জিৎ কুণ্ডু মার্শাল আর্ট স্কুল

ছবি: ইন্টারনেট
ছবি: ইন্টারনেট

আমাদের এলাকায় গলি ছিল অনেকগুলা। প্রায় ১২/১৩ টা। সবাই ১২ নাম্বার পর্যন্ত গলির ১৩ নাম্বার গলিটা ছিল অনেক ছোট তাই সম্ভবত ১৩ নাম্বার গলির কথা কেউ বলত না। আমি তখন পড়ালেখা করি না বাদাইম্মার মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দুপুরে খাবার সময় হলে বাসায় এসে খাই। তারপর আবার বেরিয়ে রাস্তায় কোন কারণ ছাড়াই এদিকসেদিক ঘুরি। নাখালপাড়ার এমন কোন গলি নাই যে গলিতে আমার পায়ের চিহ্ন পড়ে নাই। প্রতিটা গলির কোনাকাঞ্চি চেনা।

একদিন বারো নাম্বার গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত এক জায়গা ছিল। পরিত্যক্ত জায়গায় বেড়া দেয়া একটা ঘর। সেই ঘর থেকে মারামারির শব্দ আসতেছে। কৌতুহলী হয়ে দেখি বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখ দিলাম দেখি সত্যি সত্যি মারামারি করতেছে। সবার গায়েই একই কাপড়, কালো গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট। কাপড় আর মারামারির ধরন দেখে বুঝে গেলাম এখানে মার্শাল আর্ট শেখায়। এই জিনিশ দেখে নিজের মাথায়ও পোকা ঢুকে গেল, আমারও মার্শাল আর্ট শিখতে হবে। আরো কিছুক্ষণ বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখলাম দুয়েকজন পরিচিত মুখও আছে। যে মুখটা বেশি পরিচিত লাগলো সে আমাদের পাসের বাসাতেই থাকতেন নাম জানতাম না।

সেই দিনই তিনি বাসায় ফেরার সময় তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম ভাইয়ার নাম মনা। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারলাম তাঁরা সপ্তাহে দুই দিন শেখান। শুক্রবার ভোরে আর বিকালে এবং শনিবার শুধু বিকালে। স্কুলের নাম “জিৎ কুণ্ডু মার্শাল আর্ট স্কুল”। প্রতি শুক্রবারে বিকালে তাঁরা ব্রুসলির ছবি দেখতেন। মারামারির দৃশ্যে স্লো করে বুঝিয়ে দিতেন, ফ্রন্ট কিক, সাইট কিক, স্ট্রেট ডাবল পাঞ্চ, ব্লক। সেই সময়েই ব্রুসলির কয়েকটা ছবির নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখনও মনে আছে, ইন্টার দ্যা ড্রাগন, ওয়ে অফ দ্যা ড্রাগন, দ্যা বিগ বস। মনে আছে ফার্মগেট থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে ব্রুসলির পোস্টারও নিয়ে আসছিলাম।

মনা ভাইকে সেদিন সাহস করে বলতে পারি নাই আমি শিখতে চাই। মূল কারণ টাকা লাগবে। ভর্তির সময় দুইশ টাকা, মাসে চল্লিশ টাকা, পরিক্ষার সময় একশ টাকা। টাকার কথা বাসায় বলাও কঠিন। সময় যেহেতু জেনে গেছি সেহেতু দেখতে যেতে সমস্যা নাই। প্রায় একমাস ক্লাসে যেয়ে বসে থাকতাম দেখতাম আর বাসায় অনুশীলন করতাম। একদিন বাসায় অনুশীলন করার সময় মনা ভাই জানালা দিয়ে দেখে ফেললেন। তিনি দেখেছেন আমি জানতাম না।

মনা ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। একদিন বৃহস্তিপতিবার বিকালে আছরের নামাযের পর তিনি বাসায় যাওয়ার সময় আমাকে বাসা থেকে ডেকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। আমাকে দুইটা গেঞ্জি আর একটি ট্রাউজার দিলেন বললেন, ‘কালকে ভোড়ে এইগুলো পড়ে চলে আইসো।’ সেই অসম্ভব ভালো লেগেছিল। গেঞ্জি আর ট্রাউজারগুলো ছিল তাঁর বউয়ের। তাঁর বউ একসময় তাঁর কাছে মার্শাল আর্ট শিখত। আমি হালকা-পাতলা ছিলাম, ভাবিও হালকা-পাতলা ছিলেন এবং একটু খাটও। তাই ট্রাউজার আর গেঞ্জি ভাল মতই ফিট হয়েছিল। পরে ভাবির সঙ্গেও বেশ ভাল খাতির হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে দাওয়াত খাওয়ারও সৌভাগ্য হয়েছিল।

আমার নতুন স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছিল। নিয়মিত মার্শাল আর্ট অনুশীলন চলতে থাকল। আমি শুধু অনুশীলনই করি কিন্তু পরিক্ষা আর দেই না। কারণ পরিক্ষা দিতে হলে টাকা লাগবে। পরিচিত এক ছেলে আমার পরে এসেও পরিক্ষা দিয়ে হোয়াইট বেল্ট নিয়ে অনুশীলন করে। আমিই শুধু পরে থাকলাম জিরো বেল্ট নিয়ে। একদিন মনা ভাই বললেন, ‘অনেকদিন তো হল জিরো বেল্ট নিয়ে আছো, এইবার পরিক্ষার ফিস দিয়ে পরিক্ষাটা দিয়ে দাও।’ আমার আর পরিক্ষা দেয়া হয় নাই। আমাকে ভর্তি করে ছিলেন ফ্রিতে, কাপড়ও দিয়েছিলেন। প্রতি মাসের বেতনের টাকাও ফ্রি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিক্ষার ফি-টা ফ্রি করে দেয়া কঠিন ছিল।

বাসায়ও বলার মত অবস্থা ছিল না। যেখানে পড়ালেখার জন্য পয়সা দিতে পারত না, সেখানে মার্শাল আর্ট শেখার জন্য টাকা দেওয়াটা আরো কঠিন।

কত স্বপ্ন শুরু হয়েও শেষ হইল না…

Comments

comments

Comments

  1. স্বপ্ন তবুও থাকুক। একের পর এক স্বপ্নকে নিয়ে পথ চলাও যথেষ্ট সাহসের। সুতরাং, সে হিসেবে জিৎ কুন্ডু মার্শাল আর্ট স্কুলও একটা ধাপ হিসেবেই ভূমিকা রেখেছিলো।
    অফটপিক: জিৎ কুন্ডু স্টাইল নিয়ে আমি ঘাটাঘাটি করছি গত কিছুদিন ধরে। 🙂 ইন্টারেস্টিং!

    1. Ip-man মুভিটা দেখা না থাকলে দেইখেন। আই-পি ম্যানের কাছ থেকেই ‘ব্রুস লি’ শিক্ষা গ্রহণ করেছে তারপরে সম্ভবত নিজস্ব স্টাইল ‘জিৎ কুণ্ডু’ তৈরি করছে। 🙂

      1. Ip-man সবগুলো পার্টই দেখেছি। তাও একবার না। কয়েকবার করে। দারুন লাগে আমার 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.