নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় একবার স্কুল পালিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমরা সব মিলিয়ে ১২/১৩ জন। প্রথমে তেজগাঁও রেল স্টেশন। আমাদের বিশেষ পছন্দের স্কুল পালানোর মাধ্যম ছিল। কারণ খাপে খাপে সময় মেলানো যেত। তেজগাঁও থেকে ট্রেনে উঠে চলে যেতাম নরসিংদী সেখানে থেকে আমার ফিরতি ট্রেনে তেজগাঁও। আমাদের স্কুল শুরু হতো ১১ টা ৪৫ মিনিটে। আর ছুটি হতো ৪ টা ৩০ মিনিটে। কর্ণফুলী এক্সপ্রেস নামে একটা ট্রেন চট্টগ্রাম যেত, তেজগাঁ থেকে সেই ট্রেন ছাড়ার সময় ছিল সাড়ে এগারটা। আর নরসিংদী থেকেও একটা ট্রেন দুপুরের দিকে ছাড়তো তেজগাঁ পৌঁছাতো সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটায়।
আমরা দল বেঁধে তেজগাঁ স্টেশনে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠাটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে সুমন বেশ এক্সপার্ট। সে প্রথমে ছাদে উঠে যেত তারপর উপর থেকে টেনে টেনে একজনকে তুলে ফেলতে আর একজন উঠে যাওয়া মানে আর কোন সমস্যা না। আমাদের এই দিনের বিশেষ অভিযান হল নরসিংদী থেকে বোম কিনে আনা। কারণ সামনে শবে-বরাত। নরসিংদী থেকে অল্প দামে বোম এনে এলাকায় বেশি দামে বিক্রি করা।
যে গ্রুপটার সঙ্গে যাচ্ছি সেই গ্রুপটা এলাকার মোটামুটি সবচাইতে খারাপ গ্রুপ। খারাপের চূড়ান্ত পর্যায়ের। এলাকায় এমন কোন কাজ নাই তারা করে না। আর ঐ অকাজগুলাই ছিল আমার আকর্ষণের কেন্দ্র। সেই দিন কোন কারণে ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে অনেক দেরি করলো। নরসিংদী নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখি ফিরতী ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ঐ ট্রেনে উঠা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। বাধ্য হয়ে ট্রেনে উঠতে হলো। ট্রেনে উঠে সবার মোটমুটি মেজাজ খারাপ, যে কাজে আসা হইছে সেই কাজ হইল না। আমরা উঠে বসার পর ট্রেন ছেড়ে দিল। একটু দূরে আমাদের থেকে দুই/এক বছরের ছোট হবে দুইটি ছেলে বসে ছিল। আমাদের মধ্যে সম্ভবত হিজু রুবেল ছেলে দুটির সঙ্গে এমনিতেই কথাবার্তা বলা শুরু করলো। জানতে পারলো ছেলে দুটি খিলক্ষেতের দিকে থাকে। নরসিংদী এসেছে বোম কেনার জন্য। এই খবর নিয়ে রুবেল ফিরে আসলো। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত এই দুইজনের বোম কেড়ে নিতে হবে। দলের মধ্যে দুইটা ভাগ হয়ে গেল। কেড়ে নিয়ে নেয়ার পাল্লাই ভারি হয়ে গেল।
রুবেলের দায়িত্ব পড়ল আরো খোঁজ নেয়া, বিশেষ করে কোথায় নামবে। জানা গেল ওরা বিশ্বরোডের দিকেই ট্রেন ১/২ মিনিটের জন্য থামে সেখানে নেমে যাবে। একজন বলে উঠলো কিন্তু আমরা তো তেজগাঁ যাব। ঐখানে যদি ছেলেগুলার বন্ধুরা থাকে তখন কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে, আমরা অল্প, ট্যাকেল দেয়া যাবে না। পেছন থেকে অপু বলে উঠলো এই ঝামেলা যাওয়ার কি দরকার ব্যাগ রেখে দুইটারে এখনি ধাক্কা দিয়া ফেলে দেই? সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন হই হই করে উঠল। মাথা খারাপ নাকি চলন্ত ট্রেন থেকে পড়লে বাঁচবে? অপু এই বিষয়ে কান দিতে নারাজ মরলে মরবে। দুইচারটা না মারলে কেমনে হবে? এর ভিতর থেকে আনোয়ার একটা বুদ্ধি দিল। আমরা বোম নিয়ে