তানিয়া বুঝে না প্রেম কারে কয়…

আনোয়ার, সানোয়ার, দেলোয়ার। তিন ভাই দুর্দান্ত ফুটবল খেলত। মাঝে মাঝে একই দলে খেলত। বিভিন্ন জায়গা থেকে ওদের হায়ার করেও নিয়ে যাওয়া হত। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আনোয়ার। তার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল । শুধু যে ফুটবল ভাল খেলত তা না, ক্রিকেটও খেলত ভাল। আমরা নাখালপাড়ায় একই দলে খেলতাম। আমি দলের অধিনায়ক ছিলাম কখন কাকে কোন পজিশনে নামাতে হবে সকল সিদ্ধান্ত নিতে হতো আমাকেই। আনোয়ার এমন এক খেলোয়াড় ছিল যে ওকে চাইলে ক্রিকেটিও ভাষায় ওপেনিং বাংলায় যদি বলি প্রথমে বল এবং ব্যাট দুইটাই করানো যেত। যাকে বলে জাত অলরাউন্ডার। অনেকটা হ্যান্সি ক্রনিয়ের মত। আজ আর ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে কথা বলব না, আনোয়ারকে নিয়ে অন্য একটা বিষয় নিয়ে বলি।

আনোয়ারের আরেকটা ভাল গুন ছিল, ওর হাতের লেখা ছিল অসাধারণ। এই অসাধারন হাতের লেখার যুক্ত হইছিল সে সুন্দর চিঠি লিখতে পারত। বলার অপেক্ষা রাখে না সেটা ছিল প্রেম পত্র। বন্ধুদের অনেকেই আনোয়ারের কাছ থেকে প্রেম পত্র লিখিয়ে আনত। আনোয়ারের প্রেম প্রতিভাও ছিল অসাধারণ। আমি যে সময়কার ঘটনা বলতেছি তখন আনোয়ার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করলেও আসলে ওর বয়স আমাদের চাইতে আরো দুইতিন বছরের বড় হবে। ঐ বয়সে সে মোটামুটি ২/৩টা প্রেম করে করে ঝুনা নারিকেল।

আনোয়ার প্রায়ই একটা কথা বলত, ‘আরে ঐগুলা আসল প্রেম না, যে আইসা নিজে থেকে প্রপোজ করবে সে হবে আমার আসল প্রেম। এবং সে অন্ধ হোক, খোরা হোক, বোবা হোক, যাই হোক।’ একদিন সত্যি সত্যি আনোয়ারের আসল প্রেম হয়ে গেলে। তখন আনোয়ার নবম শ্রেণিতে পড়ে। আমিও মাত্র নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। পার্থক্যের মধ্যে আনোয়ারের বিভাগ ব্যবসায় আর আমার বিভাগ বিজ্ঞান। আমরা সবাই স্কুল পালানোর আগে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতাম। স্কুল শুরু হওয়ার আগে আমরা সবাই চম্পট দিতাম। আড্ডা দেয়ার আরেকটা কারণ ছিল মেয়েদের ছুটি হওয়া। মেয়েরা সবাই চলে গেলে আমরাও স্কুল থেকে হাওয়া হইতাম। ঐ বয়সে সবারই একজন না একজনের মনের মানুষ ছিল।

তো একদিন স্কুল পালানোর আগে আমাদের সামনে আইসা একজন আনোয়াররে সরাসরি প্রপোজ কইরা বসল। আমরা সবাই পুরাই টাস্কি থতমত। সবাই ‘স্টাচু অফ লিবার্টি।’ মেয়ের নাম তানিয়া। চেহারার বর্ণনা নাই বা দিলাম, শুধু বলি মাশাল্লাহ। আনোয়ারও দেখতে অসাধারণ ছিল। সেই থেকে আনোয়ার সত্যিকারের প্রেম শুরু হইয়া গেল। ওরা প্রায়ই স্কুলের পরে দুইজনে কই জানি হাওয়া হইয়া যাইত। একদিন দুইজনে শহর থাইকাই হাওয়া হইয়া গেল। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। প্রায় সাতদিন পরে ফিরে আসল। আনোয়ারের কাছে গল্প শুনলাম দুইজনে মিললা কুয়াকাটা, কক্সবাজার ঘুইরা আসছে।

আনোয়ার তখন আমাদের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। আনোয়ার আড্ডায় আসলেই ওর রোমাঞ্চকর গল্প শুনায়। আমরা জিজ্ঞেস করি, ‘টাকা পাইছ কই?’ আনোয়ারের উত্তর, ‘আব্বা যে মোবাইলটা পাঠাইছিল ঐটা বেইচা দিছি, আর আমার গলায় যে চেইনটা ছিল আম্মা দিছিল ঐটাও শেষ। আর তানিয়ার গলার চেইনটা বিক্রি করছি। এইগুলা দিয়াই হইয়া গেছে। আর পকেটে তো কিছু ছিলই।’ এই ঘটনা ঘটানোর পর থেকে দুইজনের পরিবার দুইজনরে চোখে চোখে রাখে। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা নাই। তানিয়াকে ওর ভাই স্কুলে দিয়ে আসে আবার নিয়া আসে। দুই জনের মাঝে ফোনে লুকাইয়া লুকাইয়া কথা হয়। তখন মোবাইলের অনেক দাম আর মিনিটও ছিল মনে হয় ১০ টাকা। আনোয়ারের বাবা চাঁন মিয়া থাকে দেশের বাইরে। তাই ওদের টাকার সমস্যাটা অনেক কম ছিল।

