
দিনটা ছিল ১০ আষাঢ়, মনীষী আহমদ ছফার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ‘আহমদ ছফা বিদ্যালয়’ নামে একটি নতুন পত্রিকা নিয়ে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। এই ব্যস্ততার মাঝে ‘ফেস বাংলাদেশে’র শাহীন ভাইয়ের ফোন, ‘শরীফ ভাই ফেসবুকে দেখলাম আপনি আহমদ ছফার জন্মদিন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান নিয়া মহা ব্যস্ত। তারপরেও ফোন দিলাম আগামী শুক্রবার অর্জুনায় যাব চরে ঘুরতে। যদি সময় বের করতে পারেন চলে আইসেন, শাহবাগ থেকে সকালে গাড়ি ছাড়বে।’ তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। যাওয়ার আগের দিন এসএমএস দিয়ে শাহীন ভাই জানিয়ে দিলেন গাড়ি ছাড়ার সময় এবং বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় কি কি নিতে হবে।
ছবির হাটের সামনে থেকে গাড়ি ছাড়ার কথা সকাল ৮ টায়। আমি উপস্থিত ৭:৩০ মিনিটেই। ঠিক আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে গাড়ি হাজির। এর আগে শাহীন ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ‘আমি আছি’। ঘড়ির কাটা যখন আটটা বেজে পনের মিনিট তখন গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িতে আমরা ছিলাম মোট আটজন, যাঁরা আছেন বেশির ভাগই অপরিচিত। মাত্র দুইজন পরিচিত। টেকনিকাল থেকে আরেকজন উঠবে। অবশ্য পরিচিত হতে বেশি সময় লাগল না। টেকনিকাল মোড় থেকে নোমান ভাইতে ও তাঁর ট্রাইপড গাড়িতে তুলতে তুলতে গল্প জমে উঠেছে। এখন আর কেউ কারও অপরিচিত না। গাবতলী পার হয়ে প্রথমেই আড্ডা হল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে। তারপর আসলো ছোট্টবেলার ভিডিও গেম খেলার কাহিনী নিয়ে। দেখা গেল মোটামুটি ভিডিও গেম ‘মোস্তফা’ খেলার ব্যপারে কয়েকজন এক্সপার্ট। শুধু এক্সপার্ট না, কে কত বেশি টাকা চুরি করে গেম খেলেছে সেটা প্রমাণের চেষ্টা। যেন টাকা চুরি করে ভিডিও গেম খেলাটা একটা বড় কাজ। এই কাজে মোটামুটি জিন্না ভাই বেশ পাকা বোঝা গেল।

আড্ডা দিতে দিতেই একসময় মির্জাপুর পার হয়ে গেলাম। বিশ্বরোডের পাসেই একটি হোটেলে গাড়ি থামানো হল নাস্তার জন্য, সকালে কারই খাওয়া হয় নাই। সবাই কোন রকমে চোখ ডলতে ডলতে চলে এসেছে। পরটা আর ডিম দিয়ে সবাই নাস্তা করলাম। ভাজি আর ডাল নেই বলে দুই/একজন হা-হুতাশ করলাম। যথারীতি আবারও রওনা দিলাম, আড্ডা চলতে থাকল। কোন ট্রিপে কেমন মজা হয়, কে কোন ট্রিপে কি করেছে এইসব গল্প চলতে থাকল। রাস্তায় বেশ জ্যাম তাই আস্তে আস্তে যেতে হচ্ছে। টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা পার হয়ে একসময় ভূয়াপুরের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। এলেঙ্গায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন নাসির ভাই আমাদের রাস্তা চেনানোর জন্য। অর্জুনায় যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে সময় প্রায় আড়াইটা।
