টমিকা

প্রথম শ্রেণিতে থাকতে আমার সুন্দর একটা ব্যাগ ছিল। ব্যাগের নামটা মনে নাই। স্কুলে যাওয়ার সময় বড় বোন সাজুগুজু করিয়ে দিতেন। সাজুগুজু বলতে হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট। শার্ট ইং করে দিতেন। জুতা-মুজা পরিয়ে দিতেন। আর চুলে এক পাশে সিঁতি করে দিতেন। পিছনে দুই কাঁধে সেই স্ন্দুর ব্যাগটা ছিল। তবে মনে আছে ব্যাগে কার্টুনের ছবি ছিল। কি কার্টুন সেটা মনে নাই। ব্যাগের ভিতরে তিনটা বই আর তিনটা খাতা থাকতো। বাংলা, অংক, ইংরেজি তিনটা বই আর খাতাও তিনটা তিন রকম। ব্যাগের উপরের পকেটে পেন্সিল, রাবার আর শাপনার থাকতো। ক্লাশ ওয়ানে কলম আনা নিষেধ ছিল।

দ্বিতীয় শ্রেণিতে অল্প কয়েকদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। সেই অল্প কয়েকদিনে প্রথম শ্রেণিতে যে ব্যাগটা ছিল সেটাই ব্যবহার করেছি। তৃতীয় শ্রেণি আর চতুর্থ শ্রেণিতে ব্যাগ ব্যবহার করি নাই। হাতে করেই বই-খাতা নিয়ে যেতাম। কলম থাকত পকেটে। বহু প্যান্ট আর শার্ট কলমের কালিতে মাখামাখি হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকার সময় একই এলাকায় বন্ধু ছিল রাজিব। ওর স্মার্টনেস বেশ আকৃষ্ট করতো। বিশেষ করে ওর ব্যাগ আর ফ্ল্যাক্সের কারণে। আর জুতা পরে যাওয়া, প্যান্ট শার্ট ইং করে যাওয়া তো ছিলই। আমি বেশি ঈর্শা করতাম ওর পানি খাওয়ার ফ্লাক্সটা দেখে। আমি শুধু ওয়ানে ফ্লাক্স ব্যবহার করেছি আর কখনো ব্যবহার করা হয় নাই।

অনেকদিন পড়ালেখা বন্ধের পর যখন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছি তখন একটা নতুন ব্যাগের বাসনা জাগ্রত হলো। নতুন ব্যাগ এবং একটু দামি। এর একটা কারণ ছিল। আমাদের ঠিক উল্টা পাশে মুক্তাদের বাসা ছিল। মুক্তা আমার এক বছরের ছোট। কিন্তু আমার পড়াশোনার ঝামেলার কারণে তখন আমরা একই ক্লাশে পড়ি। মুক্তা একটা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেত। সে এই ব্যাগটা নতুন কিনেছিল। ব্যাগের নাম ছিল টমিকা। ইংরেজিতে ঞঙগওঈঅ এখাবে লিখা ছিল। ব্যাগটা কালো ছিল, কিন্তু টমিকা লেখাটা উজ্জল কমলা রঙ্গে লেখা ছিল।

তখন স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা লেগে থাকতো। পড়ালেখা তো ছিলই এ ছাড়া ছিল খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। তারপরে আরো কিছু হাস্যকর প্রতিযোগিতা ছিল। এখন সেটা হাস্যকর মনে হয় কিন্তু তখনতার জন্য ঠিকই ছিল। যেমন আমার দাদা অমুক জমিদার ছিল। তারপর দেখা গেছে অমুকের দাদার দাদা আমেরিকা ছিল কিন্তু আমেরিকা ভাল লাগে নাই তাই সব কিছু দান করে চলে আসছে। আরো যে কত অতিরঞ্জিত গল্প বানাতাম সবাই মিলে তার কোন হিশাব নাই। কোন কোন বন্ধুর আবার নিজস্ব বিমান অথবা ট্রেনও ছিল।