এই সমস্যার মধ্যে দুজনে আবার সিদ্ধান্ত নিল পলাইব। আনোয়ার আমাদের কাছে সাহায্য চাইল। আমরা সবাই রাজি। এই ধরনের কাজের মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। কিন্তু তানিয়ারে বের করব কেমনে? ঠিক হইল সে রাতে বাসা থেকে পালাইব। তারপর ওরা দুইজনে চলে যাবে কোথাও। ওরা নিজেরা ঠিক করল এইবারও কক্সবাজার যাবে। রাতের নয়টার দিকে সত্যি সত্যি তানিয়া এক কাপড়ে চইলা আসল। আমরা সবাই ওদের নাবিস্কো বাস স্ট্যান্ডে আগাইয়া দিয়া আসলাম। ওরা বাসে করে এয়ারপোর্ট যাবে সেখানে ট্রেনে চট্টগ্রাম। তারপর কক্সবাজার। আবার সাতদিন পরে ফিরা আসল ওরা।

এর মধ্যে নবম শ্রেণিতে ফাইনাল পরিক্ষা চলে আসছে। এদিকে বলদ মাসুদ বাদশার ভিডিও দোকানে বাদশার থাপ্পর খাইয়া আইল আলীর বাড়ির সামনে। আইসা কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাদশা মারছে। শুইনা অনেকেরই মাথা গরম। মোটামুটি একজন একজন করে ১৮ জনে হয়ে গেল। বাদশার দোকানে যাইয়া বাদশারে একটা ধোলাই না দিলেই না। তারছিড়া সুমন বাসা থাইকা চাপাটি লইয়া হাজির। যার কাছে যা আছে তা নিয়া সবাই হাজির। হালকা বৃষ্টির মধ্যে সবাই বাদশার গেমসের দোকানে হাজির। শুরু করল প্রথমে তারছিড়া সুমন। প্রথমেই বাইরের গ্লাসটা ভাইঙ্গা ফেলল। ভেতরের পোলাপাইন সব দৌঁড়। এক মিনিটে গেমসের দোকান ফাঁকা। ১০ মিনিটের অপারেশনে দুইটা ভিডিও গেম ভাইঙ্গা চুরমার।

এই দশ মিনিটে পাশের ফাঁড়ি থাইকা পুলিশ হাজির। সবাই যে যার মত বের হইয়া গেলেও ভেতরে দুইজন আটা পরে গেল। একজন বলদ মাসুদ আর তারছিড়া সুমন। ধইরা প্রথমেই ওদের ফাঁরিতে নেয়া হইল। তারপর থানায় চালান। এর মধ্যে আলীর বাড়ির পুরা গ্রুপ হাওয়া। ওরা ছাড়া পাইল সাতদিন পরে। এর মধ্যে আলীর বাড়ির ছোট গ্রুপ গাজিপুর চলে গেল জাকিরের বাসায়। সব কিছু ঠাণ্ডা হইতে হইতে দশ দিন লাগল।

এই দশ দিনে ফাইনাল পরিক্ষা তিনটা হইয়াও গেল। আলীর বাড়ির গ্রুপের সবার পড়ালেখা শেষ হইয়া গেল। তারপরেও একদিন অনেকে পরিক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। এই দশদিনে আরেকটা ঘটনা ঘটল। আনোয়ারের আসল প্রেমিকা তানিয়াদের বাসা পাল্টাইয়া ফেলা হইল। নাখালপাড়া ছাইড়া কই যে গেল কেউ জানতে পারল না। আনোয়ার তখন প্রায়ই এ গলি ও গলি তানিয়ারে খুঁজে। কিন্তু আর তানিয়ারে খুঁজে পাইল না।

আনোয়ার সিদ্ধান্ত নিয়া নিল সে আর পড়ালেখা করবে না। শেষ পরিক্ষা ছিল একাউন্টিং, শেষ পরিক্ষা সে ঠিকই দিতে গেল কিন্তু খাতায় কিছুই লিখল না। ভিতরের পাতা সাদা কাগজে লিখে দিয়ে আসল, বিপ্লবের গান, তবে সেখানে নয়নার জায়গায় তানিয়া। ‘তানিয়া বুঝে না প্রেম কারে কয়…’ সে পুরা গানটাই তুইলা দিয়া আসল।

এই খাতা দেখার দায়িত্ব পরল বিখ্যাত ট্যারা সুবতের হাতে। অর্থাৎ সুবত মণ্ডল স্যার। সে খাতা পাইয়া প্রতিদিন আনোয়াররে খুঁজে আর সবাইরে বলে একবার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের চেহারাটা যদি দেখতে পারতাম। জীবনটা সার্থক হইত। পোলাডা কে? দেখতে কেমন?

একদিকে সুবত মণ্ডল আনোয়াররে খুঁজে আর অন্য দিকে আনোয়ার তার তানিয়ারে খুঁজে। আহা! দুইজনের উদ্দেশ্য এক। খোঁজা।

২৫ চৈত্র ১৪২১

Comments

comments

Comments

  1. এক উদ্দেশ্য..কিন্তু গন্তব্য ভিন্ন 🙂 কারা এরা? বাস্তবের চরিত্র?

    1. জি ভাই, বাস্তব। আমার বেশির ভাগ লেখাই বাস্তব। আমার অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.