প্রথমেই গেলাম নতুন সদ্য জন্ম নেয়া হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাবু ভাই। বাবু ভাই অসাধারণ একজন মানুষ। একজন স্বপ্নের কারিগর, তিনি স্বপ্ন দেখেন প্রতি গ্রামে একটি করে পাঠাগার হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছাতে ‘গ্রামপাঠাগার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন করেছেন, সেখান থেকে সবাইকে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার দেয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করেন। তিনি গ্রামের কথা চিন্তা করে কিছুদিন আগে ঢাকার শহরের এক স্কুলের চাকুরী ছেড়ে শহরের মায়া ত্যাগ করে গ্রামে চলে এসেছেন।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কয়েকজন মিলে একটা কাঁঠাল খেয়ে তারপর কলেজ প্রাঙ্গনে গাছ লাগালাম। এরপর রওনা দিলাম চরের উদ্দেশে। এরমধ্যে শুরু হল বৃষ্টি। সবাই আগে থেকে ছাতা নিয়ে এসেছি তাই তেমন সমস্যা হল না। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা নৌকায় উঠার জন্য ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দলে মোটামুটি দুইজন সিরিয়াস ফটোগ্রাফার একজন নোমান ভাই আরজন শাহনাজ পারভীন। এর মধ্যে নোমান ভাইয়ের ক্যামেরা এবং লেন্সের ওজন সোয়া সেরের কম হবে না। আর ট্রাইপডের কথা তো বাদই দিলাম। গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে নোমান ভাইয়ের সোয়া সের ওজনের ক্যামেরা হাত থেকে পরে বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে উনার মন খারাপ। এত কষ্ট করে ছবি তোলার জন্য এই ভ্রমণে এসেছেন মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। এদিকে পারভীন আপা ছাতার নিচে তাঁর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছেন।

বৃষ্টিও এক অদ্ভূত আচরণক করছে। এই বৃষ্টি আসছে এই চলে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে আসা জিন্না ভাই আর মিরাজ নিয়ে এসেছেন রেইনকোর্ট। তাঁরা রেইনকোর্ট খুললেই বৃষ্টি শুরু হয় আবার রেইনকোর্ট পরলেই বৃষ্টি শেষ। একসময় নৌকা আসলো, আমরা নৌকায় চেপে চরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। নৌকার একদম সামনে আকাশের দিকেয় তাকিয়ে উদাস মনে কামরুল ভাই শুয়ে পড়লেন। চরে নেমেই বাবু ভাই বললেন এই চরের নাম ডিগ্রির চর।
যেদিকে দুই চোখ যায় শুধু পানি। বর্ষাকাল না থাকলে চারিদিকে বালুর সাগরের দেখা মেলে। এখানকার ফসল একটি কি দুটি। যখন পানি থাকে না তখনই তাঁরা মূলত উপার্যন করে। আর যখন পানিতে বন্ধি থাকতে হয়, তখন কোন কাজ থাকে না। চরে নেমে আমরা নেমে গেলাম গোসল করতে, সঙ্গে নিয়ে আশা ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি চলতে থাকল। আমাদের পারভীন আপা ব্যস্ত তাঁর ক্যামেরা নিয়ে। তাঁর সঙ্গে একদল বাচ্চা-কাচ্চা জুটে গেল। কয়েকজন আবার বাড়ি থেকে নতুন জামাও পরে আসল। গোসল দাপাদাপির পর একটি বাড়িতে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে খাইতে বসলাম। অনেকদিন পর দেশি মোরগ আর ডাল দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি অদ্ভূত সুন্দর রংধনু।
এবার আমাদের ফেরার পালা, নৌকার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। নৌকাতে উঠার সঙ্গে নোমান ভাইয়ের ক্যামেরা চালু হয়ে গেল। নৌকায় করে এবং পায়ে হেঁটে আবার ফিরলাম হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজে। সবাই যখন ব্যাগ গুছাচ্ছি তখন মিরাজ ভাই ঘোষণা করলেন তিনি আজকে ফিরছেন না। আরো অন্তত একদিন এখানে থাকবেন। তাই বাবু ভাইয়ের সঙ্গে মিরাজ ভাইকেও আমরা বিদায় দিয়ে ঢাকার পথ ধরলাম। মনে মনে বাবু ভাইকে এক ধরনের ঈর্শা করতে লাগলাম, যদি পারতাম তাঁর মত শহর ছেড়ে গ্রামে থাকতে!