এয়ারপোর্ট নেমে যাব। সেখান থেকে বাসে চলে যাব। কিন্তু বাস ভাড়া তো কারও কাছে নাই। সবার পকেট খুঁজে মাত্র ১৮ টাকা পাওয়া গেল। ১৮ টাকা অনেক টাকা এই টাকা দিয়াই একটা ব্যবস্থা করা যাবে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু দুইটারে ঝাড়িটা দিব কে? আমাদের তখন শফিক লিডার। শফিকরে সবাই আমরা মামা ডাকি। মামা ডাকার কারণ হইল সম্পর্কে শফিক রাজুর মামা হয়। আর রাজুও আমাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। এলাকার বিখ্যাত কদম আলী লোকে বলে সে ১৮ টা বিয়া করছে (আমি নিজে পাঁচটা বউ দেখছি)। রাজুর মা কিন্তু শফিকের বোন না, কিন্তু শফিকের বোনকে বিয়ে করছে কদম আলী। আর রাজুর বাবা কদম আলী (কদম আলীর কাহিনী আরেকদিন)।
শফিক সবার আগে রওনা দিল পেছনে তারছিড়া সুমন, অপু, আনোয়ার। সুমনরে পিছনে রাখা হইছে কারণ সুমন মারামারির সময় উল্টাপাল্টা কাজ করে বেশি সেই তুলনায় আনোয়ার বেশ ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারে। শফিক যেয়ে প্রথমে ছেলে দুটিকে দাঁড় করাইল, করিয়েই একটারে থাপ্পর। এক থাপ্পরেই কাজ হয়ে গেল, ব্যাগ নিয়ে চলে আসতেছিল তখন পেছন থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো ভাই সব নিয়া যান ব্যাগটা দিয়ে যান বই আছে ব্যাগ না থাকলে বাসায় কি কমু? শফিকের মায়া হইল। আনোয়ারের স্কুলে ব্যাগে আর অপুর ব্যাগে বোম রাখা হইল। আমরা এয়ারপোর্টে নেমে গেলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে বিআরটিসিতে উঠলাম। পুরা বাস খালি, আমরা সামনে সিটে না বসে সবাই একদম পিছনে চলে গেলাম। যেহেতু আমরা ভাড়া কম দিব সেহেতু সামনে বসার কোন মানে হয় না। এক সময় কন্টেকদার আসলো, অপু ভাড়া দিল ১০ টাকা। আমরা মানুষ হইলাম ১৩ জন। শফিক কন্টেকদাররে ঝাড়ি, বেশি হাউকাউ করলে একটাকাও পাইবা না। আর বাসও কিন্তু নাবিস্কোর আর কোথাও যাবে মনে রাইখ। কন্টেকদার অনেক নরম সুরে বলল আর পাঁচটা টাকা দেন। আমরাও মনে মনে খুশি কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই বাঁচা গেল।
নাখাল পাড়ায় ফিরে বিকালে জরুরি মিটিং ডাকা হইল। আমাদের আমির শফিক মামা ঘোষণা করলেন এই বোম বিশেষ কাজে ব্যবহার করা হবে। ছোট বোমগুলা বিক্রি করে যে টাকা আসবে সেই টাকা দিয়ে বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করা হবে। আর বড় বোমগুলা আমরা অপারেশনে কাজে লাগাবো। বড় বোমগুলাকে আমরা হান্টার বলতাম।
সেই বিশেষ অপারেশন হইল, মিরপুর মাজার আক্রমণ…
এখানে একটু পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। আমাদের গ্রুপে অনেক ছেলেপেলে থাকলেও সবাই একই রাজনীতি করতো না। মোটামুটি চারটা গ্রুপে ভাগ ছিল। একটা অংশ লিগ করতো, একটা অংশ দল। দুইজন করতো ছাত্রশিবির, এই দুইজন, শফিক আর হালিম। দুইজনেই মাদ্রাসায় পড়তো। আমাদের গ্রুপে কাইয়ূম নামেও একজন ছিল সে মাদ্রাসায় পড়তো কিন্তু বিএনপি করতো। আমরা প্রতি সন্ধ্যায় সবাই মুগ্ধ হয়ে কাইয়ুমের গান শুনতাম। সে নিজে নিজের নাম দিয়েছিল শ্যাম সরকার। আর আমি তখন ছাত্রফ্রন্ট করতাম। এক পিকুলিয়ার গ্রুপ ছিল।
মিরপুর মাজার আক্রমণের গল্প আরেকদিন…
২০ শ্রাবণ ১৪২২
অপেক্ষায় থাকলাম মিরপুর মাজার আক্রমনের কাহিনী শোনার জন্য।
কেওক্রাডং না নিয়া গেলে কেমনে শুনাই?