলা হয় নাই। তুললেও তা নষ্ট হয়ে গেছে।
অনেকদিন আগে গ্রামের বাড়িতে একটা ছবি পেয়েছিলাম কাকার ঘরে। সম্ভবত এটাই হবে আমার প্রাচীন আমলের বেঁচে যাওয়া একমাত্র নষ্ট না হওয়া ছবি। আমরা তিন ভাই আর আম্মা আছি এই ছবিতে। আরেকটা বিষয় হইল এই ছবির মানুষগুলার মধ্যে কেউ বেঁচে নাই, এই অধম ছাড়া।
২১ বৈশাখ ১৪২৭
