জন্মদিন

জীবনে প্রথম যখন জন্ম দিনের দাওয়াত পাই তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। এগার নাম্বার গলিতে থাকার সময় তাবন ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম দাওয়াত পাই। তাবন ভাইরা ছিল তিন ভাইবোন মিথুন ভাই, তাবন ভাই আর শ্রেয়া। তিনজনের জন্মদিনই পালন করা হত। তাবন ভাইয়ের কাছ থেকে যখন দাওয়াত পেলাম তখন বাসায় এসে বললাম। কিছু একটা তো দিতে হবে। কিন্তু কিছু কিনে দেয়ার মত অবস্থা তখন আমাদের নাই। বড় বোন একটা বুদ্ধি বের করল, বলল কোন সমস্যা নাই। ব্যবস্তা একটা হয়ে যাবে। টাকা দিয়ে বললেন র‌্যাপিং পেপার নিয়ে আসতে। দুই ভাই মিলে রেলগেটের আদর্শ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসলাম র‌্যাপিং পেপার। আপার কাছে বেশ কিছু বই ছিল। এর মধ্যে একটা বই খুঁজে বের করলাম যে বইটা একদম নতুন, ভেতরের পাতায়ও কিছু লেখা নাই। বইয়ের নামটা এখনও পরিষ্কার মনে আছে, ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’। কার লেখা সেটা মনে নাই।

তাবন ভাইয়ের বাসায় মোটামুটি এলাকার সব পরিচিত ছেলেপেলে হাজির। বাবু, পাভেল, হিমেল, বাপ্পি, রাসেল, তমহা, লায়েল ভাই সবাই। আমরা সবাই এলাকায় একসঙ্গে খেলি, মারামারি করি, ঘুরিফিরি। কেক কাটার আগেই সবাই মোটামুটি বুক করে ফেললাম কে কোন অংশটা খাবে। কেউ বলল, আমার ঐ লাল ফুলটা লাগবে, আমার লাগবে ঐ গোল্লাটা। প্রথম জন্মদিনের দাওয়াতটা ভালই লেগেছিলে। খাওয়া-দাওয়া ছিল সেই রকম। এই খাওয়া-দাওয়াটাই ছিল আসলে আমাদের কাছে লোভনীয়। প্রথমেই ছিল চানাচুর, বিস্কিট, কেক আর কোক। তারপরে বিরিয়ানি।

এই জন্মদিনের পর দুই ভাইয়েরও কত সখ হল ‘যদি একটাদিন করা যেত আমাদের!’ কত ভাল হত। দুই ভাই মিলে ঠিক করলাম আমরা একটা জন্ম দিন করবই। কিন্তু তাবন ভাইয়ের বাসার মতো ক্রিমওয়ালা কেক কেনা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না আর লালনীল মোমবাতিও তো দূরের আলো। ঠিক করলাম বেকারী থেকে ছয় টাকা দিয়ে একটা কেক আনব। ছোট ভাইয়ের জন্মদিনে সত্যি সত্যি ছয় টাকা দিয়ে একটা কেক নিয়ে আসলাম। জন্মদিন পালন করব আমরা দুই ভাই-ই আর কেউ থাকবে না। মোমবাতি হিসেবে নিলাম সাধারণ মোমবাতি, বিদ্যুৎ চলে গেলে যে মোমবাতি ব্যবহার করা হয় সেটা। আমরা ঘরের বাতি নিভিয়ে তারপর জ্বালিয়ে কেক কেটেছিলাম। দুই ভাই মিলে অনেক মজা করেছিলাম। টুকুর জন্মদিনটা ছিল পহেলা বৈশাখে। অন্যরকম একটা দিনে জন্ম। বাংলা নতুন বছরেরও জন্ম সঙ্গে ওর ও জন্ম, কি আনন্দ।

ঐ বয়সে দুই ভাই ঠিক করলাম এসএসসি পরিক্ষার পর দুই/আড়াই মাস ছুটি থাকে। সেই ছুটিতে গার্মেন্টসে চাকরি করব একমাস। তারপর সেই টাকা দিয়ে একটা কেক কিনে অনুষ্ঠান করবো। ছোটবেলার কত শত স্বপ্ন থাকত। এখন মনে হলেই হাসি পায়।