আমি খুব একটা কোন প্রতিযোগিতায় গা ভাসাতাম না। চুপাচাপ গল্প শুনতাম মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু গুলও মারতাম। সুস্থভাবে সম্ভবত মুক্তার সঙ্গেই একটা প্রতিযোগিতা করেছিলাম। আমারও মুক্তার মতো একটা ব্যাগ লাগবে সেটা যে কোন কিছুর বিনিময়েই হোক। অনেক রকম ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল করে ব্যাগের জন্য আম্মার কাছ থেকে ২৫০ টাকা যোগাড় করতে পারলাম। কিন্তু মুক্তার কাছে জানতে পারলাম ও এই ব্যাগ গুলশান থেকে ৫৫০ টাকা দিয়ে কিনেছে। এত টাকা যোগাড় করা তো মুশকিল। আমি তাও ১০০ টাকা যোগাড় করলাম। আমার হাতে তখন ৩৫০ টাকা। এলাকার বড় ভাই ফুয়াদ ভাই বললেন গুলশানে ব্যাগের দাম এমনিতেই একটু বেশি নেয়। ঐটা তো বড়লোকের এলাকা তাই। তুমি নিউমার্কেট অথবা ফার্মগেট যাও কম টাকায় পেয়ে যাবে।

আমি জীবনে কখনো নিউমার্কেট যাই নাই। তবুও একদিন সত্যি সত্যি সাহস করে বের হয়ে গেলাম। প্রথমে ফার্মগেট সেখানে মোটামুটি সব দোকান খুঁজে দুইটা দোকানে টমিকা ব্যাগটা পেলাম। এক দোকানে ৪৫০ টাকার কমে দিবে না। আরেক দোকানে একদাম ৪০০ এর কমে কেউ বিক্রি করবে না। ফুয়াদ ভাই বলেছিলেন নিউ মার্কেটে আরো কমে পাওয়া যাবে। তাই সাহস নিয়ে ছন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে টেম্পুতে করে নিউ মার্কেট চলে গেলাম। সেখানে প্রতিটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিন্তু কপাল খারাপ টমিকা ব্যাগটা পেলাম না।

আবার ফার্মগেট ফিরে আসলাম। হাতে তখন ৩৪০ টাকা। কিন্তু দোকানে তো ৪০০ টাকার কমে ব্যাগটা দিবে না। দুইটা দোকানেই অনেকবার বললাম ৩৪০ টাকা কিন্তু কেউ দিল না। আবার ঘুরাঘুরি করলাম কিন্তু আর কোন দোকানে পেলাম না। যে দোকানে ৪০০ টাকা চেয়েছিল সেই দোকানে গেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম দোকান খালি হওয়ার জন্য। দোকান যখন একদম ফাঁকা তখন দোকানিকে গিয়ে অনেক শান্তভাবে বললাম আমার ব্যাগটা খুবই পছন্দ হয়েছে আমার মা ২৫০ টাকা দিয়েছে আমার কাছে যা ছিল তা সহ ৩৪০ টাকা আছে। আমাকে যেন ব্যাগটা দেয়া হয়। লোকটির মনে হয় আমার প্রতি মায়া হলো। অথবা উনি আমার ইমোশনটা বুঝতে পারলেন। তিনি আমাকে ৩৪০ টাকার বিনিয়ে ব্যাগটা দিয়ে দিলেন।

আমি প্রচ- খুশি মনে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। ঐ দিনের মতো এত আনন্দের দিন খুব কমই মনে হয় আমার জীবনে এসেছে। ঐ বছরে পুরা নাখালপাড়া জুড়ে সম্ভবত ঐ টমিকা ব্যাগ দুইটাই ছিল একটা আমার আরেকটা মুক্তার। পরের বছর অবশ্য ভুড়ি ভুড়ি ঐ ব্যাগ পাওয়া গিয়েছিল। তখন নানা কোয়ালিটির ব্যাগ পাওয়া যেত ঐ একই নামের। ১৬০ টাকা দিয়েও পাওয়া যেত। বছর দুইতিন আগে আমি আর সুরাইয়া বই মেলায় গিয়েছি হঠাৎ মুক্তার সঙ্গে দেখা। সঙ্গে সঙ্গে টমিকা ব্যাগের কথা মনে পড়ে গেল।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.