এর পরে আর তেমন নিজেদের জন্মদিন ঐভাবে ঘটা করে পালন করা হয়নি। হয়েছিল একবার মা মারা যাওয়ার পরে তখন আমি বিকে আফতাম স্কুলে নবম শ্রেণিতে পার হয়ে দশম শ্রেণিতে উঠব উঠব করছি। নিজের একটা জন্মদিন পালন করব বলে টাকা জমালাম। সেই জন্মদিনে অনেককেই দাওয়াত দিলাম। খাওয়া-দাওয়া হল ফার্মগেটের একটা দোকানে। অনেককেই দাওয়াত দেয়া হয়েছিল পরিচিত বন্ধুদের আর ছোট ভাইয়ের বন্ধুরাও বাদ পড়ল না। ঐ জন্মদিনের আগে কোন এক জন্ম দিনের তারিখে বড় বোন আমাকে একটা রূপার চেন দিয়েছিল। একসময় চেইনের অনেক সখ ছিল গলায় চেইন পরে ঘুরতে ভাল লাগত।

পরবর্তীতে আমার ঐ জন্মদিনে সেই প্রিয় চেইনটি মৌকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তখন মৌ-ই মনে হয় বন্ধুদের বাইরে আমার খুব কাছের মানুষ ছিল, বন্ধু বোন, দুইটাই। আমি অবশ্য এই ধরনের কাজ প্রায়ই করি। এক জনের কাছ থেকে পাওয়া প্রিয় জিনিশ আরেকজন মানুষকে দেই। যেমন রোজির কাছ থেকে পাওয়া মোবাইলটা তানিয়া আপাকে দিয়ে দিয়েছিলাম উনার মোবাইল নষ্ট হওয়ার পর। মৌ প্রায়ই বাসায় আসত স্যারের বাসা থেকে ফেরার সময়। আমার জন্মদিনে মৌ সবচাইতে সুন্দর একটা লেখা লিখে দিয়েছিল। গোটা গোটা হাতে লেখা ছিল, ‘আই উইশ আমার ভাইটা যেন পৃথিবীর সব সুখ পায়।’ আমি এটা মাঝে মাঝে একটু উল্টে দিয়ে অনেককে লিখে দেই।

ঐ জন্মদিনের পরে নিজেকে একদম গুটিয়ে ফেললাম খুব কাছের মানুষ ছাড়া আমার জন্মতারিখ তেমন কেউ জানে না। আমার কাছে সব সময় এই বিষয়গুলা অর্থহীন মতে হতে লাগল। আমি আর কখনও কারও জন্মদিনে সেইভাবে ঘটা করে যাই না। সবাই যাচ্ছে সঙ্গে ধরে নিয়ে গেলে যাই। কোন ধরনের প্ল্যান ছাড়া। আমার জন্মদিনও কাউকে পালন করতে দেই না। একবার সুরাইয়া কয়েকজনকে নিয়ে আমার জন্ম দিনের আয়োজন করতে যেয়ে ভালই ঝামেলায় পড়েছিল।

যদিও প্রতি জন্মদিনেই সুরাইয়া আমার জন্য একটা কেক নিয়ে বসে থাকে একা একা। ঐ অনুষ্ঠানে আর কেউ থাকে না। শুধু আমরা দুইজনই। প্রতি জন্মদিনে আমি কারও কাছে কিছু আশা করি না। কিন্তু দুই একটা মানুষের কাছে আশা করি। যেমনÑ সুরাইয়া, মনে হয় প্রতি জন্মদিনেই সে একটা না একটা কিছু দেয়ই। টুকু থাকতে প্রতি জন্মদিনেই একটা এসএমএস দিত। লেখা থাকত একটা লাইন, ‘হ্যাপি বার্থডে দাদা’। অথবা যাই লিখত শেষে দাদা থাকতই। ছোটবেলা থেকেই টুকু আমাকে দাদা ডাকত। আহা দাদা ডাক শুনতে কতই না ভাল লাগত…

পৃথিবীর সকল মানুষের জন্ম শুভ হৌক…

২০ চৈত্র ১৪২১

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.